সাজানো নিরিবিলি শহর। প্রশস্ত রাস্তাঘাট, সিডনির মতো গাড়িঘোড়ার চাপ নেই। শহরের বুক চিরে চলা ট্রামের চাপা যান্ত্রিক শব্দও মধ্যদুপুরে অ্যাডিলেডের আলস্য ভাঙতে পারে না। তবে পর্যটকদের আনাগোনায় সব সময়ই প্রাণবন্ত দক্ষিণ প্রান্তের গ্লেনেল সৈকত এলাকা। সন্ধ্যায় আলোঝলমলে হয়ে ওঠা গ্লেনেল সহজে মানুষকে ফিরতে দেয় না সেখান থেকে।
অস্ট্রেলিয়ার পঞ্চম বৃহত্তম শহর অ্যাডিলেড। এর আবহাওয়া নিয়েও খুব বেশি অভিযোগ নেই, যেটা আছে হোবার্টের আবহাওয়া নিয়ে। মাঝেমধ্যে একটু ঠান্ডা পড়ে বৈকি, তবে এই শহরের মানুষ চনমনে রোদে দিন কাটিয়েই অভ্যস্ত। ব্রিসবেনের মতো অ্যাডিলেডের মানুষও বলেন এখানে থেকে অনেক আরাম। বসবাসের জন্য এর চেয়ে উপযুক্ত শহর আর হয় না।
অবসরে চলে যাওয়া মানুষেরা এই শহরে ঘরবাড়ি কিনে চলে আসেন নির্ঝঞ্ঝাট জীবনযাপন করতে। অ্যাডিলেড তাই ‘সিনিয়রদের শহর’ হিসেবেও পরিচিত। আবার ‘সিটি অব চার্চেস’ বলেও খ্যাতি আছে অ্যাডিলেডের। পর্যটকদের এখানে টেনে আনে ঐতিহাসিক সেসব চার্চ, বিখ্যাত সব ওয়াইনারি, সমুদ্রের গাঢ় নীল জল আর মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।
ভিক্টর হারবার, অ্যাডিলেড সিটি থেকে পাশের এই শহর গাড়িতে ঘণ্টাখানেকের পথ। ব্রিসবেনে গেলে যেমন গোল্ডকোস্টে যেতে হয়, অ্যাডিলেড এসেও ‘না গেলে মিস’জাতীয় এক ট্যুরিস্ট স্পট এই ভিক্টর হারবার।
মূল আকর্ষণ ঘোড়ায় টানা কাঠের ট্রেন, সেই ট্রেনে চড়ে হারবারের ওপর দিয়ে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন ছোট্ট দ্বীপ গ্রানাইট আইল্যান্ডে যাওয়া এবং পাথুরে সেই দ্বীপের বিভিন্ন ভিউ পয়েন্ট থেকে সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করা। সমুদ্রের পানি কতটা নীল হতে পারে, এর ঢেউ কতটা শক্তি নিয়ে দ্বীপের বেদিতে আছড়ে পড়তে পারে এবং সমুদ্র কখনো কখনো কতটা শান্তও হতে পারে—গ্রানাইট দ্বীপের পাথুরে পথে হেঁটে বেড়ালে চোখে ধরা পড়বে সবই।
কপাল ভালো থাকলে দ্বীপের কাছাকাছি ডলফিনের লাফও দেখতে পারেন। ভিক্টর হারবার ভ্রমণে আমার ও প্রথম আলোর বিশেষ ফটোসাংবাদিক শামসুল হকের সঙ্গী হয়েছিলেন অ্যাডিলেডে থিতু হওয়া প্রথম আলোরই সাবেক সহকর্মী মাশুকুর রহমান। তাঁর কাছ থেকেই শোনা, বছরের নির্দিষ্ট একটা সময়ে নাকি তিমি মাছের আনাগোনাও বেড়ে যায় দক্ষিণ ভারতীয় মহাসাগরের এদিকটায়।
ডলফিন আর তিমি–দর্শনও তাই অ্যাডিলেডে আগত পর্যটকদের অন্যতম আগ্রহের বিষয়। তবে যদি ক্রিকেট পর্যটক হয়ে থাকেন, তাহলে এক স্যার ডন ব্রাডম্যানই যথেষ্ট আপনাকে অ্যাডিলেড ঘুরে যেতে বাধ্য করতে। ব্রাডম্যানের জন্ম কুটামুন্ড্রায়। আড়াই বছর বয়সে তাঁর পরিবার চলে যায় সিডনি থেকে ১১৮ কিলোমিটার দূরের বাউরালে। ২০ বছর বয়স পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন ব্রাডম্যান। এরপর ক্রিকেটে জীবন গড়তে চলে যান সিডনিতে।
সেখান থেকে ১৯৩৪ সালে ব্রাডম্যান পাড়ি জমান সাউথ অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডে। উদ্দেশ্য ব্যবসা এবং এখানকার ক্রিকেটীয় সুযোগ–সুবিধা কাজে লাগানো।
