ভারতীয় দলের চাওয়া পূরণ করতেই যে উইকেটের পরিবর্তন, এটা নিয়ে তর্ক মানে অহেতুক সময় নষ্ট। জানতে ইচ্ছা করে, রাহুল দ্রাবিড়-রোহিত শর্মাদের কি এখন মনে হচ্ছে না, এই বিতর্কটার জন্ম না দিলেই ভালো হতো! দুই ম্যাচে ব্যবহৃত উইকেট তো মোটেই তাঁদের চাওয়া অনুযায়ী আচরণ করেনি। মাঝখান থেকে অকারণে একটা কালি লেগে গেল গায়ে।
ম্যাচে রান হয়েছে মোট ৭২৪। এই বিশ্বকাপে এর চেয়ে বেশি রান দেখেছে মাত্র দুটি ম্যাচ। তবে বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে এত রান? না, প্রশ্নই আসে না। এর আগে ১ নম্বরে ছিল ২০১৫ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকা যে সেমিফাইনাল, সেটিতে রান এর চেয়ে ১৪৪ কম।
ম্যাচে যে ১৪ উইকেট পড়েছে, তার ১৩টিই পেসারদের। স্পিনে যে মাত্র একটি, এটা তো আর বলার দরকার পড়ছে না। কী ব্যাপার, ওয়াংখেড়ের এই উইকেট নিয়ে না এত হইচই! এটি না ভয়াবহ এক টার্নিং উইকেট হবে, যেখানে বল পড়েই লাট্টুর মতো ঘুরতে শুরু করবে।
এখনো কাল রাতের অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকা সেমিফাইনালের ঘোরে থাকলে হয়তো খটকা লাগছে। এটা কোন সেমিফাইনালের কথা হচ্ছে? সংখ্যা-টংখ্যা কিছুই তো মিলছে না। ও আচ্ছা, ওয়াংখেড়ের উইকেট তো বলাই হয়েছে। ওটা চোখ এড়িয়ে না গেলে আপনার বুঝে ফেলার কথা, এসব পরিসংখ্যান গত পরশু প্রথম সেমিফাইনালের। যে সেমিফাইনাল শুরুর আগেই বড় বিতর্ক। কেন্দ্রবিন্দুতে স্বাগতিক ভারত।
সেমিফাইনালের জন্য ঠিক করে রাখা বিশ্বকাপে অব্যবহৃত নতুন উইকেটের বদলে ম্যাচ এর পাশের উইকেটে। যেটিতে এর আগে বিশ্বকাপের দুটি ম্যাচ হয়েছে। উদ্দেশ্য পরিষ্কার, ভারতের চিরন্তন শক্তির জায়গা স্পিন যেন আরও ধারালো হয়ে উঠে নিউজিল্যান্ডকে ফালা ফালা করে দিতে পারে।
খবরটার সত্যতা নিয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না। কারণ, স্কুপটা করেছেন লরেন্স বুথ। ইংল্যান্ডের ডেইলি মেইল–এর ক্রিকেট প্রতিনিধি। এর চেয়েও বড় পরিচয়, ক্রিকেটের বাইবেল বলে পরিচিত উইজডেন ক্রিকেটার্স–এর সম্পাদক। শোনা কথায় নিউজ করে ফেলার মতো লোক তিনি নন। তার চেয়েও বড় কথা, নিউজটাতে সব তথ্যপ্রমাণই ছিল। ক্ষুব্ধ আইসিসির পিচ পরামর্শক অ্যান্ডি অ্যাটকিনসনের পাঠানো ই-মেইল থেকে উদ্ধৃতিও। সবচেয়ে বড় কথা, খবরটা করার সময়ই তো ঝুঁকিটা তাঁর জানা ছিল। ঘটনা সত্যি কি না, এটা তো কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সবাই জেনে যাবে।
তা ওয়াংখেড়েতে গিয়ে সবাই দেখলেন, সেমিফাইনালের উইকেট আসলেই বদলে গেছে। তা এই পুরোনো বিষয় নিয়ে আবার এত কথা কেন? তার ওপর আবার এই সময়ে! বিশ্বকাপ যখন ক্ষণ গুনছে ফাইনালের। যে ফাইনালের ট্যাগলাইন—এই বিশ্বকাপের সেরা দল বনাম বিশ্বকাপ ইতিহাসের সফলতম দল।
ওই যে বিশ্বকাপের সেরা দল কথাটা, সেটিই আসলে সেমিফাইনালে ওয়াংখেড়ের উইকেট-বিতর্কটাকে চাপা পড়তে দিচ্ছে না।
ভারতীয় দলের চাওয়া পূরণ করতেই যে উইকেটের পরিবর্তন, এটা নিয়ে তর্ক মানে অহেতুক সময় নষ্ট। জানতে ইচ্ছা করে, রাহুল দ্রাবিড়-রোহিত শর্মাদের কি এখন মনে হচ্ছে না, এই বিতর্কটার জন্ম না দিলেই ভালো হতো! দুই ম্যাচে ব্যবহৃত উইকেট তো মোটেই তাঁদের চাওয়া অনুযায়ী আচরণ করেনি। মাঝখান থেকে অকারণে একটা কালি লেগে গেল গায়ে। যেটিকে স্বাগতিকের সুবিধার চেয়েও টাকাপয়সার জোরে বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্তা হয়ে ওঠার ক্ষমতার অপব্যবহারের আরেকটা উদাহরণ হিসেবেই ধরে নিচ্ছে সবাই।
এই বিশ্বকাপে ভারতই একমাত্র দল, যারা রাউন্ড রবিন লিগের ৯টি ম্যাচ খেলেছে ৯টি ভেন্যুতে। সেসব ভেন্যুর উইকেট তৈরিতেও ভারতীয় দলের চাওয়া-না চাওয়ার ভূমিকা হয়তো ছিল। তবে ভারত এমনই বিশাল এক দেশ যে একেকটা ভেন্যুর উইকেটের একেক চরিত্র। চাইলেই যা পুরোপুরি বদলে দেওয়া সম্ভব নয়। লিগ পর্বে ভারতের টানা ৯ জয় তাই সব ধরনের উইকেটেই নিজেদের প্রশ্নাতীত শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়ে। এক অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৯৯ রান তাড়া করতে নেমে ২ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে ফেলার সময়টা ছাড়া ভারত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ল কই!
