কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের সময়ে জাতীয় দলের অনুশীলন মাঝেমধ্যে গোপনীয়তার চাদরে ঢাকা পড়বে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এর আগেও যখন বাংলাদেশ দলের কোচ ছিলেন, তখনো তিনি মাঝেমধ্যে ইনডোরের গ্রিলের বেড়ায় কালো কাপড় লাগিয়ে ‘গোপন’ অনুশীলন করিয়েছেন দলকে। খেলাধুলায় যদিও এটা নতুন কিছু নয়, ক্রিকেটে প্রতিদিনের অনুশীলনটাকে লোকচক্ষুর অন্তরালে নিয়ে যাওয়াটা নতুন ঘটনাই।
বিসিবি কাল সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে টিম ম্যানেজমেন্টের সে সিদ্ধান্তই জানিয়েছে সবাইকে। আগামী কয়েক দিন মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে জাতীয় দলের অনুশীলনে সংবাদমাধ্যমের প্রবেশাধিকার থাকবে সীমিত। প্রতিদিন ১৫ মিনিট করে অনুশীলনের ছবি তুলতে ও ভিডিও ফুটেজ নিতে পারবে সংবাদমাধ্যম। এরপর স্টেডিয়াম এলাকা ত্যাগ করতে হবে।
ক্রিকেটে অন্যান্য দলের ক্ষেত্রে ‘ক্লোজডোর’ অনুশীলন হলেও হয় টুর্নামেন্ট বা সিরিজ চলাকালে। কৌশলগত কারণে ম্যাচের আগের অনুশীলনটাই মূলত তাঁরা গোপন রাখতে চান।
পূর্বপ্রস্তুতিতে সে রকম গোপন অনুশীলনের প্রয়োজন তেমন বোধ করে না দলগুলো।
অন্যান্য দেশের সঙ্গে অবশ্য বাংলাদেশের একটা পার্থক্যও আছে। পৃথিবীর আর কোনো ক্রিকেট খেলুড়ে দেশেই ক্রিকেট দলের প্রতিদিনের অনুশীলন দেখতে স্টেডিয়ামে এত সাংবাদিক ভিড় করেন না। অনুশীলন নিয়ে এত প্রতিবেদন, এত লাইভও হয় না। জাতীয় দলই বলুন বা ইমার্জিং দল কিংবা ক্রিকেটারদের ব্যক্তিগত অনুশীলন, কোনোটাই মিস নেই।
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম যেহেতু এদিক দিয়ে একটা রেকর্ডেরই মালিক, হয়তো সে কারণেই প্রতিদিনই ‘ক্লোজডোর’ নিষেধাজ্ঞা দিয়ে অনুশীলন করে বাংলাদেশ দলও নতুন রেকর্ড করতে চাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক ফুটবলে ‘ক্লোজডোর’ অনুশীলন নিয়মিত ঘটনা। সংবাদমাধ্যমকে অনুশীলন দেখতে শুরুতেই ১৫ মিনিট সময় বেঁধে দেওয়া হয়। ওই ১৫ মিনিটে ফুটবলাররা গা-গরম আর হাসি-ঠাট্টা ছাড়া তেমন কিছু করেন না। মূল অনুশীলনটা হয় ১৫ মিনিট শেষে সাংবাদিকেরা বিদায় হলে।
তা বাংলাদেশ ক্রিকেট দল কেন ফুটবলের পথে গেল? সোজা কথায় কারণটা হলো, তাঁরা তাঁদের কাজগুলো এত এত সংবাদমাধ্যমের সামনে করতে চান না। হয়তো তাঁরা এটাও মনে করেন যে এত মানুষের সামনে অনুশীলনে খেলোয়াড়দের মনঃসংযোগ ধরে রাখাটাও কঠিন হয়ে পড়ে।
তা ছাড়া অনুশীলনে হয়তো কোচ-খেলোয়াড়েরা এমন কিছু নতুন কৌশল চর্চা করবেন বা এমন কিছু পরিকল্পনার মহড়া দেবেন, তাঁরা চান না সেসব সংবাদমাধ্যমে এসে প্রতিপক্ষ দলগুলোর কানে আগেই পৌঁছে যাক। হাথুরুসিংহের আগের বাংলাদেশ কোচরাও মাঝেমধ্যে এ রকম অনুশীলন করেছেন। সেটা অবশ্য সিরিজ বা টুর্নামেন্টের ঠিক আগমুহূর্তে।
