ধর্মশালার অন্য রূপ এবং মিডিয়াবিরূপ বিসিবি

‘সেবনের আগে ও পরে’ শিরোনামে ওষুধের বিজ্ঞাপন একসময় খুব জনপ্রিয় ছিল। ধর্মশালাও এখন আমার কাছে পরিষ্কার দুটি ভাগ। ২০২৩ বিশ্বকাপের আগে ও পরে। এই বিশ্বকাপে আসার আগে ধর্মশালার কথা উঠলেই শরীরে যে কাঁপুনির অনুভূতিটা হতো, ফেরার পর আর তা হবে না।

হাড়কাঁপানো শীত বলতে কী বোঝায়, তা আরও অনেক দেশে গিয়েই টের পেয়েছি। সবার আগে আসবে ইংল্যান্ড আর নিউজিল্যান্ডের নাম। ধর্মশালাও এত দিন এর পাশেই ছিল। প্রায় সাত বছর আগে এখানে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ কাভার করতে এসে যে টের পেয়েছিলাম, শীত কাহাকে বলে ও উহা কত প্রকার।

প্রকারভেদটা করতে হচ্ছে প্রতিটা দিন শীতের তীব্রতা সমান ছিল না বলে। ‘প্রকার’ বলতে গিয়ে একটা রাতের কথা বিশেষভাবে মনে হচ্ছে। সম্ভবত তামিম ইকবালের ব্যাটে বাংলাদেশের পক্ষে টি-টোয়েন্টিতে প্রথম সেঞ্চুরির সেই রাত। সকাল থেকেই ঠান্ডা ছিল। সন্ধ্যার পর বৃষ্টি হওয়ায় ঝুপ করে তাপমাত্রা নেমে গিয়েছিল ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। আমার মনে হচ্ছিল, কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। তাপমাত্রা নির্ঘাত শূন্য ডিগ্রিরও বেশ নিচে। নইলে রুমে হিটার চলছে, গায়ে সোয়েটার, তারপরও বিছানায় কম্বলের নিচে গিয়ে দাঁতে দাঁতে ঠকঠক বাড়ি খাচ্ছি কেন!

ধর্মশালা হিমাচল প্রদেশ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের প্রকৃতি

এবার তাই আমি একটু বেশিই সাবধানী ছিলাম। অগ্রগামী সাংবাদিকদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যও আশ্বস্ত করতে পারেনি বলে স্যুটকেস ভরে শীতের কাপড় নিয়ে এসেছি। আসার পর বুঝতে পারছি, অকারণেই লাগেজ ভারী করেছি। সাত বছর আগের সেই স্মৃতি এতটা ভয় পাইয়ে না দিলে ডোমেস্টিক ফ্লাইটে লাগেজের বাড়তি ওজনের জন্য গুচ্ছের টাকা খরচ করতে হতো না।

সন্ধ্যার পর আরাম-আরাম শীত আছে। তবে দিনের বেলা বেশ গরম। অক্টোবর আর মার্চের পার্থক্যটা আমার বোঝা উচিত ছিল। ঢাকার গরমের তুলনায় অবশ্য ধর্মশালার গরম কিছুই নয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক ওপরে বলেই হয়তো রোদে গা পুড়ে গেলেও শরীর ঘামে না।

ঋতুর ভিন্নতার কারণে সেবার আর এবারে বড় আরেকটা পার্থক্যও দেখতে পাচ্ছি। আগেরবার স্টেডিয়ামের পেছনে পাহাড় দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। সব বরফে ঢাকা। রোদ পড়ে তা দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার রং বদলায়। এবার বরফ নেই বলে পাহাড়গুলোকে কেমন রুক্ষ-রুক্ষ লাগছে।

