চেন্নাই শহর মানেই শত বছরের পুরোনো আবহ। রাস্তায় বের হলেই শোনা যায় ইতিহাসের গুনগুন! দেয়ালে দেয়ালে পেইন্টিং, মোড়ে মোড়ে ভাস্কর্যে চিত্রার্পিত চেয়ে থাকে এই শহরের পূর্বপুরুষেরা। খেলার মানুষদের মনে এই শহরটা একটা বড় জায়গাজুড়ে আছে। চেন্নাই ক্রিকেটের নাকি দাবার—এ নিয়ে চেন্নাইবাসীর নাকি বেশ তর্কাতর্কি হয়। দুই পক্ষেরই অবশ্য শক্ত যুক্তি আছে। ভারতের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার, প্রথম আন্তর্জাতিক মাস্টার, প্রথম নারী গ্র্যান্ডমাস্টার কিংবা প্রথম আন্তর্জাতিক আরবিটার—সবই চেন্নাইয়ের। এখন পর্যন্ত ভারতের ৩৪ গ্র্যান্ডমাস্টারের ১২ জনই উঠে এসেছেন চেন্নাই থেকে।
আর ক্রিকেট? এখনকার এম এ চিদাম্বরম স্টেডিয়াম—আগের মাদ্রাজ ক্রিকেট ক্লাব গ্রাউন্ড—কলকাতার ইডেন গার্ডেনের পর ভারতের সবচেয়ে পুরোনো স্টেডিয়াম। ঐতিহাসিক অনেক কীর্তির সাক্ষীও। ভারত প্রথম টেস্ট জয়ের স্বাদ পায় এই মাঠে। ’৮৬–এর টাই টেস্ট, ’৯৯–এর ভারত-পাকিস্তান টেস্ট, আরও কত স্মরণীয় ম্যাচ হয়েছে এই স্টেডিয়ামে। সেখানেই আজ প্রথমবারের মতো টেস্ট খেলতে নামবে বাংলাদেশ দল। লক্ষ্য একটাই—নতুন ইতিহাস গড়া, ভারতকে প্রথমবারের মতো টেস্টে হারানোর ইতিহাস। সে জন্য চেন্নাইয়ের চেয়ে আদর্শ মঞ্চ আর হয় না।
বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে? একদমই নয়। এ মুহূর্তে এশিয়ার সেরা টেস্ট দলের তালিকা করলে ভারতের পরই বাংলাদেশের জায়গা করে নেওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট উজ্জ্বল। পাকিস্তানকে তাদের মাটিতে ২-০ ব্যবধানে হারানোর পর এ কথা বলাই যায়। হ্যাঁ, বাংলাদেশ বিদেশের মাটিতে খেলা ৬৭ টেস্টের মধ্যে জিতেছে মাত্র ৮টিতে। কিন্তু ৮টি জয়ের ৪টিই এসেছে ২০২১ সালের পর। শেষ ৮ টেস্টের মধ্যে ৫টিই জিতেছে বাংলাদেশ।
ভারতের মাটিতে এসে ভারতকে হারানো বিশ্ব ক্রিকেটের কঠিনতম চ্যালেঞ্জগুলোর একটি। ২০১২ সালের পর ঘরের মাঠে টানা ১৭টি সিরিজে অপরাজিত ভারত।
তবে ভারতের মাটিতে এসে ভারতকে হারানো বিশ্ব ক্রিকেটের কঠিনতম চ্যালেঞ্জগুলোর একটি। ২০১২ সালের পর ঘরের মাঠে টানা ১৭টি সিরিজে অপরাজিত ভারত। টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে ঘরের মাঠে এমন আধিপত্য এর আগে কোনো দলের ছিল না। এর আগের রেকর্ডটি অস্ট্রেলিয়ার, ঘরের মাঠে টানা ১০ সিরিজ জয়। কিন্তু এশিয়ার দ্বিতীয় সেরা দলের আলোচনায় যখন বাংলাদেশ এসেছে, কঠিনতম পরীক্ষার মুখোমুখি তো হতেই হবে!
বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক নাজমুল হোসেনের চোখেও ভারত বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে কঠিন প্রতিপক্ষ। তবে অধিনায়কের ভাবনাটা পুরোটাই বাংলাদেশকেন্দ্রিক, ‘প্রতিপক্ষকে নিয়ে বেশি চিন্তা না করে নিজেদের নিয়ে ভাবা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের কী শক্তি আছে, তা ভাবা উচিত। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের দলের ওই সামর্থ্য আছে এখানে ভালো খেলার। লক্ষ্য তো একটাই থাকে, আমরা প্রতিটি ম্যাচ জিতব। সে জন্য যা করণীয়, তা করব। ফল নিয়ে যদি বলেন, পঞ্চম দিনের শেষ সেশনে আমাদের ফল নিয়ে চিন্তা। তার আগপর্যন্ত নিজেদের শক্তি অনুযায়ী খেলার চেষ্টা করব।’
নাজমুলের নিজেদের শক্তিতে আস্থা রাখার কথাটার পেছনে একটা শক্ত যুক্তি আছে। প্রথমত, বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসের সেরা দলটাই এবার ভারত সফরে এসেছে। এ মুহূর্তে টেস্ট ক্রিকেটেরই সবচেয়ে ভারসাম্যপূর্ণ দল বাংলাদেশ। যেকোনো অধিনায়কেরই দুজন অলরাউন্ডার নিয়ে একাদশ সাজানোর স্বপ্ন থাকে। সাকিব আল হাসান ও মেহেদী হাসান মিরাজে সেই স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে নাজমুলের, দুজনই ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বিশ্বের সেরা স্পিনারদের ছোট্ট তালিকায় জায়গা করে নেবেন সহজেই।
আমি বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানাই পাকিস্তানে ওদের পারফরম্যান্সের জন্য। তবে এটা নতুন সিরিজ, নতুন প্রতিপক্ষ।গৌতম গম্ভীর, ভারতের প্রধান কোচ
যে দুজন বেঞ্চে বসে আছেন, সেই তাইজুল ইসলাম ও নাঈম হাসান অনেক দলেরই বিশেষজ্ঞ স্পিনার হতে পারেন। আর আপাত তরুণ পেস বোলিং বিভাগ অভিজ্ঞতায় পিছিয়ে থাকলেও দক্ষতায় নয়। তাসকিন আহমেদ, হাসান মাহমুদ, নাহিদ রানা, খালেদ আহমেদ—এই চারজন মিলে গড়েছেন বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসের সেরা বোলিং আক্রমণ। সমস্যা বলতে ছিল ব্যাটিং ধারবাহিকতা। পাকিস্তানে সেই সমস্যারও কিছুটা সমাধান হয়েছে বলেই মনে হয়।
ভারতের কোচ গৌতম গম্ভীর অবশ্য বাংলাদেশকে একটু সতর্কবার্তা দিয়ে রেখেছেন। পাকিস্তান জয় করে আসা দলটাকে তিনি অভিনন্দন জানিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু সতর্কও করেছেন, ‘আমি বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানাই পাকিস্তানে ওদের পারফরম্যান্সের জন্য। তবে এটা নতুন সিরিজ, নতুন প্রতিপক্ষ।’ রাহুল দ্রাবিড়ের জায়গায় প্রধান কোচের ভূমিকায় আসা গম্ভীরের প্রথম টেস্ট সিরিজ হতে যাচ্ছে এটি। আর শুরুটা কে না ভালো করতে চায়!