বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাজার ধরার আকাঙ্ক্ষা থেকেই এই বিশ্বকাপের সহ-আয়োজক করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে। যে বিশ্বকাপ শুরু হচ্ছে বাংলাদেশ সময় আগামীকাল সকাল সাড়ে ৬টায় যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা ম্যাচ দিয়ে।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ না ক্রিকেটের নতুন বিশ্বযুদ্ধ? দুটিই বলতে পারেন। যুদ্ধের আদি ও অকৃত্রিম কারণ তো ছিল সাম্রাজ্য বিস্তার। এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে যুক্তরাষ্ট্রকে সহ-আয়োজক করার পেছনে কি সেই উদ্দেশ্যই লুকিয়ে নেই! ‘যুদ্ধ’ তো তাহলে বলাই যায়। সেটির বাহন যেহেতু বিশ্বকাপ, বিশ্বযুদ্ধই বলুন না হয়।
আজ শনিবার ডালাসের সন্ধ্যায় যখন এই বিশ্বকাপের উদ্বোধনী সংগীত বেজে উঠবে, বাংলাদেশে তখন রোববারের ভোর। পুরো বিশ্বকাপজুড়েই এমন হবে। এখানে সকালে খেলা শুরু মানে বাংলাদেশে রাত। সন্ধ্যায় শুরু হলে বাংলাদেশে ভোর। এই বিশ্বকাপ যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াবে, সেটিতেও ভোর আছে। বেসবল, বাস্কেটবল আর আমেরিকান ফুটবলের এই দেশে বিশ্বকাপ কি এনে দেবে ক্রিকেটে নতুন ভোর?
বিশ্বকাপের ৫৫টি ম্যাচের মাত্র ১৬টি যুক্তরাষ্ট্রে। আয়োজক ৯ শহরের মাত্র ৩টি এখানে—ডালাস, ফ্লোরিডা ও নিউইয়র্ক। প্রায় ৬১ শতাংশ ম্যাচই ওয়েস্ট ইন্ডিজে। তারপরও আমেরিকায় বিশ্বকাপ-আমেরিকায় বিশ্বকাপ বলে এমন একটা রব উঠেছে, যেন বিশ্বকাপটা শুধু এখানেই হচ্ছে!
সেই বিশ্বকাপের বর্ণিল আবাহন হয়ে গেছে এতক্ষণে। শুক্রবার সন্ধ্যায় নিউইয়র্কের ম্যানহাটানের রকফেলার সেন্টার ভবনের গায়ে আলোর খেলায় ফুটে উঠেছে বিশ্বকাপের ২০ অধিনায়কের ছবি। ৭০ তলা এই ভবনে হলিউডের বিখ্যাত অনেক সিনেমার শুটিং হয়েছে। তা সময়ের ব্যাপ্তি আর নাটকীয়তার দিক থেকে সিনেমার সঙ্গে তো টি-টোয়েন্টির একটু হলেও মিল আছে। রাত সোয়া ৮টায় সূর্যাস্তের সময় শুরু সেই ‘লাইট শো’ থেমে থেমে চলেছে মধ্যরাত পর্যন্ত।
আর বিশ্বকাপ চলবে প্রায় পুরোটা মাসজুড়ে। আজ ডালাসে যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা ম্যাচ দিয়ে যেটির শুরু, সেটির শেষ বারবাডোজে ২৯ জুনের ফাইনালে। যে ফাইনালের দুই দল চূড়ান্ত করতেই এর আগের ৫৪ ম্যাচ। দলের সংখ্যা বলুন বা আয়োজনের ব্যাপ্তি—এত বড় বিশ্বকাপ এর আগে কখনো দেখেনি ক্রিকেট।
আর কোনো বিশ্বকাপ এমন বৃহত্তর অর্থ নিয়েও দেখা দেয়নি। এ যেন ক্রিকেটের নতুন উপনিবেশ স্থাপনের লড়াই। বরং বলা ভালো, হারিয়ে যাওয়া উপনিবেশ ফিরে পাওয়ার মরিয়া চেষ্টা। কথাটা এখন হয়তো অনেকের কাছে নতুন শোনাবে, অবিশ্বাস্যও মনে হবে কারও কারও কাছে, তবে সত্যি এটাই যে একসময় উত্তর আমেরিকা ছিল ক্রিকেটের উর্বর ভূমি। পুরো মহাদেশে ছড়িয়ে না গিয়ে আরও নির্দিষ্ট করে বললে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা। আর কেন্দ্র বললে যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া। সেখানে এখন যেমন টেনিস কোর্টের ছড়াছড়ি, তখন ছড়াছড়ি ছিল ক্রিকেট ক্লাবের।
ভারত-পাকিস্তানে কখনো না খেলা স্যার ডনও খেলে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মাঠে। তা অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিকেট সূর্য অস্তমিত হয়ে যাওয়ার পর।
ক্রিকেটের প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক সফরের গন্তব্যও ছিল যুক্তরাষ্ট্রই। ১৮৫৯ সালে ইংল্যান্ড থেকে একটি দল খেলতে এসেছিল এখানে। ইংল্যান্ড থেকে কোনো দল অস্ট্রেলিয়া সফরে গেছে এরও অনেক পরে। টেস্ট ক্রিকেট শুরুর আগেই আরও দুবার, ১৮৬৮ ও ১৮৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্র ঘুরে যায় ইংল্যান্ড দল। ১৮৯৩ সালে ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পথে এখানে নেমেছিল অস্ট্রেলিয়া দলও। ফিলাডেলফিয়া একাদশের কাছে তিন দিনের ম্যাচে তাদের ইনিংস ও ৬৮ রানে হেরে যাওয়া বড় আলোড়নই ছিল সেই সময়ে। অস্ট্রেলিয়া পরের ম্যাচটা জিতলেও প্রথম ম্যাচটাই আলোচনায় থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের একটা শহরের দল অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দিলে তা-ই হওয়ার কথা।
