সৌম্য সরকার যখন ব্যাটিংয়ে নামেন, বাংলাদেশের রান তখন ৪ উইকেটে ১২৩। তখনো ১৫২ বল বাকি, জয়ের জন্য লাগে ৮৯ রান। ‘ফিনিশার’ হয়ে ওঠার আদর্শ মঞ্চ সৌম্যর সামনে। তবে ওয়ানডে, টি–টোয়েন্টি মিলিয়ে পাঁচটি বিশ্বকাপ খেলা অভিজ্ঞ এই ব্যাটসম্যান সুযোগটি কাজে লাগাতে পারলেন না। অফ স্পিনার যুবরাজসিং দোদিয়ার বল লেগ সাইডে খেলতে গিয়ে ক্যাচ দেন স্লিপে। এটি আদৌ ক্যাচ ছিল কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। যা এবং আরও দুটি সিদ্ধান্ত নিয়ে পরে বাংলাদেশ দলের নির্বাচক হাবিবুল বাশার ‘সবাই দেখেছে কী হয়েছে’ বলে উষ্মাও প্রকাশ করেছেন। তবে আম্পায়ারের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত এক পাশে সরিয়ে রাখলে এই প্রশ্নও তো তোলা যায়, লেগ স্টাম্পে পড়া বল সৌম্য কি ‘স্বচ্ছন্দে’ খেলেছেন? ওই মুহূর্তে ওভাবেই খেলা সঠিক ছিল?
৩ বলে ৫ রান করে সৌম্য আউট হয়ে যাওয়ার পর মাঠে নামেন আকবর আলী। তিন বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকার পচেফস্ট্রুমে এমনই এক প্রেক্ষাপটে ব্যাটিং করতে নেমেছিলেন তিনি। সেটি ছিল অনূর্ধ্ব–১৯ বিশ্বকাপের ফাইনাল, প্রতিপক্ষও ছিল ভারত। সেদিন ১৭০ রানের লক্ষ্যে নামা বাংলাদেশ যুব দল ৬৫ রানে হারিয়ে ফেলেছিল ৪ উইকেট। এরপরও যে বাংলাদেশ ৩ উইকেট হাতে রেখে ট্রফি জিতেছিল, তাঁর মূলে ছিল আকবরের ৭৭ বলে ৪৩ রানের অপরাজিত ইনিংস। ২০২০ থেকে ২০২৩—এ যাত্রায় আর পারলেন না আকবর। ৫ বলে ২ রান করে ক্যাচ দিলেন নিশান্ত সিন্ধুর বলে।
ছয়ে নামা আর সাতে নামা আকবর অবশ্য ধসে পড়া ভবনের প্রথম অংশ নন, মাঝের অংশ। ১ উইকেটে ৯৪ রান তুলে ফেলার পরও মাত্র ৬৬ রানের মধ্যে ৯ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ ‘এ’ দল অলআউট হয়েছে ১৬০ রান। নাগালে থাকা জয় ওই ধসেই পরিণতি পেল ৫১ রানের যন্ত্রণাদায়ক হারে। যে হারের যোদ্ধাদের মধ্যে ৭ জনই কখনো না কখনো আন্তর্জাতিক ম্যাচে খেলেছেন। বিপরীতে প্রতিপক্ষ দলের সবাই যেখানে বয়সে তরুণ, অভিজ্ঞতায় অনেক পিছিয়ে।
পাঁচটি বিশ্বকাপ খেলা সৌম্য, টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলা শেখ মেহেদী ও মোহাম্মদ নাঈম, অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি করা জাকির হাসান, দক্ষিণ আফ্রিকার কঠিন কন্ডিশনে টেস্ট সেঞ্চুরি পাওয়া মাহমুদুল হাসান—এত সব অভিজ্ঞ ক্রিকেটারের বিপক্ষে খেলা ভারত ‘এ’ দলের কোনো খেলোয়াড়ই কখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলেননি। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা যেভাবে নিশান্ত সিন্ধু, মানব সুথার আর দোদিয়াদের মতো তুলনামূলক অনভিজ্ঞ স্পিনারদের সামনে খেই হারিয়েছেন, তা যে কারোরই চোখে লাগার কথা।
ইমার্জিং টিমস এশিয়া কাপের ফাইনালে ওঠা না–ওঠা হয়তো অনেক বড় সাফল্য বা ব্যর্থতা নয়। কিন্তু ২১১ রান তাড়া করতে নেমে ৩৪.২ ওভারে অলআউট হয়ে যাওয়াটা বাংলাদেশ ‘এ’ দলের ক্রিকেটারদের সামর্থ্যেই বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন জুড়ে দিচ্ছে।
যা ম্যাচ শেষে প্রতিধ্বনিত হয়েছে দলের সঙ্গে যাওয়া নির্বাচক হাবিবুল বাশারের কণ্ঠেও, ‘কখনোই চাপ ছিল না। সেখান থেকে আসলে অলআউট হয়ে যাওয়াটা ভালো কিছু নয়। আমরা হয়তো একটু প্যানিক করেছি। আইডিয়াল উইকেট ছিল না। তবে এমন নয় যে খেলা যাবে না।’
