ছবিটি ২০২৪ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ–আফগানিস্তান ম্যাচের। তখন কে জানত পরে এ ম্যাচটিকেই নিজের সর্বশেষ টি–টোয়েন্টি বলে ঘোষণা দেবেন সাকিব আল হাসান!
ছবিটি ২০২৪ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ–আফগানিস্তান ম্যাচের। তখন কে জানত পরে এ ম্যাচটিকেই নিজের সর্বশেষ টি–টোয়েন্টি বলে ঘোষণা দেবেন সাকিব আল হাসান!

সাকিবে নিভে গেল শেষ দেউটিও

‘একে একে শুখাইছে ফুল...নিবিছে দেউটি।’

মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘প্রথম সর্গ’ কবিতার লাইন। বিভিন্ন প্রসঙ্গে ও আঙ্গিকে লাইনটি বহুল ব্যবহৃত। এই লেখারও উদ্দেশ্য একই। চাইলে কবিতার নামের সঙ্গেও ব্যাপারটি মিলিয়ে ফেলা যায়। দেশের প্রথম টি–টোয়েন্টিকে যদি ‘প্রথম সর্গ’ ভেবে নেওয়ার কল্পনাশক্তি থাকে, তবে সেই প্রথম সর্গের সব ‘ফুল’ই একে একে শুকিয়ে ঝরে পড়েছে। ‘নিবিছে’ সব দেউটিও।

প্রশ্ন হলো, হঠাৎ এ প্রসঙ্গ কেন আর কেনই–বা অন্য কোনো প্রসঙ্গে লেখা মধুকবির কবিতাকে টেনে এনে দেশের প্রথম টি–টোয়েন্টির সঙ্গে মেলানো? আসলে বিরহ দহন মুহূর্তে গদ্য নয়, পদ্যের রসই তো অনুভূতিগুলো বেশি করে জাগিয়ে তোলে। গত পরশু কানপুরে সংবাদ সম্মেলনে সাকিব আল হাসানের টি–টোয়েন্টি থেকে অবসর ঘোষণা করার সেই মুহূর্ত অনেক ভক্তের জন্যই ভেতরে ভেতরে পোড়ার শুরুও।

সাকিব বলেছেন, পরবর্তী সময়ে বিসিবি চাইলে দলের প্রয়োজনে তিনি ফিরতেও রাজি আছেন। কিন্তু সেই পরবর্তী সময় কবে আসবে কিংবা আদৌ আসবে কি না অথবা সেই ফেরাটা বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য ভালো হবে কি না—৩৭ বছর বয়সী সাকিবকে সামনে রেখে এর সবকিছুই প্রশ্নবিদ্ধ। আর অবসরের ঘোষণা যেহেতু দিয়েছেন, তাই এখন বলাই যায়, দেশের হয়ে প্রথম টি–টোয়েন্টিতে খেলা ক্রিকেটারদের মধ্যে শেষ ‘দেউটি’ও নিভে গেল। কিংবা শুকিয়ে গেল শেষ ফুলটিও!

সাকিবের অবসর ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম টি–টোয়েন্টি খেলা সেই দলটির সবাই ‘অতীত’ হয়ে গেলেন।

১৮ বছর এখনো পুরো হয়নি। দিনপঞ্জির হিসাবে ১৮ বছর হতে এক মাসও নেই। আজ যেহেতু ২৯ সেপ্টেম্বর আর ২০০৬ সালে সেই ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২৮ অক্টোবর। কোন ম্যাচ? এ প্রশ্নে কেউ কেউ নারাজও হতে পারেন। বাংলাদেশ ক্রিকেটে এমন কিছু ভক্তও আছেন, যাঁদের কোন ম্যাচ কবে অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেসব দিন–তারিখও মুখস্থ। তাই শুধু এটুকু বলা ভালো, বাংলাদেশ দলের প্রথম আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টি ম্যাচ। ভেন্যু খুলনা, প্রতিপক্ষ ছিল জিম্বাবুয়ে এবং বাংলাদেশ ৪৩ রানে জিতেছিল। মনে আছে নিশ্চয়ই?

তাহলে সাকিব অবসরের ঘোষণা দেওয়ার পর নিশ্চয়ই এটাও মনে হয়েছে, প্রথম টি–টোয়েন্টি খেলা সেই দলটির আর কেউ কি অবশিষ্ট রইলেন? মানে, আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টি সংস্করণে খেলে চলা এমন কেউ? না, রইলেন না। সাকিবই সর্বশেষ। সাকিবের অবসর ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম টি–টোয়েন্টি খেলা সেই দলটির সবাই ‘অতীত’ হয়ে গেলেন। মানে সেই দলটির আর কেউ এই সংস্করণে রইলেন না। সবগুলো ‘বাতি’ই নিভে গেল।

আফতাব আহমেদ ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম টি–টোয়েন্টির একাদশে

সেই দলের ‘ওরা ১১ জন’–এর মধ্যে পরবর্তী সময়ে তারকা কিংবা ভারী নাম হয়ে উঠেছেন ৮ জন—শাহরিয়ার নাফীস, আফতাব আহমেদ, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, মাশরাফি বিন মুর্তজা, আবদুর রাজ্জাক, মোহাম্মদ রফিক ও শাহাদাত হোসেন। বাকিদের মধ্যে ফরহাদ রেজা সম্ভাবনাময় পেস বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে প্রতিশ্রুতি দেখালেও শেষ পর্যন্ত প্রতিদান দিতে পেরেছেন সামান্যই।

