আপনার কাছে লিটন দাস মানে কী? আসলে জানতে চাওয়া হচ্ছে লিটনকে দেখলে বা তাঁর কথা মাথায় এলে আপনার চোখের সামনে সবার আগে কী ভেসে ওঠে। উইকেটে এসে দারুণ কিছু শট খেলবেন, সবাই প্রশংসার পুষ্প–বৃষ্টি ঝরাতে শুরু করবে। সেই প্রশংসার বৃষ্টি মাটিতে পড়ার আগেই অযথা উইকেট ছুড়ে দিয়ে আসবেন লিটন! প্রশংসা রূপ নেবে নিন্দায়। শুরু হয়ে যাবে আফসোস আর আক্ষেপ।
এটাই তো! কিন্তু লিটনকে নিয়ে ‘কমন’ এই ধারণাটা আজকের জন্য হলেও মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। আজ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তিন নম্বরে নেমে তিনি ৩৮ বলে ৩৬ রানের যে ইনিংসটি খেলেছেন, সেটিকে কোনোভাবেই লিটনীয় ইনিংস বলা যাবে না। অথচ ম্যাচ পরিস্থিতি বিবেচনায় এটিই বাংলাদেশের জন্য হয়ে উঠেছিল মহাগুরুত্বপূর্ণ এক ইনিংস।
লিটন ব্যাটিংয়ে নেমেছেন তিন নম্বরে। তিন নম্বরে ব্যাট করলেও তাঁকে ক্রিজে আসতে হয়েছে প্রথম ওভারে। বাংলাদেশের তিন নম্বর ব্যাটসম্যান প্রথম বা দ্বিতীয় ওভারেই ক্রিজে আসছেন—কিছুদিন ধরে অবশ্য এটাই নিয়মিত চিত্র হয়ে গেছে। ‘এই নিয়মিত চিত্র’র আঁকিয়ে সেই কিছুদিন লিটনই ছিলেন। সর্বশেষ কয়েকটি ম্যাচে ইনিংস ওপেন করতে নেমে কোনো কোনো দিন ভালো দু–একটা শট খেলে, কখনো আবার কিছু না করেই প্রথম বা দ্বিতীয় ওভারে আউট হয়ে ফিরেছেন লিটন। তিন নম্বর ব্যাটসম্যানকে তাই ডাগআউটে ভালোভাবে বসার আগেই নেমে যেতে হয়েছে ব্যাটিংয়ে।
আজ অবশ্য তিন নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে লিটনই সেই পরিস্থিতির শিকার! প্রথম ওভারে সৌম্য সরকার আউট হলে তিন নম্বরে খেলা লিটনকেই ক্রিজে আসতে হয় প্রথম ওভারে। প্রথম ওভার করছিলেন শ্রীলঙ্কার ধনঞ্জয়া ডি সিলভা। লিটনের সামনে ডানহাতি পার্ট টাইম স্পিনার, সেটাও পাওয়ার প্লের মধ্যে।
লিটন আজ যেভাবে ব্যাটিং করেছেন, এটাকে টিপিকাল ওয়ানডে ইনিংস বলা যায়। ওয়ানডেতে ৯৪ স্ট্রাইক রেটে ব্যাটিং করলে সেটা ভালোই বলা হয় সাধারণত।
পাওয়ার প্লের সুযোগটা কি নেবেন তিনি? না, নেননি। বলতে পারেন, লক্ষ্য মাত্র ১২৬—লিটনের মাথায় এমন ভাবনা আসার কী আছে? আসলে পাল্টা আক্রমণের ভাবনা আসতেই পারে, কম রানের লক্ষ্যে শুরুতেই দ্রুত রান তুলে পাওয়ার প্লের মধ্যেই ম্যাচ নিজেদের দিকে হেলিয়ে ফেলার প্রবণতা এখন নতুন কিছু নয়। লিটন সে পথে হাঁটেননি। মুখোমুখি হওয়া প্রথম বলটা মিডউইকেট ঠেলে দিয়ে একটি রান নিলেন। এরপর তাঁর খেলা বাকি ৩৭টি বলেও দেখা গেছে এ রকম ধৈর্যশীল ব্যাটিংয়ের চিত্র, ক্রিজে টিকে থাকার চোয়ালবদ্ধ পণ।
স্পিনারদের বিপক্ষে এভাবেই মিডউইকেট, স্কয়ার লেগে ঠেলে এক-দুই রানের জন্য খেলেছেন। সাইড আর্ম অ্যাকশনের দুই শ্রীলঙ্কান পেসার নুয়ান তুষারা ও মাতিশা পাতিরানার বিপক্ষে বল ঠেলেছেন থার্ড ম্যানে। ইচ্ছা করেই সেটিকে মাটিতে রাখার চেষ্টা করেছেন। ফুল লেংথের বলে ড্রাইভ খেলেই প্রান্ত বদলের জন্য ছুটেছেন। ৩৮ বলের ইনিংসটিতে বাউন্ডারির জন্য খেলেছেন খুব কম বলই। লিটন তাঁর ইনিংসে চার মেরেছেন ২টি, ছক্কা একটি। দুটি চারের একটি পেয়েছেন তিকশানার বলে সুইপ খেলতে গিয়ে এজ হয়ে। তুষারার বলে কাভার দিয়ে একটি চার মেরেছেন। ছক্কাটি এসেছে পুল থেকে। পাতিরানার বলে ওই ছক্কাটিকেই বলা যায় ইনিংসে একমাত্র লিটনীয় শট।
লিটন আজ যেভাবে ব্যাটিং করেছেন, এটাকে টিপিকাল ওয়ানডে ইনিংস বলা যায়। ওয়ানডেতে ৯৪ স্ট্রাইক রেটে ব্যাটিং করলে সেটা ভালোই বলা হয় সাধারণত। তবে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তো ভুলেও এমন ইনিংস খেলা যায় না! এমন খেললে ‘টুকটুক’ ব্যাটিংয়ের জন্য রীতিমতো ট্রলে পরিণত হতে পারেন। তবে এটা সাধারণ ‘নিয়ম’। ব্যতিক্রমও আছে। কখনো কখনো তো এমনও হতে পারে ৯০-৯৫ স্ট্রাইক রেটের ইনিংসও টি-টোয়েন্টিতে অতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে!
এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদাহরণ বোধ হয় ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালে বেন স্টোকসের ৪৯ বলে ৫২ রানের ইনিংসটি। গত পরশু পাপুয়া নিউগিনির বিপক্ষে উগান্ডার রিয়াজাত আলী শাহ ৫৬ বলে ৩৩ রানের ইনিংস খেলেন। তাঁর ইনিংসেই ৭৮ রানের লক্ষ্য উগান্ডা টপকে গেছে ১০ বল হাতে রেখে। টেস্ট মেজাজের এই ইনিংসই হয়তো উগান্ডার ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ইনিংসের মর্যাদাই পেয়ে গেছে! লিটনের ইনিংসটি এই ধাঁচের ইনিংসের তালিকায় নতুন সংযোজন।
লিটন এর আগেও অনেক ম্যাচে দলের জয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন। তবে সেটা তখন তিনি করেছেন ভিন্নভাবে। এই যেমন ২০১৮ সালে নিদাহাস ট্রফিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২১৪ রান তাড়া করে জয়ের ম্যাচটি। সেদিন পাওয়ার প্লের মধ্যেই আউট হওয়ার আগে ১৯ বলে ৪৩ রানের ইনিংস খেলেছেন লিটন।
যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে ২০১৮ সালেই লিটনের আরেকটি ইনিংসের কথা বলা যেতে পারে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেই ম্যাচে ১১তম ওভারে আউট হওয়ার আগে ৩২ বলে ৬১ রান করেছিলেন লিটন। গত বছর আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেছেন চোখধাঁধানো ৪১ বলে ৮৩ রানের ইনিংস। আউট হয়েছিলেন ১২ ওভারের মধ্যেই। জয়–পরাজয়ের সমীকরণ যদি সরিয়ে রাখা হয়, সে ক্ষেত্রে গত টি-টোয়েন্টিতে ভারতের বিপক্ষে তাঁর ২৭ বলে ৬০ রানের ইনিংসটির কথা বলতে হবে। এই ইনিংসগুলোর একটা বিষয় কমন—লিটন ব্যাটিং করেছেন ২০০–এর আশপাশের স্ট্রাইক রেটে।
সেদিক থেকে লিটনের আজকের এই ইনিংসটি ‘স্পেশাল’। লিটন যে আজ দলের প্রয়োজনে, যেকোনো মূল্যে জয় ছিনিয়ে আনার জন্য নিজের ব্যাটিংয়ের ধরনই বদলে ফেলেছেন। যেকোনো খেলোয়াড়ের কাছেই দলের বা সমর্থকদের যেটা প্রত্যাশা থাকে। এমন একটি ইনিংস তিন বছরের আগেও একটি খেলেছেন লিটন। সেটি ২০২১ বিশ্বকাপে। শারজায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৪৩ বলে ৪৪ রানের ইনিংসে সেদিন অবশ্য বাংলাদেশকে জেতাতে পারেনি। বাংলাদেশ হেরেছিল ৩ রানে। তবে এবার লিটনের সেই আক্ষেপটা নেই।
নিজের জন্য নয়, খেলতে হবে দলের জন্য। মেটাতে হবে সময়ের প্রয়োজন, দলের প্রয়োজন—এই সব দাবি মেটানো একটি ইনিংসের পর আপনাদের কি লিটনের কাছ থেকে লিটনীয় ইনিংস দেখতে না পাওয়ার আক্ষেপ আছে!