জিম শেষ করে রুম গিয়েছিলেন। রুমে অনেকটা সময় বিশ্রাম নিয়ে নামলেন সিনামন হোটেলের লবিতে। কিন্তু লবি তো নয়, যেন প্র্যাকটিস উইকেট! আর সাকিব আল হাসান সেখানে এসেছেন ব্যাটিং প্র্যাকটিস করতে।
সেই ব্যাটিংও আবার এলোপাতাড়ি, শেষ ৫ ওভারে ৬০–৭০ রান লাগে, এ রকম একটা ধুন্ধুমার পরিস্থিতিতে। সামনে যে বলই আসুক, হুক–পুল ছাড়া কথা নেই। বল কোথায় গেল, কার গায়ে লাগল, দেখার সময় নেই। পরের বলে চোখ এবং আবারও উড়িয়ে মারার চেষ্টা।
বোলার কারা, সেটাও এবার বলে দিই—বাংলাদেশ ও ভারত থেকে কলম্বোতে এশিয়া কাপ কাভার করতে আসা কয়েকজন সাংবাদিক। আগামীকালের ভারত ম্যাচকে সামনে রেখে সাকিব আজ সংবাদ সম্মেলনে কী কী বলেছেন, সেটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে মোটামুটি জেনে গেছেন। মূল বক্তব্য—আনুষ্ঠানিকতা রক্ষার ম্যাচ হলেও এই ম্যাচে ভারতকে হারাতে চায় বাংলাদেশ। সাকিবের কথায়, ‘যদি শেষ ম্যাচও জিতে দেশে যেতে পারি অবশ্যই আমাদের জন্য ভালো দিক হবে। এই ম্যাচ থেকে অন্য কিছু চাই না। এই ম্যাচ থেকে শুধু জিততেই চাই।’
এটাই তো স্পিরিট হওয়া উচিত। খেলায় আবার আনুষ্ঠানিকতা রক্ষা কী! হয় জিত, না হয় হার। সব কিছুর একটা ভবিষ্যৎ পরিণতি থাকতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। আপনি এই মুহূর্তে একটা বড় কিছু করে সঙ্গে সঙ্গে সেটা উদ্যাপন করে পরক্ষণেই আবার তা ভুলে যেতে পারেন। কিন্তু ভুলে গেলেও ভবিষ্যতে কোথাও না কোথাও এই সাফল্য আপনাকে বাড়তি শক্তি জোগাবে। কাজেই ভারতকে হারালে বাংলাদেশ এশিয়া কাপের ফাইনালে যাবে না ঠিক আছে, কিন্তু তাতে যে টনিকটা পাওয়া যাবে, সেটারও একটা মূল্য থাকবে।
তো এমন ম্যাচের আগের দিনে বাংলাদেশ দল আজ অনুশীলনই করেনি। সাকিব হয়তো সে কারণেই ভাবলেন, হোটেল লবিতে ভিড় করা সাংবাদিকদের নেট বোলার বানিয়ে সেখানেই ‘ব্যাটিং প্র্যাকটিস’টা সেরে নেবেন।
প্রথম প্রশ্নেই প্রশ্নকর্তাকে দুই বাক্য বলার পর থামিয়ে দিয়ে সাকিবের পাল্টা প্রশ্ন, ‘প্রশ্নটা কালকের ভারত ম্যাচ নিয়েই তো?’ প্রশ্ন কর্তা ‘হ্যাঁ’ বলে বাকি প্রশ্ন শেষ করলেন, যার মূল বক্তব্য, দ্বিপক্ষীয় সিরিজে বাংলাদেশ তো বিভিন্ন সময়ে ভারতকে হারিয়েছে। কিন্তু কালকের ম্যাচটা হচ্ছে একটা টুর্নামেন্টের আবহে। সাকিবই যেহেতু শ্রীলঙ্কার কাছে হারের পর বলেছিলেন, বাংলাদেশ বড় টুর্নামেন্টে ভালো খেলে না, এখন এশিয়া কাপের ভারত ম্যাচটাকে তিনি কীভাবে দেখছেন?
