সকালের আড়ষ্টতা তখনো কাটেনি। সূর্যও তাপ দেওয়া শুরু করেনি। আবহাওয়ার ঠান্ডা ভাবটা ভালোই টের পাওয়া যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর মৃদু বাতাস গায়ে কাঁটা দিয়ে যাচ্ছিল। গায়ে গরম কাপড় থাকলে রোদ চড়া হওয়া পর্যন্ত আরামটা উপভোগ্যই।
আজ সকালে জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে গ্যালারির সামনে দাঁড়ানো নিরাপত্তাকর্মীরা এই আরামটাই উপভোগ করছিলেন। একজন হাই তুলতে তুলতে বললেন, ‘টেস্ট ম্যাচ তো, ভিড় হবে না। চাপও থাকবে না।’ কথাটা শেষ করেই ইশারায় পাশের একজনকে চা আনতে বললেন।
আয়েশে ছিলেন মাঠের দর্শকও। সংখ্যাটা বেশি নয়। সেই নিরাপত্তাকর্মীর মতোই বলতে হয়, টেস্ট ম্যাচ তো, মানুষ না থাকারই কথা! আর বাংলাদেশ-ভারত টেস্টে দ্বিতীয় দিনে সকালের সেশনের খেলা শুরু হলো মাত্র। দর্শকদের মধ্যে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার ক্লাস ফাঁকি দেওয়ারা শিক্ষার্থীরাই বেশি।
সকালের সেশন দেখে অনেকে বাড়ি ফিরবে। মা–বাবা জানবেন সন্তান স্কুল থেকে ফিরেছে। কয়েকজন আবার ক্লাস ফাঁকি দিলেও প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসটা ধরবে। প্রথম সেশনের পানি পানের বিরতি পর্যন্ত দেখেই কলেজে ফেরার পরিকল্পনা। পদার্থবিদ্যার প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস মিস করলেই স্যার মা–বাবার কাছে নালিশ করবেন। অযথাই বাড়িতে ‘অপদার্থ’ হয়ে ওঠার ঝুঁকি নেওয়া কেন!
এত ঝামেলা মাথায় নিয়ে কি টেস্ট ক্রিকেট দেখা যায়? কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়া এক ছাত্র প্রশ্নটা শুনেই বললেন, ‘আমি তো টি-টোয়েন্টি পছন্দ করি, ওয়ানডেও ভালো লাগে। টেস্ট সে রকম না। ওয়ানডের টিকিট পাওয়া কঠিন। টেস্টের টিকিট সহজেই পাওয়া যায়। তাই বন্ধুদের সঙ্গে চলে এসেছি।’
মাদ্রাসার আরেক ছাত্রেরও একই কথা। কিন্তু খুব কাছ থেকে সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিমদের দেখার সুযোগটাকে ছেলেটা হালকাভাবে নিচ্ছে কেন, সেটা বুঝতে আরও কিছুক্ষণ তার সঙ্গে কথা বলতে হলো। শুধু কি সামনে থেকে দেখা! তার সামনেই এক দর্শক বাউন্ডারি সীমানায় দাঁড়ানো মুশফিকের সঙ্গে ওভারের বিরতিতে কথাও বললেন।
মুশফিকের কাছে সেই দর্শকের প্রত্যাশা, ‘ভাই, আপনার কাছে একটা সেঞ্চুরি চাই।’ মুশফিকও মজার ছলে বললেন, ‘সেঞ্চুরি কি বাজারে কিনতে পাওয়া যায়?’ দর্শক উত্তর দেন, ‘বাজারে না হলেও আপনার কাছে পাওয়ার আশা করি।’ মুখে হাসি টেনে মুশফিকও বলেন, ‘ইনশা আল্লাহ, দোয়া করবেন।’
গ্যালারির অন্য দর্শকদের মতো কান খাড়া করে মুশফিকের কথাগুলো শুনছিল মাদ্রাসার সেই ছাত্রও। দর্শকের সঙ্গে ক্রিকেটারদের এমন মুহূর্ত শুধু টেস্ট ক্রিকেটেই সম্ভব। অন্য দুই সংস্করণের মতো টেস্টে তাড়াহুড়া নেই। ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে এসব নিয়ে দর্শক-ক্রিকেটারদের ভাবনার আদান-প্রদানের সময় কোথায়! ওই দুই সংস্করণের মতো এখন জীবনও যে দ্রুততায় ঠাসা। টেস্টের সঙ্গে তার আড়ি।
