ওবেদ ম্যাকয়ের টি-টোয়েন্টি ম্যাচ আর রানসংখ্যা প্রায় কাছাকাছি। ১৩০ ম্যাচে ১৬২ রান, যা জানার পর কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, ব্যাট ধরতে পারেন তো?
তবু ওয়েস্ট ইন্ডিজের যখন জয়ের জন্য ৩ বলে ৯ রান দরকার, তখন শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে ম্যাকয়কে ব্যাটিংয়ে নামতে দেখে পুরো গ্যালারিই যেন নেচে উঠল। হাততালি, চিৎকারে আলোড়ন উঠল চারপাশে।
মাত্রই আউট হয়ে গ্যালারিতে নিস্তব্ধতা নামিয়ে গেছেন রোভমান পাওয়েল। ৩৫ বলে ৬০ রানের ঝোড়ো ইনিংস খেলা পাওয়েলই যখন ম্যাচ শেষ করতে পারেননি, ব্যাটিংয়ে নড়বড়ে ম্যাকয় আর কী করবেন? তবু আনন্দে উদ্বেলিত সেন্ট ভিনসেন্টের আর্নস ভেল গ্যালারি।
মনে শেষাবধি জয়ের আশা জাগিয়ে রাখতে হয় বলে নয়, আর্নস ভেল গ্যালারি নিস্তব্ধতা ভেঙে জেগে ওঠার কারণ ওই ম্যাকয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজ নামের এই ক্রিকেট দলটিতে সেন্ট ভিনসেন্ট অ্যান্ড গ্রেনাডার খেলোয়াড় এই একজনই। আর দেশের ছেলে দেশের মাটিতে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলছে আজই প্রথম। ম্যাকয়ের মাঠে নামার আনন্দ তাই যতটা না ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের, তার চেয়ে অনেক বেশি সেন্ট ভিনসেন্টবাসীর। গ্যালারিতে থাকা সিংহভাগ দর্শকের জন্য যা দেশকে আলাদাভাবে অনুভব করার, গর্বে বুক ভরে যাওয়ার মুহূর্ত।
তবে ম্যাকয়, ম্যাকয়ের দেশ সেন্ট ভিনসেন্ট আর ম্যাকয়ের দল ওয়েস্ট ইন্ডিজের আনন্দের মুহূর্ত ওটুকুই। দিনটি যে বাংলাদেশের। বাংলাদেশের বিজয়ের। ৫৩ বছর আগের এমন দিনেই বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। এমন দিন তো বাংলাদেশের হবেই।
হয়েছেও, শেষের ওই তিন বলে তাই হাসান মাহমুদ হয়ে ওঠেন ‘আনপ্লেয়েবল’। ব্যাটে বল লাগাতে পারেন না ম্যাকয়, বোল্ড হন আলজারি জোসেফ। প্রায় হাত ফসকে যাওয়া ম্যাচটাই বাংলাদেশ জিতে যায় ৭ রানের ব্যবধানে, যা ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম জয়। বাংলাদেশে মানুষ যখন লাল-সবুজ পতাকায় বিজয় উদ্যাপন করছেন, হাজার মাইল দূর থেকে লাল-সবুজে ছাওয়া জার্সি পরেই সে আনন্দে আরেকটি জয় যোগ করলেন মেহেদী-হাসানরা।
অথচ সেন্ট ভিনসেন্টে বাংলাদেশ খেলতে নেমেছিল পেছনের একরাশ হতাশা নিয়ে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে এসে টেস্ট সিরিজ ড্র করলেও সেন্ট কিটসে ওয়ানডে সিরিজে হতে হয়েছে ৩-০ ব্যবধানে ধবলধোলাই। নিজেদের সবচেয়ে প্রিয় সংস্করণে যখন এমন হার, তখন টি-টোয়েন্টির দল ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামনে আরও বড় চ্যালেঞ্জই ছিল অপেক্ষায়।
