দৃশ্যটা বেশ মজার। তবে বাংলাদেশের সমর্থকদের জন্য প্রশান্তির। ওয়েস্ট ইন্ডিজ তখন ৫০ রানের মধ্যে ৬ উইকেট হারিয়ে ধুঁকছে। গ্যালারিতে ক্যারিবিয়ান সমর্থকেরা ঘুমোচ্ছে! সবাই নয়, একজনের বেঘোর ঘুমে ক্যামেরা ধরা হয়েছিল। বেচারার আর কী দোষ! বাংলাদেশের ১২৯ রানের পিছু ছুটতে নেমে অর্ধেক পথ পেরোনোর আগেই নাকানি-চুবানি খেয়ে রানরেট পাঁচের নিচে নেমে এলে চোখ দুটোও তো টেস্ট ম্যাচ ভেবে বিশ্বাসঘাতকতা করবে!
বাংলাদেশের সমর্থকদের জন্য তা মোটেও নয়। শীতের ভোরে বিছানার সঙ্গে আয়েশি সম্পর্ক চুকিয়ে স্ক্রিনের সামনে যাঁরা বসেছিলেন, ম্যাচ যত এগিয়েছে চোখ দুটো যেন আরও সজাগ হয়েছে। এই জিনিস যে প্রতিদিন দেখা যায় না! একে তো পুঁজিটা স্বল্প, তারওপর পূর্ণ শক্তির ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ঘুমটা তাই বাংলাদেশের সমর্থকদের চোখেই নামার কথা ছিল। কিন্তু তাসকিন-তানজিমদের শরীরী ভাষায় সেই ঘুম কোথায় উবে গেল কে জানে, ২৭ রানের জয়ের পর জেগে থাকা চোখগুলোই হয়ে উঠল আনন্দের ফল্গুধারা। কিছুটা অবিশ্বাসও। এটা ওয়েস্ট ইন্ডিজের ঘরের মাঠ না বাংলাদেশের!
কাগজে-কলমে ওটা ভিনদেশ সেন্ট ভিনসেন্ট, আর্নস ভেল গ্রাউন্ড। তবে অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশের হাতের তালুর মতো চেনা বলতে পারেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংসে ১০ ওভার পরই ধারাভাষ্যকারেরা বলছিলেন, এই মাঠে অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশ দলই এগিয়ে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বর্তমান দলটির এক জনসন চার্লসেরই এখানে যা একটু খেলার অভিজ্ঞতা আছে। কেন? শুনুন তাহলে—
আর্নস ভেলেতে এই ম্যাচসহ টি-টোয়েন্টি হলো মোট ৯টি। আজসহ ৫টিতেই খেলেছে বাংলাদেশ। জিতেছে ৪টি। সবগুলোতেই আগে ব্যাট করে, ৩টিতে ১৫০ এর নিচে স্কোর করে। এমনকি গত জুনে নেপালের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ১০৬ রান করেও জিতেছে! সেই ম্যাচে বোলারদের লাইন-লেংথ ও শরীরী ভাষা মনে থাকলে আজ সেসব দৃশ্যের মিল পড়তে বাধ্য।
জয়ের জন্য মাত্র সাড়ে ৬ রান রেটের লক্ষ্য দিয়ে পাওয়েল-পুরানদের বাউন্সারে চোখ রাঙিয়েছেন তাসকিন-তানজিমরা। উইকেটও পেয়েছেন। একদম মাপা কম্পাসের লাইন-লেংথে। জানবাজি রেখেছেন ফিল্ডাররা। ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে পাওয়েলের ক্যাচটা যেভাবে নিলেন মিরাজ! কিংবা সপ্তম উইকেটে আকিল হোসেন-রোস্টন চেজের জুটিটি যখন চোখ রাঙিয়ে উঠল তখন কাভারে ডাইভ দিয়ে শামীমের চার বাঁচানো, সীমানায় সবার ঝাঁপিয়ে পড়া, বলুন তো এমন বাংলাদেশকে শেষ কবে দেখেছেন? এ অবশ্যই প্রতিদিন দেখার জিনিস নয়!