সদ্য সমাপ্ত আফগানিস্তান সিরিজের বাংলাদেশ দলে ছিলেন না সৌম্য, শেখ মেহেদীরা। তবু জাতীয় দলের সিরিজ–পূর্ব প্রস্তুতি ক্যাম্পে তাঁদের ডেকে নিয়েছিলেন বাংলাদেশ কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। অক্টোবর–নভেম্বরে ভারতে হতে যাওয়া বিশ্বকাপের ভাবনায় যে তাঁরা ভালোমতোই আছেন, সেটি বোঝা গিয়েছিল দুজনের ইমার্জিং টিমস এশিয়া কাপের দলে অন্তর্ভুক্তিতেও। শুধু সৌম্য আর মেহেদীই নন, আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে দলে থাকা নাঈমকেও সিরিজ শেষের পরপরই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল ইমার্জিং টিমে।
কিন্তু যে ভাবনা থেকে তাঁদের উদীয়মানদের সঙ্গী করে পাঠানো, তার কতটা আসলে কাজে লেগেছে, সেই প্রশ্নও থাকছে। ক্যাম্পে ডাক পাওয়ার মাধ্যমে হাথুরুসিংহের বিশেষ মনোযোগ পাওয়া সৌম্যর দিকেই নজর দেওয়া যাক। ব্যাট করেছেন চার ম্যাচের তিনটিতে। এর মধ্যে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৩৪৯ রান তাড়ায় ৬ নম্বরে নেমে ৪৬ বলে তোলেন ৪২ রান। মোটামুটি রান পেলেও লক্ষ্য ও ব্যাটিং অর্ডার বিবেচনায় স্ট্রাইক রেট কমই।
সৌম্য দ্বিতীবার ব্যাটিং করেন গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে আফগানিস্তানের বিপক্ষে। এই ম্যাচে বাংলাদেশ ‘এ’ প্রথমে ব্যাট করে। ছয়ে নেমে ৪২ বলে ৪৮ রান তোলেন সৌম্য। ৩ চার আর ৩ ছয়ে গড়া ইনিংসটিতে স্ট্রাইক রেট ছিল ১১৪.২৮। ব্যাট হাতে সৌম্যর জন্য সবচেয়ে ভালো মঞ্চ ছিল সেমিফাইনালে ভারতের বিপক্ষে। কিন্তু ‘ফিনিশার’ হয়ে ওঠার সুযোগটি তিনি কাজে লাগাতে পারেননি। বোলিংয়ে অবশ্য ভালোই করেছেন সৌম্য। চার ম্যাচে মোট ১৮ ওভার বোলিং করেছেন, ৬.৮৩ ইকোনমিতে ২০.৫০ গড়ে নিয়েছেন ৬ উইকেট; যার মধ্যে তৃতীয় বোলার হিসেবে খেলে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৩ উইকেট সেরা।
সৌম্যর মতো ৪ ম্যাচেই খেলেছেন নাঈম। আফগানিস্তানের বিপক্ষে দুই ম্যাচে ৯ রান করা এই বাঁহাতি ৪১.৪৬ গড়ে তুলেছেন ১২৫ রান। সব ম্যাচেই দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছেছেন, কিন্তু ৪৭* রানই সর্বোচ্চ। হতাশ করেছেন জাকির হাসানও। ৪ ম্যাচের একটিতে ফিফটির পরও মোট রান ১০৪। আর একটি সেঞ্চুরিসহ তিন ইনিংসে মাহমুদুল হাসান জয়ের রান ১৩১। অভিজ্ঞদের এমন অধারাবাহিকতার ভিড়ে নিয়মিত রান পেয়েছেন শুধু তানজিদ হাসান। ৪ ইনিংসে তামিমের রান ৪৪.৭৫ গড়ে ১৭৯, এর মধ্যে ফিফটি আছে তিনটি। ফাইনালের আগপর্যন্ত টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের মধ্যে তৃতীয় স্থানে তামিমের নাম।
টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারিদের তালিকার ৩ নম্বর নামটিও বাংলাদেশের–তানজিম হাসান। সাকিব ডাকনামের ডানহাতি এ পেসার ৩ ম্যাচে নিয়েছেন ৯ উইকেট। ওমানের বিপক্ষে ১৮ রানে ৪ উইকেট সেরা, আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৩টি আর ভারতের বিপক্ষে ২টি উইকেট।
বোলিংয়ে সাকিব আর ব্যাটিংয়ে তামিম—টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের সেরা দুই পারফরমার এ দুজনই। দুজনের বড় মিল, তাঁরা ২০২০ সালে অনূর্ধ্ব–১৯ বিশ্বকাপজয়ী দলেও ছিলেন। বয়স এবং অভিজ্ঞতা বিবেচনায় সত্যিকারের উদীয়মান যাঁরা, তাঁরাই দিন শেষে ইমার্জিং টিমস এশিয়া কাপে বাংলাদেশের সেরা প্রাপ্তি। কিন্তু বিশ্বকাপের জন্য একজন বিকল্প ওপেনার আর ৬-৭ নম্বরের জন্য একজন ফিনিশার খোঁজাখুঁজির যে লক্ষ্য, সেটা কি পূরণ হয়েছে?