২০০১ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত ‘স্যার ডনে’র ঠিকানা ছিল শহরের ২ হোল্ডেন স্ট্রিট, কেনসিংটন পার্কের নিজ বাড়িতে। তাঁর মৃত্যুর পর সিটি কাউন্সিলের অধীনে চলে যাওয়া লাল ইটের সেই বাড়ি এই শহরে আসা পর্যটকদের আরেকটি আকর্ষণ।
সেদিন দুপুরে উবার নিয়ে চলে গেলাম ২ হোল্ডেন স্ট্রিটে। অ্যাডিলেডের মূল শহর থেকে যেতে মিনিট বিশেক লাগল শহরতলি কেনসিংটন পার্কে। কোলাহলমুক্ত নিরিবিলি পরিবেশ। গাড়ি হোল্ডেন স্ট্রিটে ঢুকতেই সবকিছু আরও শান্ত। অভিজাত আবাসিক এলাকা।
সীমানাপ্রাচীর দেওয়া বিশাল সব আলাদা বাড়ি। বাইরে লোকজন খুব একটা দেখা গেল না। তার মধ্যেও একটু বেশি নিঃসঙ্গ মনে হলো ওপরে টালি দেওয়া লাল ইটের দোতলা বাড়িটাকে; ২, হোল্ডেন স্ট্রিট। ভেতরে কেউ নেই, বাইরের অতিথিদের তো প্রবেশাধিকার নেই–ই।
অনেক বছর ধরে অ্যাডিলেডের মানুষ জানতেন এই শহরে ব্র্যাডম্যানের ঠিকানা বলতে এই বাড়িটাই। আসলে তা নয়। ব্র্যাডম্যানের পছন্দ ছিল নিভৃত জীবন। সংবাদমাধ্যম আর অটোগ্রাফশিকারিদের ভিড়ে হাঁপিয়ে উঠতেন প্রায়ই। মাঝেমধ্যে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যেতে তাই খুঁজে নিয়েছিলেন নতুন ঠিকানা। ১৯৫৯ সালে অ্যাডিলেড শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে অ্যাডিলেড হিলস কাউন্সিলের অন্তর্গত ক্র্যাফার্স ওয়েস্ট উপশহরে কিনে নেন একটা কটেজ। ১১৭, শেওক রোডের সেই বাড়িটি যে ব্র্যাডম্যানের, তা জানতেন শুধু পরিবারের খুব কাছের কিছু মানুষই।
প্রায় ২২ একর জমির ওপর ব্রাডম্যানের বাগানবাড়িটি অবশ্য এখন আর তাঁর পরিবারের হাতে নেই। গত বছর নভেম্বরে প্রায় দুই মিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলারে কটেজটা বিক্রি করে দেন তাঁর পুত্রবধূ। অস্ট্রেলিয়ান সংবাদমাধ্যমকে সে সময় তিনি বলেছিলেন, ‘সাংবাদিকেরা ডনের পিছু ছাড়তেন না।
এই জায়গাটা তাঁকে সুযোগ করে দিয়েছিল সবার দৃষ্টির আড়ালে থেকে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর। একটা সময় তিনি প্রায়ই এখানে আসতেন, বাগানে কাজ করতেন। কেউ অবশ্য জানত না এটার মালিক তিনি। পরিবারের কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধু, জন (ব্রাডম্যানের ছেলে) আর আমি, এই কয়জনই সেখানে যেতাম।’
খুঁজলে সিনিয়রদের শহরে সিনিয়রদেরও ‘সিনিয়র’ ব্র্যাডম্যানের স্মৃতিচিহ্ন অ্যাডিলেডে পাওয়া যাবে আরও। অ্যাডিলেড ওভালের ইস্ট গেট দিয়ে ঢুকতেই যেমন তাঁকে পাবেন কাভার ড্রাইভ মারার ভঙ্গিতে। বিশাল সেই ভাস্কর্য পেরিয়ে বাঁয়ে হেঁটে সাউথ গেটের দিকে চলে যান। মূল স্টেডিয়ামের ভেতর ঢুকলেই চোখে পড়বে ‘ব্র্যাডম্যান কালেকশনস’, যেটি আসলে টেস্টে ৯৯.৯৪ রানের মালিকের স্মৃতি নিয়ে গড়ে তোলা একটা জাদুঘরই।
এই টুকরা টুকরা অ্যাডিলেড যদি কারও মন ভরাতে না পারে, তাঁকে উইন্ডি পয়েন্টে নিয়ে যাওয়া ছাড়া আর উপায় দেখছি না। শহরের একেবারে চূড়া সেটি, যেখান থেকে প্যানারোমা দৃষ্টি ফেলে একবারেই দেখে নেওয়া যাবে পুরো অ্যাডিলেডটাকে। তারপর সিদ্ধান্তে আসুন—অ্যাডিলেড আপনার কাছে ‘সিটি অব চার্চেস’, সিনিয়রদের শহর নাকি সিনিয়রদেরও ‘সিনিয়রের’ শহর।