এর আগেও তিনবার ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলেছে ভারত। তবে কোনোবারই এমন রাজার মতো ফাইনালে যায়নি। অপরাজিত থেকে ফাইনাল এই প্রথম। যা মনে করিয়ে দিচ্ছে ২০০৩ ও ২০০৭ বিশ্বকাপের অস্ট্রেলিয়ার কথা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের কথা আর বললাম না, কারণ তা অনেক পুরোনো কাহিনি। ভারতের বোলিং আক্রমণও তো একমাত্রিক নয়। তাহলে সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে কেন উইকেট নিয়ে এত ভাবতে হবে! কারণ কি এর আগের দুটি বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নিতে হওয়ার দুঃসহ স্মৃতি? সর্বশেষ আবার এই নিউজিল্যান্ডের কাছে হেরেই।
ম্যাচ চলার সময়ও সিডনি আর ওল্ড ট্রাফোর্ড যে মনে হানা দিচ্ছিল, সেটি স্বীকার করেছেন মোহাম্মদ শামি। বেশি নিশ্চয়ই কেইন উইলিয়ামসন ও ড্যারিল মিচেলের জুটির সময়। হয়তো তার চেয়েও বেশি, মিড অনে উইলিয়ামসনের সহজ ক্যাচটা ফেলে দেওয়ার পর। সেই শামিই পরে কীভাবে ওই শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে ভারতকে ফাইনালে তোলার নায়ক হয়ে গেলেন, তা তো সবার জানাই। বিরাট কোহলির সেঞ্চুরিটা যদি ইতিহাস গড়ার হয়, শ্রেয়াস আইয়ারেরটা সম্ভবত এই বিশ্বকাপে কোনো ভারতীয় ব্যাটসম্যানের সেরা সেঞ্চুরি। ড্যারিল মিচেলের সেঞ্চুরিটাকেও বা ভুলে যান কীভাবে! ভিন্ন ভিন্ন কারণে উজ্জ্বল এই তিন সেঞ্চুরির ম্যাচও শেষ হতে হতে কিনা মোহাম্মদ শামির পাশে বাকি সবাই মিটমিটে প্রদীপ।
দেশের মাটিতে সর্বশেষ বিশ্বকাপে ভারতের জয়ে প্রতিটি ম্যাচে একটা কমন ব্যাপার ছিল। প্রথম বলেই বীরেন্দর শেবাগের চার। এই বিশ্বকাপেও এর কাছাকাছি এমন একটা ব্যাপার আছে। প্রথম ওভারেই মোহাম্মদ শামির উইকেট নেওয়া। ৬ ম্যাচের ৫টিতেই যা নিয়েছেন। ৬ ম্যাচ কেন, তা এরই মধ্যে বহুল আলোচিত। ভারতের পছন্দের প্রথম একাদশে তো নামই ছিল না তাঁর। ভারতের প্রথম চারটি ম্যাচে তাই বাইরে বসে থেকেছেন। ৬ ম্যাচে ২৩ উইকেট আর বিশ্বকাপে ভারতের পক্ষে সেরা বোলিংয়ে রেকর্ড গড়ে ফেলার পর এখন যা অবিশ্বাস্যই মনে হয়।
যেমন অবিশ্বাস্য মোহাম্মদ শামির জীবনে ফেরা। ২০১৮ সালে ইংল্যান্ড সফরের আগে ফিটনেস টেস্টে ব্যর্থ হয়ে ক্রিকেটই তো ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। সংসারে তখন চরম অশান্তি। স্ত্রী ভয়ংকর সব অভিযোগ করে যাচ্ছেন, যা গড়িয়েছে থানা-পুলিশ পর্যন্ত। ক্রিকেট তো ক্রিকেট, জীবন থেকেই শামি তখন পালাতে পারলে বাঁচেন। সেখান থেকে ফিরে এসে আজ ভারতের মানুষের নয়নমণি, এই বিশ্বকাপের সফলতম বোলার।
মোহাম্মদ শামির গল্পটা শুধুই উইকেট নেওয়ার নয়, আরও বেশি কিছু।