এই সেন্ট ভিনসেন্টেই জুনে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের তিনটি ম্যাচ খেলেছিল বাংলাদেশ। যার শেষটা ছিল আফগানিস্তানের বিপক্ষে, বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলার হাতছানি নিয়ে। কিন্তু ফিরতে হয়েছিল মন খারাপ করেই। সব মিলিয়ে সেন্ট ভিনসেন্টে আবার ফেরাটা স্বস্তিকর হওয়ার উপলক্ষ ছিল না। আর প্রথমে ব্যাট করে পুঁজিটা দেড় শ পার করতে না পারায় তো আরও নয়।
কিন্তু আজ তো বিজয়ের দিন। দ্বিতীয় ওভারেই উইকেট এনে দিলেন তাসকিন। পরের ওভারে উইকেট মেহেদী হাসানেরও। অফ স্পিনার মেহেদী পরেরবার বল হাতে নেওয়ার আগে প্রান্ত বদল করলেন। এবার একসঙ্গে ২ উইকেট। এভাবে একটা একটা করে উইকেট নিতে নিতে ৬১ রানেই ৭ উইকেট নেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের। ৪ ওভার হাত ঘুরিয়ে ১৩ রানে ৪ উইকেটেই মেহেদীর, তাঁর ক্যারিয়ার–সেরা।
ম্যাচটা তখন একপ্রকার মুঠোতেই। ক্যারিবীয়দের দরকার ৪২ বলে ৭৮ রান, হাতে মাত্র ৩ উইকেট। কিন্তু মুঠোর নিয়ন্ত্রণ আলগা হয়ে গেল মুহূর্তেই। রিশাদ হোসেন, তাসকিন আর তানজিম সাকিবের টানা তিন ওভারে বেরিয়ে গেল ৫০ রান। ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক প্রথম ১৮ রান করতে ১৮ বল লাগালেও পরের ১০ বলের মধ্যেই পৌঁছে গেলেন ফিফটিতে। মাইলফলকের চেয়েও বড় কথা, বাংলাদেশের মুঠো থেকে জয়টা প্রায় কেড়েই নিয়েছেন।
কিন্তু আজ তো বাংলাদেশের বিজয়ের দিন। ওই রিশাদ, তাসকিন আর তানজিম মিলেই ১৭, ১৮, ১৯ এই তিন ওভার শেষ করলেন ১৮ রানের মধ্যে। শেষ ওভারে হাসানের জন্য থাকল ১০ রান। যেখান থেকে বাংলাদেশ ম্যাচটা শেষ করেছে জয় দিয়েই।
এর আগে বাংলাদেশকে দেড় শর কাছাকাছি রানে নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্বটা সৌম্য সরকার, জাকের আলী, শামীম হোসেন আর মেহেদীর। প্রথম দুজন ৩০ রানে ৩ উইকেট পড়ার পর গড়েছেন ৫৭ রানের জুটি, পরের দুজন শেষের দিকে ২৯ বলে যোগ করেছেন ৪৮ রান।
তবে জয়ের কাজটি শেষতক বোলাররাই করেছেন। করারই কথা। আজ যে বিজয়ের দিন। বিজয়ের উৎসবে মেতে ওঠার দিন।
বাংলাদেশ: ২০ ওভারে ১৪৭/৬ (সৌম্য ৪৩, শামীম ২৭, জাকের ২৭, মেহেদী ২৬*; আকিল ২/১৩, ম্যাকয় ২/৩০)।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ: ১৯.৫ ওভারে ১৪০ (পাওয়েল ৬০, শেফার্ড ২২, চার্লস ২০; মেহেদী ৪/১৩, হাসান ২/১৮, তাসকিন ২/২৮)।
ফল: বাংলাদেশ ৭ রানে জয়ী।
ম্যান অব দ্য ম্যাচ: মেহেদী হাসান।