যেমনটা নয়, সম্পূর্ণ দলীয় চেষ্টায় তুলে আনা হিরণ্ময় এই জয়টাও। যে জয়ে ২০১৮ সালের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথম টি-টোয়েন্টি সিরিজও জিতল বাংলাদেশ। তবে কথাটায় একটু ভুল আছে। ৬ বছর আগের সেই সিরিজে সেন্ট কিটসে প্রথম ম্যাচটি খেলে পরের দুটি ম্যাচ ফ্লোরিডায় খেলেছিল বাংলাদেশ। এদিক বিচারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে এটাই প্রথম টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয় বাংলাদেশের। তাতে ব্যাপারটা আরেকটু মিষ্টি হলো এই যা!
তবে শুরুতে কিন্তু হালকা টকের আভাস ছিল। প্রথম দুই ওভারে ১৯ রান দিয়ে ফেলেছিলেন হাসান মাহমুদ ও মেহেদী হাসান। তখন হয়তো মনে হতে পারে, নাহ, খেলা দেখার চেয়ে ঘুমের বকেয়া মেটানো উত্তম। সেই মনে করায় যখন উঠি উঠি করছেন, তখন তৃতীয় ওভারে তাসকিন আহমেদ এলেন সরিষার তেল হাতে। নিখুঁত দুটো লেংথ ডেলিভারিতে ৫ বলের মধ্যে তুললেন ব্রেন্ডন কিং ও আন্দ্রে ফ্লেচারকে। পরে নিজের দুটি ওভারে মেহেদী ফেরালেন চার্লস ও পুরানকে। পাওয়ার প্লের ৬ ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৪ উইকেটে ৩২ হয়ে যাওয়ার পর ঘুম শব্দটা ক্রিকেটপ্রেমীদের অভিধান থেকে উবে যাওয়ার কথা!
সেটা নিষেধাজ্ঞায় পরিণত হওয়ার কথা যখন, ৮ম ও ৯ম ওভারে গেল উইকেট মেডেন! হাসান ৮ম ওভারে তুললেন পাওয়েলকে। তানজিম ৯ম ওভারে বাউন্সারে ফেরালেন শেফার্ডকে। টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের বোলারদের এমন সংহারী কিপটে ভূমিকায় কখনো দেখা গেছে কি না, তা অবশ্যই গবেষণার বিষয়।
গবেষণার আরেকটি বিষয় হতে পারে, ডেথ ওভারে রিশাদ কীভাবে মাথা ঠান্ডা রাখেন। চেজ-আকিলের জুটিটি ৪৯ বলে ৪৭ তুলে যখন হৃদয়বিদারক কিছু করার হুমকি ছড়াচ্ছিল, রিশাদ তখন ১৭তম ওভারে এসে কি না হালকা গর্জে ওঠা ক্যারিবিয়ান গ্যালারির রসভঙ্গ করলেন! দুই বলে ফেরালেন চেজ ও গুড়াকেশ মোতিকে। ম্যাচের বাকি পথটা আর না বললেও চলে। ওটুকু স্রেফ অনুভবের। প্রতিপক্ষের মাঠে মাস্তানি দেখিয়ে জয় তুলে নেওয়ার হিরণ্ময় এক নজির। আবেগেরে চোরাস্রোত বেয়ে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের অমন রূপে দেখার বর্ণনা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। না করাই ভালো। অনুভবের আবার ভাষা হয় নাকি!