স্যার ডন ব্র্যাডম্যান এশিয়ার একটি মাঠেই খেলেছেন। ইংল্যান্ড যাওয়ার পথে এখনকার শ্রীলঙ্কা আর সেই সময়ের সিলোনে যাত্রাবিরতিতে থেমেছিল অস্ট্রেলিয়া দলের জাহাজ। ডনের ব্যাটিং করতে নামার সেই ছবিটা এখনো সগৌরবে ঝুলছে কলম্বোর পি সারাভানামুত্তু স্টেডিয়ামে। ভারত-পাকিস্তানে কখনো না খেলা স্যার ডনও খেলে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মাঠে। তা অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিকেট সূর্য অস্তমিত হয়ে যাওয়ার পর। ১৯৩২ সালে অস্ট্রেলিয়ান লেগ স্পিনার আর্থার মেইলির উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সফরে সস্ত্রীক যোগ দিয়েছিলেন ব্র্যাডম্যান। কিছুটা নতুন মহাদেশ দেখার ইচ্ছা থেকে, তার চেয়েও বেশি বন্ধুকৃত্য করতে। মেইলি যে বলেই দিয়েছিলেন, ডন ব্র্যাডম্যান যেতে রাজি হলেই শুধু তিনি এই সফরের আয়োজন করবেন। কারণটা শুধু ভালোবাসা ছিল না। সফরের খরচ তুলতে বড় নাম দরকার ছিল।
ক্রিকেটের প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক সফরের গন্তব্যও ছিল যুক্তরাষ্ট্রই। ১৮৫৯ সালে ইংল্যান্ড থেকে একটি দল খেলতে এসেছিল এখানে।
প্রায় আড়াই মাসের সেই সফরের যুক্তরাষ্ট্র-অংশে নিউইয়র্ক, ডেট্রয়েট, শিকাগো, সিয়াটল, সান ফ্রান্সিসকো, লস অ্যাঞ্জেলেসে ম্যাচ খেলেছে অস্ট্রেলিয়া একাদশ। বেশির ভাগ শৌখিন দলের বিপক্ষে, তারপরও ব্র্যাডম্যান তো ব্র্যাডম্যান। আত্মজীবনীতে সেই যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা সফরে নিজের পারফরম্যান্সের বিস্তারিতও ঠিকই লিখে রেখেছেন। ৫১ ইনিংসে ১০২ গড়ে ৩৭৭৯ রান। কানাডার অবস্থা একটু ভালো হলেও যুক্তরাষ্ট্রে যে ক্রিকেটের কোনো ভবিষ্যৎ দেখেন না, সেই ঘোষণাও দেওয়া আছে ফেয়ারওয়েল টু ক্রিকেট নামে ডনের আত্মজীবনীতে।
৯২ বছর পর এসে কি অন্য কিছু বলা যাচ্ছে? এটা ঠিক, যুক্তরাষ্ট্রে এখন প্রচুর ক্রিকেট খেলা হয়। তবে তা খেলে মূলত অভিবাসী দক্ষিণ এশিয়ানরাই। বড়জোর ক্যারিবীয় অভিবাসীদের যোগ করে নিতে পারেন এর সঙ্গে। সাড়ে ৩৩ কোটি মানুষের এই দেশে দক্ষিণ এশিয়ান বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা মাত্র ৪৫ লাখ। টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম জনসংখ্যার নিউজিল্যান্ডের চেয়েও যা ৫ লাখ কম। বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাজার ধরার আকাঙ্ক্ষা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বকাপের সহ-আয়োজক বানিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য তাই কতটুকু ফলপ্রসূ হবে, তা একটা প্রশ্ন বটে।
ফুটবল তো অনেক চেষ্টা করেও পারেনি। গত শতকের সাতের দশকে পেলে-বেকেনবাওয়াররা এসেও আমেরিকান জনমানসে ফুটবলের ছাপ ফেলতে ব্যর্থ হয়েছেন। ডেভিড বেকহাম-লিওনেল মেসিদের মিলিত চেষ্টায় গত ২০ বছরে অবস্থাটা হয়তো সামান্য বদলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল খেলার জগতের মূল ধারায় একটু হলেও নাকি এখন খুঁজে পাওয়া যায় মেজর লিগ সকারকে।
ক্রিকেটের লড়াইটা আরও কঠিন। এর আগের ব্যর্থ চেষ্টাগুলো থেকে যা অনুমান করা যায়। ২০১৫ সালে শচীন টেন্ডুলকার ও শেন ওয়ার্নের যৌথ উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্রে কিছু প্রদর্শনী ম্যাচ হয়েছিল। ব্রায়ান লারা, গ্লেন ম্যাকগ্রা, ওয়াসিম আকরামের মতো সে সময়ের বড় বড় নাম ছিল তাঁদের সঙ্গে। তারপরও একবার হয়েই তা শেষ। টেন্ডুলকার-ওয়ার্নের বিরোধই আসল কারণ, নাকি সেভাবে সাড়া না পাওয়া, তা নিয়ে যদিও তর্ক আছে।
এবার ভিন্ন কিছুর প্রত্যাশার একটু হলেও ভিত্তি আছে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে মেজর লিগ ক্রিকেটের সফল অভিষেক হয়েছে। এবার এই বিশ্বকাপ। চার বছর পর লস অ্যাঞ্জেলেসে ১২৪ বছর বিরতি দিয়ে অলিম্পিকে ফিরে আসছে ক্রিকেট। ভুলে যাওয়া ক্রিকেট আমেরিকানরা আবারও চিনলেও চিনতে পারে!