সে জন্যই হয়তো মুশফিকের সঙ্গে কথোপকথন ছেলেটিকে টানেনি। ছেলেটি নিজেই বলল, ‘টেস্ট খেলায় কী হচ্ছে, সেটা টিভিতে একটু দেখে নিলেই হয়। মোবাইলে স্কোর দেখলেও হয়। এই যে দেখুন, কতক্ষণ উইকেট পড়ছে না। অনেক অপেক্ষা করা লাগে উইকেট, বাউন্ডারির জন্য।’
তার মুখের কথা মুখে থাকতেই কয়েক খুদে দর্শক দৌড়ে গ্যালারিতে ঢুকল। তাদের হইচই দেখে মুশফিকও একবার গ্যালারিতে তাকালেন। মাঠে এসে টেস্ট ম্যাচ দেখতে সেসব খুদে দর্শককে টিকিট কাটতে হয়নি। নিরাপত্তাকর্মীরা এমনিতেই ঢুকতে দিয়েছেন। কিছুক্ষণ পর এক বাবা তাঁর সন্তানকে নিয়ে মাঠে এলেন। হাতে লাল-সবুজ পতাকা। গ্যালারিতে একটু বসার পর আঙুল দিয়ে মেয়েকে দেখিয়ে বললেন, ‘ওই যে দেখ সাকিব আল হাসান। এই যে মুশফিকুর রহিম। আর বল করছে মিরাজ।’
মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক নিশ্চয়ই টেস্ট ও ওয়ানডে ক্রিকেট দেখেই বড় হয়েছেন। সে জন্যই হয়তো টানটা বেশি। সাতসকালে মেয়েকে নিয়ে হাজির গ্যালারিতে। খেলোয়াড়দের চেনাচ্ছেন হয়তো আগামীর কথা ভেবে। পৃথিবীর সব বাবাই সন্তানের জন্য কিছু না কিছু রেখে যেতে চান। বাড়ি–গাড়ি, টাকাপয়সার কথা বলা হচ্ছে না। হয়তো নিজের চেতনার বীজ বুনে দিয়ে যেতে চান সন্তানের মধ্যে। কিংবা নিজে যেভাবে ভাবেন, চান সন্তানও সেভাবে ভাবতে শিখুক। টেস্ট ক্রিকেট তাঁর চেতনায় আছে বলেই হয়তো শীতে সাদা পোশাকের ‘ওম’ নিতে সঙ্গে এনেছেন মেয়েকে।
কিন্তু মেয়ে সেই শ্বেত-শুভ্র চেতনার কতটুকুই–বা নিতে পারবে? হ্যাঁ, পারলে টেস্ট ক্রিকেট হয়তো আরও একজন ভক্ত পাবে। কিন্তু না পারার পাল্লাই যে দিন দিন ভারী হচ্ছে। টি-টোয়েন্টির এই সময়ে প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে।
উত্তর দিল সেই মাদ্রাসার ছাত্র, ‘টেস্ট ক্রিকেট এখন শুধুই টিভির...।’ আসলেই তো! মাঠে গিয়ে খেলা দেখার সময় কোথায়! স্কুল-কলেজ, অফিস আছে। সেসব না থাকলে রোজকার কাজকর্ম, আর যদি তা–ও না থাকে, যদি একদম বেকার সময় কাটে, তবু মাঠে গিয়ে টেস্ট দেখার ইচ্ছায় কোথায় যেন একটা দ্বিধার কাঁটা বিঁধে থাকে। কী দরকার সময় নষ্ট করার!
বুদ্ধিমানরা তাই টেস্ট দেখতে মাঠে যান না। বুদ্ধিমানরা সকালে অফিসে কিংবা স্কুল-কলেজে পৌঁছে কম্পিউটার অথবা মুঠোফোনে ক্রিকেটের খবরের আপডেট নিতে নিতে কাজ শুরু করেন। কাজের ফাঁকে পাওয়া ফুরসতে স্কোরটা দেখে নেন। কিংবা স্কুলের সেই শিক্ষার্থী, যে ক্লাসের ফাঁকে মুঠোফোনে স্কোর দেখে নেয়, তার কাছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাঠে বসে থেকে টেস্ট দেখা অর্থহীন। স্কুলের পরে প্রাইভেট-কোচিংও থাকে। জীবন এখন দৌড়ানোর। গ্যালারিতে বসে টেস্ট দেখে সময় নষ্ট করে বোকারা। আচ্ছা, সেই বাবাটিও কি তাহলে বোকা?