তাঁর ১৩ ম্যাচের টি–টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে শেষ ম্যাচ ২০১৪ সালে। নাজমুস সাদাত ও নাদিফ চৌধুরী আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বেশিদিন টিকতে পারেননি। ওপেনার নাজমুস সাদাতের ওটাই একমাত্র আন্তর্জাতিক ম্যাচ। জোরে মারতে পারেন, এমন খ্যাতি নিয়ে জাতীয় দলে আসা নাদিফ চৌধুরী খেলেছেন মাত্র তিনটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ, সবগুলোই টি–টোয়েন্টি সংস্করণে।

কিন্তু যে আটজনের কথা বলা হলো তাঁদের ক্যারিয়ার দীর্ঘ হয়েছে এবং কে কবে অবসর নিয়েছেন কিংবা জাতীয় দলের বাইরে ছিটকে যাওয়ার পর আর ফিরতে পারেননি, তা মোটামুটি সবারই জানা। আলাদা করে তাই তাঁদের কারও কারও অবসরের দিন–তারিখ উল্লেখ না করলেও চলে। কারণ, ঘোষণা দিয়ে অবসর নেওয়ার সৌভাগ্যও সবার হয়নি।

বাংলাদেশের প্রথম টি–টোয়েন্টিতে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শাহরিয়ার নাফীস

বাংলাদেশের সেই প্রথম টি–টোয়েন্টি দলের অধিনায়ক ৩৯ বছর বয়সী শাহরিয়ার নাফীস যেমন এখন বিসিবির ক্রিকেট অপারেশনস ইনচার্জ। ওই একটি টি–টোয়েন্টিই খেলেছেন দেশের হয়ে ২০১১ সালে সর্বশেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা নাফীস। আফতাব আহমেদ ১১টি টি–টোয়েন্টি খেলেছেন, শেষটি ২০১০ সালে। খেলা ছেড়ে দেশে কিছুদিন কোচিং করিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আফতাব বাকি দুই সংস্করণেও দেশের হয়ে সর্বশেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন ২০১০ সালে।

ওয়ানডে ও টেস্ট খেলে চলা মুশফিকুর রহিম টি–টোয়েন্টি থেকে অবসর নেন ২০২২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে। বাংলাদেশের হয়ে যে তিন ক্রিকেটার এক শ বা এর বেশি টি–টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন, মুশফিক তাঁদের একজন (১০২)। এই সংস্করণে তাঁর শেষ ম্যাচটি ২০২২ সালের ১ সেপ্টেম্বর দুবাইয়ে এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। ৫৪টি টি–টোয়েন্টি খেলা মাশরাফি দেশের হয়ে এই সংস্করণে সর্বশেষ ম্যাচ খেলেছেন ২০১৭ সালের ৬ এপ্রিল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। দ্বিতীয় টি–টোয়েন্টিতে টসের সময় তিনি জানিয়ে দেন, পরের ম্যাচটিই টি–টোয়েন্টিতে তাঁর শেষ।

পরিসংখ্যানের কচকচানি থেকে একটু শ্রান্তি দিতে এবার একটি কুইজের প্রশ্ন। বাংলাদেশের ক্রিকেটে স্পিন-কিংবদন্তি মর্যাদা পাওয়া ওই ক্রিকেটারের নাম বলুন তো, যিনি টি–টোয়েন্টি সংস্করণে মাত্র একটি ম্যাচ খেলেছেন। সেটি ব্যাটিংয়ে ‘ছক্কা রফিক’ খ্যাতি পাওয়ার পরও! ঠিকই ধরেছেন, ২০০৮ সালে বাংলাদেশের হয়ে সর্বশেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা রফিক দেশের হয়ে একটি টি–টোয়েন্টি ম্যাচই খেলেছেন, সেটা ওই প্রথম ম্যাচটি।

ক্যারিয়ারে একটিই আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টি খেলেছিলেন মোহাম্মদ রফিক, যা ছিল বাংলাদেশ দলের প্রথম

তখন তাঁর বয়সও সম্ভবত বাধা ছিল—৩৬ বছর বয়স তখন আর যা–ই হোক টি–টোয়েন্টির জন্য মানানসই ছিল না। পরে না হয় বেশি বয়সেও অনেকেই টি–টোয়েন্টিতে ভালো করেছেন। কিন্তু সেই সময় বাংলাদেশ ক্রিকেটের আসি আসি দিনগুলোতে টি–টোয়েন্টিকে অপেক্ষাকৃত তরুণদের খেলাই মনে করা হতো।

বিসিবিতে এখন নির্বাচকের দায়িত্ব পালন করা সাবেক বাঁহাতি স্পিনার রাজ্জাক ৩৪টি টি–টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন বাংলাদেশের হয়ে। সর্বশেষ ম্যাচটি ২০১৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। সাবেক পেসার শাহাদাত খেলেছেন ৬টি টি–টোয়েন্টি ম্যাচ, সর্বশেষটি ২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে।

আগাম ঘোষণা ছাড়াই থেমেছে সাকিবের টি–টোয়েন্টি ক্যারিয়ার

এবার সেই আটজনের মধ্যে যিনি বাকি রইলেন, দেশের হয়ে তাঁর টি–টোয়েন্টি ম্যাচ সংখ্যা ১২৯টি। এই সংস্করণে সর্বোচ্চ ২৫৫১ রান করেছেন দেশের হয়ে। তাঁর শিকার করা ১৪৯ উইকেট আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টিতে তৃতীয় সর্বোচ্চ। শুধু কি তা–ই, এই সংস্করণে আর কারও তাঁর মতো ২ হাজার রান ও ১০০ উইকেটে ‘ডাবল’ নেই। আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টিতে সবচেয়ে দীর্ঘ ক্যারিয়ারও তাঁর। নামটা হয়তো অনুমানই করে ফেলেছেন।

হ্যাঁ, সাকিব আল হাসান!