দক্ষিণ আফ্রিকা: ২০ ওভারে ১১৩/৬
বাংলাদেশ: ২০ ওভারে ১০৯/৭
ফল: দক্ষিণ আফ্রিকা ৪ রানে জয়ী
মাহমুদউল্লাহ কি তাহলে ছয় মেরেই এনে দিলেন স্মরণীয় এক জয়? কেশব মহারাজের ফুল টসটাকে প্রায় সোজা উড়িয়ে মেরেছেন। বল বাতাসে ভাসতে থাকার সময়টায় সেকেন্ডের ভগ্নাংশের জন্য যেটিকে ছক্কা বলে ভুল হয়েছিল। এইডেন মার্করাম লং অনে বাঁ দিকে সরে গিয়ে সেটিকে ক্যাচ বানিয়ে ফেললেন। ২ বলে ৬ রানের সমীকরণে বল একটি কমল, রান সেই ৬-ই!
শেষ বলেও ৬ লাগে। তাসকিন নিতে পারলেন মাত্র ১ রান। নিউইয়র্কের গ্যালারি তখন স্তব্ধ। দক্ষিণ আফ্রিকা ৪ রানে জিতেছে। একটু এদিক-ওদিক হলেই যে ম্যাচে বাংলাদেশ জিতে যায়। কম রানের ম্যাচও কেমন উপভোগ্য হতে পারে, কেমন স্নায়ুক্ষয়ী—বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা ম্যাচ এর একটা উদাহরণ হয়ে এসেছিল। এটি বোধ হয় সেটিকেই ছাড়িয়ে গিয়ে লো-স্কোরিং থ্রিলারের আদর্শ এক উদাহরণ হয়ে থাকবে।
একটু পিছিয়ে গেলে যা বোঝাতে সহজ হবে। শেষ ৩ ওভারে ২০ রান দরকার, হাতে ৬ উইকেট—ম্যাচ তো শেষই। টি-টোয়েন্টিতে এটা কোনো ব্যাপার নাকি! বাংলাদেশেরই জেতা উচিত। কিন্তু এই বিশ্বকাপে নিউইয়র্কের ড্রপ ইন পিচ যে টি-টোয়েন্টির অর্থই বদলে দিয়েছে। আগের দিন ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ বুঝিয়ে দিয়েছে, এখানে কোনো স্কোরই কম স্কোর নয়। বলের চেয়ে রান বেশি লাগা মানেই বিপদ। আগের দিন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সবচেয়ে কম রান ডিফেন্ড করে জয়ের রেকর্ড সমান করেছিল ভারত। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই যে রেকর্ড ভেঙে গেল।
৩ ওভারে ২০ রান দরকার, সেই সময়টায় ফিরি। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়ে তাওহিদ হৃদয়ের ২০ বলে ৪০ রান আর টানা তিন ছক্কার বড় ভূমিকা। এই ম্যাচেও শুধু হৃদয়ের ব্যাটিংয়ের সময়ই উইকেট ভুল বোঝাচ্ছিল। বাকিদের যেখানে হাঁসফাঁস, হৃদয় সেখানে অনায়াসে রান করছেন। ৩৩ বলে ৩৭ করে ফেলেছেন, যাতে ২টি চারের সঙ্গে ২টি ছক্কা। ১৮তম ওভার করতে আসা কাসিগো রাবাদার প্রথম বলেই আম্পায়ার এলবিডব্লু ঘোষণা করেছেন। রিভিউ নেবেন জানা ছিল, কিন্তু আম্পায়ারস কলে ফিরতেই হলো হৃদয়কে। বাংলাদেশের হৃদয়ে রক্তক্ষরণটাও যেন নিশ্চিত হয়ে গেল তাতে।
রাবাদার ওই ওভারে মাত্র ২ রান দিয়ে ১ উইকেটই শেষ পর্যন্ত হয়ে গেল নির্ধারক। ২ ওভারে ১৮, ১ ওভারে ১১ রানের দাবি আর মেটাতে পারল না বাংলাদেশ।
নিউইয়র্কের ক্রিকেট টি-টোয়েন্টিকে টেস্ট ম্যাচ বানিয়ে দিয়েছে। ব্যাটসম্যানদের ফিরিয়ে নিয়ে গেছে ব্যাটিংয়ের মৌলিক শিক্ষায়। অফ স্টাম্পের বাইরের বল ছেড়ে দাও, এক-দুই রান নিয়ে খেলো, শুধু জায়গামতো বল পেলেই শুধু মারার কথা ভেবো। ক্রিকইনফোতে ম্যাচ-পূর্ব আলোচনায় সঞ্জয় মাঞ্জরেকার মজা করে বলছিলেন, চেতেশ্বর পূজারা নাকি নেট-টেট করে নিজেকে প্রস্তুত রাখছেন। কারণ, যেকোনো মুহূর্তে ভারত তাঁকে ডেকে পাঠাতে পারে। এমন উইকেটে পূজারার মতো ধরে খেলতে পারে, এমন ব্যাটসম্যানই তো দরকার।
এই মাঠে টস জেতার পর অধিনায়ককে জিজ্ঞেস করারই দরকার নেই। জানা কথাই তো, তিনি বোলিং নেবেন। নাসাউ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে প্রথমে বোলিং করার টেমপ্লেটটাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার উল্টো সিদ্ধান্ত, যেটিকে বিস্ময়কর বললেও কম বলা হয়। এমন পেস আক্রমণ, তার ওপর এই উইকেট—দক্ষিণ আফ্রিকা কেন শুরুতেই বাংলাদেশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছে না, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সবাই গলদঘর্ম। ২৩ রানে ৪ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর তো আরও বেশি।
