সিরিজের ট্রফি নিয়ে গতকাল ফটো সেশনে বাংলাদেশ অধিনায়ক নাজমুল হোসেন ও নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক টিম সাউদি
সিরিজের ট্রফি নিয়ে গতকাল ফটো সেশনে বাংলাদেশ অধিনায়ক নাজমুল হোসেন ও নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক টিম সাউদি

বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড টেস্ট

নির্বাচনের ডামাডোলেও বড় কিছুতে চোখ নাজমুলের

বিশ্বকাপের পর হওয়া প্রথম টেস্ট সিরিজ বরাবরই দুর্ভাগা। দুর্ভাগা এই কারণে যে খেলায় খুব বড় কিছু ঘটে না গেলে এ রকম সিরিজ নিয়ে বিশ্ব ক্রিকেটেই খুব একটা আগ্রহ থাকে না। বিশ্বকাপ রোমাঞ্চের জাবর কাটা তখনো চলতে থাকে, ওয়ানডের উত্তেজনার রেণু ভাসতে থাকে ক্রিকেটাবহে। টানা এক মাস রঙিন ক্রিকেটে ডুবে থাকার পর হেলেদুলে খেলা সাদা পোশাকের ক্রিকেটে চোখ ফেরাতে গিয়ে একটু ক্লান্তি, একটু আলস্য ও একটু অনীহা তো ভর করবেই।

এবার বিশ্বকাপের পর প্রথম টেস্ট সিরিজটা হচ্ছে বাংলাদেশে, সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে আজ শুরু সে সিরিজে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড। গত বছর মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে বাংলাদেশের অবিস্মরণীয় এক জয়ের পরও টেস্টে এই দুই দলের লড়াইটা এখনো অসম বলেই বিবেচিত। কিউইদের বিপক্ষে ১৭টি টেস্ট খেলে বাংলাদেশের ওই একটাই তো জয়! ১৩টিতেই হার।

সঙ্গে সদ্য সমাপ্ত বিশ্বকাপে হতাশ করা পারফরম্যান্স বিবেচনায় আনলে বাংলাদেশের মানুষের অভিমানে হলেও এই সিরিজ থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখার কথা। বাংলাদেশ আবার মাঠে নামছে বিশ্বকাপের পারফরম্যান্স নিয়ে সেই কাটাছেঁড়ার মধ্যে এবং নিউজিল্যান্ডের মতো দলের বিপক্ষে টেস্ট খেলতে, এ নিয়ে আগ্রহী জনতার সারি দীর্ঘ হবে কেন? বিশ্বকাপ–ব্যর্থতায় জনতার মঞ্চে বাংলাদেশের ক্রিকেট এখন হাতকড়া পরা আসামি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রলের মুখরোচক উপাদান। তারা যা–ই করে, সেটাই যেন সমালোচনার উপজীব্য।

গতকাল সংবাদ সম্মেলনে নাজমুল হোসেন

এর মধ্যেই আরেক ঘটনা। জাতীয় দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান মাগুরা-১ আসন থেকে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। বিশ্বকাপ–পরবর্তী বাংলাদেশের দ্বন্দ্বমুখর ক্রিকেটাবহে সেটি ভিন্নধর্মী আলোচনার জানালা খুলে দিয়েছে। দেশের তাবৎ ক্রিকেটীয় বিতর্ক এখন রাজনীতির মোড়কে ঢাকা। রান-বলের হিসাবের চেয়ে বেশি মনোযোগ ব্যালটের হিসাবের দিকে। মাঠ বলতে এখন সবাই বোঝে নির্বাচনের মাঠকে।

আর শুধু সাকিব কেন; বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান, তিনিও নির্বাচন করছেন কিশোরগঞ্জ-৬ আসন থেকে। এই যে আজ যেখানে টেস্ট সিরিজটা শুরু হচ্ছে, সেই সিলেট বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক, বিসিবির পরিচালক ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল মৌলভীবাজার-২ আসন থেকে ভোটপ্রার্থী। দেশের ক্রিকেটের চোখটাই যখন এভাবে নির্বাচনের দিকে ঘুরে যাচ্ছে, তখন এ দেশের রাজনীতিসচেতন মানুষের ভোট ফেলে টেস্ট ক্রিকেটের মতো রসকষহীন বিষয়ে মন না দেওয়াটাই স্বাভাবিক।

তবে হ্যাঁ, শুরুতে যেটা বলা হলো, ‘যদি বড় কিছু ঘটে যায়’—সিলেট, ঢাকা মিলিয়ে হতে যাওয়া বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড টেস্ট সিরিজও তখন ব্যানার হেডিং দাবি করবে। খেলাটার সঙ্গে সম্পৃক্ত যাঁরা নির্বাচনের দৌড়ে আছেন, তাঁদের পোস্টার-ব্যানারেও সেটি বাড়তি মাত্রা যোগ করবে নিশ্চিত। তা, সেই বড় কিছুটা আসলে কী?