সব দলই প্রতিপক্ষ সম্পর্কে পূর্ব অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণা নিয়ে মাঠে নামে। সেভাবেই গেমপ্ল্যান সাজায়। প্রতিপক্ষের ক্রিকেটারদের সম্পর্কে তাদের ধারণাও সেই অভিজ্ঞতানির্ভর। এখন একজন কোচ চাইতেই পারেন যে তাঁর ছেলেরা বিরুদ্ধ দলের পূর্বানুমান মাঠে ভুল প্রমাণ করে দেবে। সে জন্য নতুন নতুন কৌশল শেখাবেন ক্রিকেটারদের। কিন্তু সেসব আগেই জানাজানি হয়ে গেলে তো সবই শেষ! সে জন্যই প্রয়োজন হয় রুদ্ধদ্বার অনুশীলনের।
ধরুন, নতুন বলে বাউন্সার সামলাতে লিটন দাস এমন একটা শট নিয়ে কাজ করবেন, যেটা আগে তিনি খেলেননি। সাকিব আল হাসান বা তাসকিন আহমেদ হয়তো বোলিং-তূণে এমন কোনো নতুন বিষ ঢালতে চাচ্ছেন, যা সম্পর্কে প্রতিপক্ষের কোনো ধারণা নেই। কিংবা পাওয়ার প্লে বা মাঝ-ওভারের ব্যাটিং, স্লগ ওভারের বোলিং বা নতুন বলের বোলিংয়ে কোনো চমক আনতে চাইতে পারে বাংলাদেশ। এশিয়া কাপ-বিশ্বকাপের আগে সেসবের ব্যবহারিক ক্লাস তো অনুশীলনেই হতে হবে। অনুশীলনে সফল হলেই না নতুন অস্ত্র, নতুন পরিকল্পনা মাঠে প্রয়োগ করা যাবে।
এখন অনুশীলনটা যদি কোচ-খেলোয়াড়েরা প্রকাশ্য দিবালোকে ক্যামেরা আর সাংবাদিকদের অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টির সামনে করতে থাকেন, প্রতিপক্ষের জন্য কোনো ‘সারপ্রাইজ প্যাকেজ’ নিয়ে যেতে পারবে না বাংলাদেশ। বাংলাদেশ দল ভারত, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া না হতে পারে; কিন্তু ওয়ানডে ক্রিকেটে যে এখন তারা শক্তির ফণা তুলতে পারে, সেটি কোনো দলেরই অজানা নয়। কাজেই প্রস্তুতিটা সবার চোখের আড়ালে রেখে প্রতিপক্ষদের পূর্ব অভিজ্ঞতায় বিস্ময়ের ধাক্কা দিতেই দলের অনুশীলন নিয়ে হাথুরুর এই বিরল গোপনীয়তা।
বাংলাদেশ দলের অনুশীলন বেশির ভাগ সময় সংবাদমাধ্যমের জন্য উন্মুক্তই থাকে। তবে এ কারণে দু-একবার দলকে অস্বস্তিতেও পড়তে হয়েছে। মাঠে একজন বোলার হয়তো বোলিংয়ের বিশেষ কিছু নিয়ে কাজ করে বাড়ি ফিরেছেন। রাতে অনলাইনে দেখলেন, সারা দিন তিনি যে বিশেষ কাজটাকে ‘গোপন’ ভেবে করেছেন, সেটা আসলে দুনিয়ার সবাই জানে!
সংবাদমাধ্যমের কাজ খবর বের করা। দল পর্দার যত আড়ালেই চলে যাক না কেন, সংবাদমাধ্যম খবরের সন্ধানে সে আড়াল ছিন্ন করতে চাইবেই। অন্যদিকে দলও চাইবে তাদের গোপনীয়তার চাদর নিশ্ছিদ্র থাকুক। হাথুরুর অনুশীলনের দরজা সে কারণেই বন্ধ।
তাতে যদি এশিয়া কাপ ও বিশ্বকাপের প্রতিপক্ষদের সত্যিকার অর্থেই ধোঁকা দেওয়া যায়, কোচ হিসেবে নিশ্চয়ই ব্যাপক হাততালি পাবেন হাথুরুসিংহে। সে হাততালিটা দিতে তত দিন সংবাদমাধ্যম নাহয় মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের গেটেই অপেক্ষায় থাকবে।