এইডেন মার্করামের সিদ্ধান্তের কারণ হতে পারে একটাই। আগের দিনের ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের উইকেটেই ম্যাচ। টানা দ্বিতীয় দিনে চতুর্থ ইনিংসের সময় উইকেট আরও ব্যাটিং-দুরূহ হয়ে উঠবে বলে মনে হয়েছে তাঁর। কারণ যেটাই হোক, এটা এমন একটা টস, দক্ষিণ আফ্রিকা যা জিতে খুশি, বাংলাদেশ খুশি না জিতেও। বাংলাদেশ অধিনায়ক নাজমুল যে প্রথমে বোলিংই করতে চেয়েছিলেন।
যেকোনো খেলার ক্রীড়াবিদদের ম্যাচ প্রস্তুতিতে একটা জিনিস মোটামুটি কমন থাকে। ভিজ্যুয়ালাইজেশন। খেলায় কী হতে পারে, কী করতে চান—কল্পচোখে তা বারবার দেখে নেওয়া। নাজমুলও হয়তো তা করেছেন। তবে পঞ্চম ওভার আসতে না আসতেই দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংসের এই অবস্থা হবে, এতটা তিনি কল্পনা করেছেন বলে মনে হয় না।
প্রথম ওভারের দ্বিতীয় বলেই ছয় মেরেছেন কুইন্টন ডি কক। পরের বলে চার। প্রথম ৫ বলে ১১ রান। উইকেট নিয়ে তাহলে অকারণেই এত কথা হচ্ছে? ওভারের শেষ বলে মাত্রই স্ট্রাইক পাওয়া রিজা হেনড্রিকসকে এলবিডব্লু করে তানজিম প্রশ্নটাকে মুছে দেওয়ার কাজ শুরু করলেন। উইকেট পরের দুই ওভারেই। মাঝখানে তাসকিন দুর্দান্ত এক বলে মার্করামকে আউট করায় ৪.২ ওভার শেষে স্কোরবোর্ডে ৪ উইকেটে ২৩। তানজিমের বোলিং বিশ্লেষণ তখন ২.২-০-১২-৩!
উপমহাদেশের পেসার এমন উইকেট পেলে অতি উৎসাহে বেশির ভাগ সময়ই গড়বড় করে ফেলেন। এখানেই বাড়তি নম্বর দিতে হচ্ছে বাংলাদেশের পেসারদের। এই উইকেটে যে লেংথ-লাইনে বোলিং করতে হতো, ঠিক তা-ই করেছেন তানজিম ও তাসকিন। পরে মোস্তাফিজও। যাঁর শেষ ওভারটি তো ক্ল্যাসিক মোস্তাফিজ। যেটির ভিডিও টি-টোয়েন্টির বোলারদের ক্লাসে বারবার দেখানোর মতো।
বাংলাদেশের পেসারদের দারুণ বোলিংয়ের চেয়ে বড় চমক সাকিবের ১ ওভারের বেশি বোলিং না পাওয়া। মাহমুদউল্লাহ মাঝে এসে দারুণ ৩টি ওভার করে দেওয়ায় দ্বিতীয়বার আর সাকিবের দিকে তাকাননি নাজমুল। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে পুরো ওভারের ম্যাচে এর আগে কখনো সাকিবের বোলিং ১ ওভারেই শেষ হয়ে যায়নি। লিটন ক্যাচ না ফেললে মাহমুদউল্লাহ তো প্রথম বলেই উইকেটও পেয়ে যেতেন। পঞ্চম উইকেট জুটিতে মিলার ও ক্লাসেনের তাহলে এই মাঠে সর্বোচ্চ ৭৯ রানের জুটি গড়া হয় না। ৩৪ রানেই তা শেষ হয়ে যায়।
নিউইয়র্কের মাঠে খেলার ফাঁকে ফাঁকে ক্রিকেটের আইনকানুন জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে পাবলিক অ্যানাউন্স সিস্টেমে। এদিন যদিও তার প্রয়োজন ছিল বলে মনে হয় না। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের মতো গ্যালারি পুরো ভরেনি। তারপরও ২২ হাজার ৬৫৮ জন দর্শক খুব কম কি! তাঁদের ৯৯ শতাংশ, হয়তো তার চেয়েও বেশি লাল-সবুজ জার্সি। ক্রিকেটের আইনকানুন যাঁদের নিউইয়র্কে খেলা দেখতে এসে শেখার প্রয়োজন নেই।
সেই দর্শক প্রায় সারাক্ষণই বাংলাদেশ জিতে যাচ্ছে ভেবে নিয়ে তুমুল হইচই করে গেলেন। মাঠ ছেড়ে যাওয়ার সময় যাঁদের বুকে ‘এত কাছে তবু এত দূর’-এর কষ্ট। দারুণ একটা ম্যাচের সাক্ষী হয়ে থাকা যাতে একদমই সান্ত্বনা হতে পারছে না।