গতকাল উইকেট দেখেছেন বাংলাদেশ কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে

দুই শব্দে উত্তর—বাংলাদেশের জয়। সিলেটে গতকাল সিরিজ–পূর্ব সংবাদ সম্মেলনে প্রথমবারের মতো টেস্ট দলের নেতৃত্ব পাওয়া নাজমুল হোসেন বেশ কয়েকবারই কথাটা বলায় মনে হলো, সেটি তিনি শুধু বলার জন্য বলছেন না। হয়তো ধ্বংসস্তূপ থেকে মাথা তুলে দাঁড়ানোর গোপন আত্মবিশ্বাস নাজমুলের মধ্যে ভর করেছে, যেটা তাঁকে ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ডকে টেস্টে হারানোর স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছে।

প্রতিপক্ষ সম্পর্কে ‘নিউজিল্যান্ড খুবই ভালো দল। টেস্টে অনেক চ্যালেঞ্জিং ও শক্তিশালী...’ বলার পর অধিনায়ক যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চাইলেন, কেন তাদের হারানো অসম্ভব নয়, ‘যেহেতু দেশের মাটিতে খেলা, স্পিন বা ব্যাটিং চিন্তা করলে আমরা অবশ্যই ভালো দল। পরিকল্পনা কাজে লাগাতে পারলে এই দলকে হারানো সম্ভব।’

এ রকম কথা যেকোনো সিরিজের আগে সব অধিনায়কই বলে থাকেন। তবে সেই বলাটা সীমাবদ্ধ থাকে সাধারণত ‘ভালো খেলা’ পর্যন্ত। জোর দিয়ে জয়ের লক্ষ্য ঘোষণা করে বাংলাদেশ খুব কম টেস্টই খেলতে নেমেছে। সাকিব, তামিম ইকবাল, লিটন দাসের মতো অভিজ্ঞরা না থাকা সত্ত্বেও অধিনায়ক নাজমুল এখানে ব্যতিক্রম। অবশ্য তাঁর কথাতে এটাও পরিষ্কার যে এই সিরিজ দিয়ে শুরু টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের নতুন চক্রে বাংলাদেশের লক্ষ্যটাও নতুন, ‘আমরা (নতুন চক্রে) প্রায় ১৪টি টেস্ট খেলব। এ বছর ২টি, পরের বছর আরও ১২টি। যে ম্যাচগুলো দেশের মাটিতে হবে, সেগুলো জেতা খুবই জরুরি। দল হিসেবে এটাই প্রথম লক্ষ্য। সঙ্গে চেষ্টা করতে হবে, দেশের বাইরেও কীভাবে ভালো খেলতে পারি।’

জয় তুলে নেওয়ার আত্মবিশ্বাস আছে অধিনায়ক নাজমুলের

বাংলাদেশ দলের বোলিং, ব্যাটিং–সামর্থ্য যা আছে, তা দিয়ে অন্তত দেশের মাটিতে টেস্ট জয় সম্ভব বলে বিশ্বাস নাজমুলের। নতুন চক্রে এই লক্ষ্য অর্জনই প্রাধান্য পাবে এবং সেটা যেকোনো দলের বিপক্ষে। সেই তির বাংলাদেশ প্রথম ছুড়তে চাইছে টিম সাউদির নিউজিল্যান্ডের দিকে, ‘যে দল, যে কম্বিনেশন, আমি খুবই আশাবাদী, এই দুই ম্যাচে আমরা খুবই ভালো করব। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারলে ভালো করার ভালো সম্ভাবনা আছে। দলের সবাই ম্যাচ দুটি জেতার পরিকল্পনা করেছে। আমরা বিশ্বাস করি যে আমরা জিততে পারি, জেতার জন্যই খেলব।’

বিশ্বকাপ ভরাডুবির পরও ঘরের মাঠের বাংলাদেশ নিয়ে নিউজিল্যান্ডের যা কিছু চিন্তা, সেটাও কিন্তু এ কারণেই। বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল খেলে আসা দলটার অধিনায়ক টিম সাউদি তা বলেও দিলেন, ‘টেস্ট খেলার জন্য এটা কঠিন জায়গা। এই কন্ডিশনে বাংলাদেশ শক্তিশালী’ বলে ভয়ের কথাটা জানিয়েও দিলেন তিনি।

পরশু সাকিবও নাকি ফোনে এই সাহসই দিতে চেয়েছেন নাজমুলকে—নিজেদের মাঠে নিজেরা যা পারো, তার ওপরই আস্থা রেখে খেলো। বাকি কথাগুলো সাকিব না বললেও নাজমুলের কথার প্রতিধ্বনি থেকে আপনিই তা জুড়ে দিতে পারেন,...তাহলেই সম্ভব বড় কিছু।