সংবাদ সম্মেলনে এসেছিলেন বাংলাদেশ দলের স্পিন বোলিং কোচ রঙ্গনা হেরাথ

যেমন রুক্ষ লাগছে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের প্রতি বিসিবির আচরণ। বিশ্বকাপে বিসিবি কোত্থেকে এল, এই প্রশ্ন করবেন না যেন। বাংলাদেশ দল তো বিসিবির নির্দেশমতোই চলে। এই বিশ্বকাপে বাকি সব দলের চেয়ে ব্যতিক্রম হয়ে বাংলাদেশ দল যে দেশ থেকে আসা সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের সঙ্গে চরম অসহযোগিতা করছে, এর দায়ভারও শেষ পর্যন্ত তাই বিসিবির ওপরই বর্তায়। সেই অসহযোগিতা কেমন? একটা উদাহরণেই তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। বিশ্বকাপে প্রতিটি ম্যাচের আগে সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়কেরা আসছেন। ক্রিকেটে এটাই রীতি। কিন্তু অন্য দলগুলো এই রীতি মেনে চললেও বাংলাদেশ দলের তাতে থোড়াই কেয়ার। অধিনায়ক দূরে থাক, ম্যাচের আগের দিন কোনো ক্রিকেটারও আসছেন না সংবাদ সম্মেলনে। আইসিসির নিয়ম অনুযায়ী যেহেতু কাউকে না পাঠালেই নয়, কোচিং স্টাফ দিয়েই সেরে ফেলা হচ্ছে সেই বাধ্যবাধকতা। আফগানিস্তান ম্যাচের আগে এসেছেন হেড কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এত বড় ম্যাচ, অথচ সেই ম্যাচের আগে কিনা সংবাদ সম্মেলনে স্পিন বোলিং কোচ রঙ্গনা হেরাথ! দেখে এমন মেজাজ খারাপ হলো যে, কী বলব!

যাঁদের জন্য আমরা এখানে এসেছি, দেশের সেই পাঠক-দর্শক কি হেরাথের কথা শুনতে চায়, না অধিনায়কের কথা? এটাই অবশ্য ক্ষুব্ধ হওয়ার একমাত্র কারণ নয়। একটু আগেই যে দেখেছি, ইংল্যান্ড দল তাদের দেশের মিডিয়াকে সাহায্য করতে কী না করছে! অধিনায়ক জস বাটলার সংবাদ সম্মেলন তো করেছেনই, এরপর শুধু ব্রিটিশ মিডিয়ার জন্য আলাদা একটা সেশনও হয়েছে। ম্যাচের আগের দিন আর পরের দিনই শুধু নয়, অন্য দিনগুলোতেও কোনো না কোনো ক্রিকেটারকে পাঠানো হচ্ছে মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলার জন্য। গত পরশুই যেমন জনি বেয়ারস্টোর সংবাদ সম্মেলন হয়েছে। 'অনলি ইউকে মিডিয়া' ঘোষণা দিয়ে যেটিতে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের ঢুকতেই দেওয়া হয়নি।

সংবাদ সম্মেলনে এখনো সাকিব আল হাসানের দেখা মেলেনি

ইংল্যান্ড দল তাদের মিডিয়ার জন্য এমন করছে, কারণ মিডিয়ার কাজটা তারা বোঝে। ইংল্যান্ডের চেয়ে বাংলাদেশের সাংবাদিক এখানে চার–পাঁচ গুণ বেশি। তাঁদের প্রতি বিসিবির যেন কোনো দায়িত্ব নেই। ভেবে দেখলাম, ওই সংখ্যাই হয়তো সমস্যা করেছে। ইংল্যান্ডে মিডিয়া কাভারেজ পেতে ক্রিকেটকে অন্য খেলার সঙ্গে লড়াই করতে হয়। বাংলাদেশে যেখানে ক্রিকেটের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীই নেই। বিসিবি তো জানেই, যা খুশি করলেও বাংলাদেশের পত্রিকা-টেলিভিশন আর ওয়েবসাইট ক্রিকেট নিয়েই মেতে থাকবে।

দোষটা আসলে আমাদেরই!