গত ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে বলা সাকিব আল হাসানের একটা কথা মনে পড়ে যায়। বাংলাদেশ দলের টেস্ট অধিনায়ক বলেছিলেন, বাংলাদেশে এখনো টেস্ট সংস্কৃতিটাই গড়ে ওঠেনি। আসলে সাকিবের কথারই খণ্ড খণ্ড প্রমাণ যেন মিলছিল জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে।
বিসিবিকেও টেস্ট ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ তৈরি করার চেষ্টা করতে কখনো দেখা যায় না। তারাও যেন ধরে নিয়েছে, টেস্ট ক্রিকেটে মাঠে দর্শক না আসাটাই স্বাভাবিক। এটা তো আর রংচঙের ক্রিকেট নয়।
চট্টগ্রাম টেস্টের কথাই ধরুন। সাকিব-মুশফিকদের বাংলাদেশ খেলছে তারকায় ঠাসা ভারতের বিপক্ষে। বিরাট কোহলি, চেতেশ্বর পূজারা, রবিচন্দ্রন অশ্বিনের মতো তারকারা খেলছেন। কিন্তু চট্টগ্রাম শহরের কোথাও এর ছাপ নেই। কুয়াশার চাদর ফুঁড়ে ক্রিকেটারদের বাসের আগে–পরে নিরাপত্তার বহর দেখলেই শুধু বোঝা যায়, এ শহরে ক্রিকেট হচ্ছে।
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে লোকেরা দেখেন, দেশের সেরা ক্রিকেটারদের নিয়ে বাস যাচ্ছে। সেই বাসের সঙ্গে উৎসুক পথচারীর দূরত্ব যত বাড়তে থাকে, ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে দর্শকদের ব্যবধানও হয়তো তেমন করেই বাড়ছে। টেস্ট দেখতে মাঠে কে এল না এল, তা নিয়ে ভাবার দরকার নেই। টিভি সম্প্রচার ও স্পনসর থেকে যে টাকা আয় হবে, সেটাই আসল।
টিভি সম্প্রচারকদের কাছে সিরিজ বিক্রি হয় সাদা বলের ক্রিকেটের সঙ্গে প্যাকেজ বানিয়ে—বাংলাদেশ-ভারত তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের সঙ্গে দুই টেস্টের সিরিজ। আয়ের খাতায় টেস্টটা গৌণ। সিরিজে রাখতে হয় বলেই রাখা। লাভের গুড় তো এনে দেয় ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি।
শুধু বাংলাদেশ নয়, এই বাস্তবতা প্রায় সব দেশেই। টেস্ট ম্যাচের গ্যালারি ফাঁকা। চোখের সামনে সবকিছু দেখার স্বাদ নিতে লোকে ভুলে গেছে। নাকি ভুলিয়ে দিয়েছে রঙিন ক্রিকেটের চাকচিক্য! সাদা সাদা টেস্ট ক্রিকেটে তাই রং জমেছে কালা কালা। সেই রং টেস্ট ক্রিকেটের আনন্দটাকেই দিয়েছে ঢেকে।
গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের সেই গানটা মনে আছে? পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে/ স্যাটেলাইট আর ক্যাবলের হাতে/ ড্রয়িংরুমে রাখা বোকা বাক্সতে বন্দী/ ঘরে বসে সারা দুনিয়ার সাথে/ যোগাযোগ আজ হাতের মুঠোতে/ ঘুচে গেছে দেশ কাল সীমানার গণ্ডি/ ভেবে দেখেছ কি/ তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে/ তারও দূরে/ তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে...।
টেস্ট ক্রিকেট আর গ্যালারির দর্শকের গল্পটাও যেন আজ সে রকমই, ‘তুমি (টেস্ট) আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে...।’