সাকিব জবাব দিলেন, ‘এটা তো খেলার পরই বুঝব। খেলার আগে কীভাবে বলি?’ তবে পরে যোগ করেছেন, ‘আমরা চাইব, জেতার জন্য যতটা সম্ভব ভালো খেলা যায়। বাকিটা আসলে খেলার পর আপনারাই বুঝতে পারবেন।’
বিশ্বকাপ সামনে রেখে নিউজিল্যান্ড সিরিজে কিছু ক্রিকেটারকে বিশ্রাম দিতে চাওয়ার কথা এর আগে সাকিবই বলেছিলেন। এরপর গত কয়েক দিনে সে রকম একটা সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেছে টিম ম্যানেজমেন্ট। কিন্তু আজ এ নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাকিবের পাল্টা প্রশ্ন, ‘কে এটা নিয়ে আলোচনা করেছে আপনার সঙ্গে? শোনা কথা আমাকে বলবেন না। কংক্রিট নিউজ থাকলে বলেন।’
এশিয়া কাপের পারফরম্যান্স বিশ্বকাপে প্রভাব ফেলতে পারে কি না, এমন প্রশ্নেও সাকিব নৈর্ব্যক্তিক, ‘পারে (প্রভাব ফেলতে), আবার না–ও পারে।’ সাকিব হয়তো ঠিকই বলেছেন। তিনি তো আর জ্যোতিষি নন যে আগেই জেনে যাবেন, কোনটার প্রভাব পড়বে আর কোনটার প্রভাব পড়বে না। তবে জ্যোতিষি না হলেও অধিনায়ক তো! তাঁর দলটা কেমন, তারা কিসে ধাক্কা খায় আর কিসে খায় না, সেটা সবচেয়ে ভালো জানার কথা অধিনায়কেরই।
ভারত ম্যাচে মুশফিকুর রহিমের না থাকা নিয়ে অবশ্য বিস্তারিতই বলেছেন অধিনায়ক। তাঁর কথা হলো, দলে অন্য যাঁরা আছেন, তাঁরাও জাতীয় দলে খেলার যোগ্য বলেই আছেন। অভিজ্ঞতা, অনভিজ্ঞতা এখানে বড় বিষয় নয়। দল হিসেবে খেলতে পারাটাই আসল।
সাকিবের বিশ্বাস, ‘ব্যক্তিগতভাবে সবাই যদি যার যার জায়গা থেকে কাজ করতে পারে, দল হিসেবে তখন আমাদের ভালো করার সম্ভাবনা বেশি থাকবে। সব ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সগুলো একত্র করতে পারলে আমরা হয়তো ভালো করতে পারব। আমি জানি, কেউ তার জায়গা থেকে একটুও কম কাজ করবে না, যেটাতে সে বিশ্বকাপে ভালো করতে না পারে। আমি আশাবাদী, আমাদের দল ভালো করবে বিশ্বকাপে।’
সংবাদ সম্মেলনে এর আগে–পরে যা হলো, সবই মারমার কাটকাট। কে জানে, সাকিব হয়তো আজ সংবাদ সম্মেলনে আসতেই চাননি। সে জন্যই প্রায় সব প্রশ্নে এমন পাল্টা আক্রমণে গেলেন। অবশ্য সংবাদ সম্মেলন শেষ করেও এক ঘণ্টার মতো তিনি হোটেলের লবিতেই ছিলেন। স্পিন কোচ রঙ্গনা হেরাথের নিয়ে আসা কয়েকজন অতিথির সঙ্গে মিটিংয়ের মতো কিছু একটা করলেন। তারপর যখন রুমে ফিরে যাচ্ছিলেন, হাতে বুকলেট জাতীয় কিছু কাগজপত্র। ঘণ্টাখানেক ধরে দমিয়ে রাখা কৌতূহলটা তখনই প্রকাশ করলাম সাকিবের কাছে।
‘আজ আসলে হয়েছিলটা কী? একটু যেন রেগে রেগে উত্তর দিলেন প্রেস কনফারেন্সে...।’ প্রশ্নটা শুনে সাকিব যেভাবে হেসে দিলেন, মনেই হলো না ঘণ্টাখানেক আগে ও রকম একটা ঝোড়ো প্রেস কনফারেন্স তিনি করেছেন, যেখানে প্রায় কোনো ‘বল’কেই ঠিক ‘বলে’র মর্যাদা দেননি। সেই রুদ্র চেহারার সাকিবই এবার মুখে চওড়া হাসি ছড়িয়ে বললেন, ‘কোথায় রাগলাম!? কিছু হয় নাই তো! সব ঠিক আছে...।’
তার মানে ‘ব্যাটিং প্র্যাকটিসে’ সন্তুষ্ট সাকিব। ভারতের বোলাররা—আপনারা সাবধান!