ভাষা কিন্তু হারিয়েছিল টস হেরে ব্যাটিংয়ে নামা বাংলাদেশের ইনিংসেও। রান পেতে মরিয়া বাংলাদেশ অধিনায়ক লিটন দাস যখন তিন থেকে ওপেনে নামলেন, যথারীতি আকিলের স্পিন ফাঁসে হাঁসফাঁস করে মুক্তি পেতে বোকা-বিদ্রোহীর ভূমিকা নিয়ে ক্রিজে ছেড়ে বেরিয়ে স্টাম্পড! এ যাত্রায় ১০ বলে ৩। ১৮ বলে ১১ করে নিজের রীতিবিরুদ্ধ ব্যাটিংয়ে সৌম্য সরকার হলেন রানআউট। তানজিদ হাফ ভলিকে পিথাগোরাসের উপপাদ্যের মতো কঠিন বানিয়ে ২ রানে বোল্ড। পাওয়ার প্লেতে উঠল ২ উইকেটে মাত্র ২৯!
মিরাজ ২৫ বলে ২৬ তুলে কিছুটা চেষ্টা করলেন। জাকের করলেন ২০ বলে ২১। কিন্তু বোলারদের সাহস এনে দেওয়ার পুঁজিটুকু দিলেন প্রায় এক বছর পর জাতীয় দলে ফিরে আটে নেমে ম্যাচসেরা শামীম। ২ ছক্কা, ২ চারে ১৭ বলে ৩৫ রানের এক অক্সিজেনসুলভ ইনিংস তাঁর। তাতে ৮ম উইকেটে তানজিমের সঙ্গে ২৩ বলে ৪১ রানের জুটিটা হয়ে উঠল শেষ দিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ম্যাচ থেকে মানসিকভাবে ছিটকে পড়ার শিরোনাম।
বাকিটা আপনি হয়তো দেখেছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের শেষ দুই ব্যাটসম্যান অলআউট হয়ে মাঠ ছাড়ার সময় ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গিয়েছিলে আর্নস ভেলের গ্যালারি। বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য আপনভূমিতে পরিচিত দৃশ্য। প্রতিপক্ষের কাছে নাকানি-চুবানি খেয়ে কতবার যে এভাবে চুপসে যেতে হয়েছে! এবার সেটাই তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করার উষ্ণ লগ্ন হয়ে এল শীতের সকাল থেকে আসি দুপুরে।
ম্যাচ শেষে অধিনায়ক লিটনের কথায়ও সেই উষ্ণতা ঝরল, ‘আমি খুব খুব খুশি। শুধু আমি নই, বাংলাদেশের সবাই খুশি এমন একটা জয়ের জন্য।’ শামীমসহ রান করা বাকি ব্যাটসম্যানদের ধন্যবাদ দিয়ে লিটন আসল কথাটা বললেন শেষে, ‘সব কৃতিত্ব বোলারদের।’ তবে সৌম্যর চোট সেই উঞ্চতায় শীতল দুঃখ হয়ে এসেছে।
ওয়ানডে সিরিজে ধবলধোলাই হতে হয়েছে। সামনে তা ফিরিয়ে দেওয়ার পালা। আগামী শুক্রবার শুভদিন দেখে বাংলাদেশ দল তা করতে পারলে শুধু সেদিন নয়, গোটা শীতকালটাই তো ভেজা ভেজা নরম মনে গরম-গরম লাগার কথা! আপনাকে নিমন্ত্রণ।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ: ২০ ওভারে ১২৯/৭ (শামীম ৩৫*, মিরাজ ২৬, জাকের ২১, সৌম্য ১১, মেহেদী ১১, তানজিম ৯; মোতি ২/২৫, আকিল ১/১৬, আলজারি ১/২১, ম্যাকয় ১/৩২, চেজ ১/৮)।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ: ১৮.৩ ওভারে ১০২ (চেজ ৩২, আকিল ৩১, চার্লস ১৪, কিং ৮,পাওয়েল ৬, পুরান ৫; তাসকিন ৩/১৬,রিশাদ ২/১২, মেহেদী ২/২০, তানজিম ২/২২, হাসান ১/২৩)।
ফল: বাংলাদেশ ২৭ রানে জয়ী।
ম্যাচসেরা: শামীম হোসেন (বাংলাদেশ)
সিরিজ: তিন ম্যাচ সিরিজে বাংলাদেশ ২-০ তে এগিয়ে।