ভারতের অধিনায়ক হিসেবে বিশ্বকাপ ট্রফি উঁচিয়ে ধরার অনুভূতি কেমন হবে, কাল অনুশীলনের ফাঁকে কি সেটাই ভাবছিলেন রোহিত শর্মা
ভারতের অধিনায়ক হিসেবে বিশ্বকাপ ট্রফি উঁচিয়ে ধরার অনুভূতি কেমন হবে, কাল অনুশীলনের ফাঁকে কি সেটাই ভাবছিলেন রোহিত শর্মা

ভুলোমনা রোহিতের অন্য মন্ত্র

রোহিত শর্মার ভুলোমন নিয়ে গল্পের শেষ নেই। হোটেল রুমে বা বাসে আইপ্যাড, ফোন রেখে যাওয়ার ঘটনা তো অসংখ্য, পাসপোর্টও ফেলে গেছেন কখনো কখনো। কিট ব্যাগ না নিয়ে ম্যাচে চলে যাওয়াটা অবশ্য ভুলে নয়।

২০০৪ সালে ওয়ার্ন-ম্যাকগ্রা-গিলক্রিস্টের সেই সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে রঞ্জি চ্যাম্পিয়ন মুম্বাইয়ের ম্যাচ। একটা অনূর্ধ্ব-১৯ ম্যাচে রোহিত শর্মার ব্যাটিং দেখে তাঁকে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে নামিয়ে দিতে বললেন সেই সময়ে মুম্বাইয়ের প্রধান নির্বাচক দিলীপ ভেংসরকার।

ম্যাচের দিন সকালে ব্রাবোর্ন স্টেডিয়ামে হাজির রোহিত শর্মা। তবে সঙ্গে কিট ব্যাগ নেই। বিস্মিত কোচ চন্দ্রকান্ত পণ্ডিতের প্রশ্নের জবাবে বললেন, ‘আমি তো আর খেলছি না।’ কিটব্যাগ নিয়ে এলে অবশ্যই খেলতেন। সেই ঘটনার ১৯ বছর পর বিশ্বকাপ ট্রফি আর রোহিত শর্মার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ওই অস্ট্রেলিয়াই। কিট ব্যাগ আনেননি বলে যাদের বিপক্ষে খেলা হয়নি ১৭ বছর বয়সী রোহিতের।

এক সময়ের তরুণ রোহিতের সামনে আজ ভারতের বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক হওয়ার হাতছানি

১৯ আর ১৭ যোগ করলেই বয়সটাও পেয়ে যাচ্ছেন। ৩৬ বছর বয়সে কোথায় একটু স্থিতধী হওয়ার কথা, উল্টো রোহিত শর্মার ব্যাটে এমন ঔদ্ধত্য, যা তারুণ্যের সঙ্গেই বেশি যায়। শুরুতেই প্রতিপক্ষ বোলিংকে এলোমেলো করে দেওয়ার যে মিশন নিয়ে নামছেন, তাতেই ভারতের অর্ধেক ম্যাচ জেতা হয়ে যাচ্ছে।

বিশ্বকাপ শুরু করেছিলেন শূন্য রান দিয়ে। এই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই। মাত্র ৬ বলের সেই ইনিংসে বোঝার উপায় ছিল না, রোহিত শর্মা কী ব্যাটিং-দর্শন নিয়ে খেলতে নেমেছেন এই বিশ্বকাপে। পরের ৯টি ইনিংসে যা পরিষ্কার। দল অবশ্য আগে থেকেই জানত। গত এশিয়া কাপের পরই একটা টিম মিটিংয়ে রোহিত শর্মা জানিয়ে দেন, বিশ্বকাপে তিনি শুরু থেকেই চালিয়ে খেলবেন। ইনিংস বড় হলে হবে, না হলে না, ইনিংসের সুরটা বেঁধে দেওয়াই হবে তাঁর কাজ। কোচ রাহুল দ্রাবিড় নিজে কখনো ধুমধাড়াক্কা ব্যাটিংয়ের অনুসারী ছিলেন না। তবে অধিনায়কের পরিকল্পনা অনুমোদন করে দেন। রোহিত শর্মা অবশ্য তাঁকে আশ্বস্ত করেছিলেন, যদি এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়, তাহলে তিনি প্রথাগত একটু সাবধানী ব্যাটিংয়ের লাইনে ফিরে আসবেন।

প্ল্যান-বিতে আর যেতে হয়নি। শূন্যের পরের ৯টি ইনিংস ১৩১, ৮৬, ৪৮, ৪৬, ৮৭, ৪, ৪০, ৬১, ৪৭। আর কিছু না জেনে শুধু স্কোরগুলো দেখলে কারও কাছে মনে হতেই পারে, সুযোগের কী নিদারুণ অপচয়! চারবার ৪০-এর ঘরে গিয়েও হাফ সেঞ্চুরির আগেই আউট। দুবার ৮০-এর ঘরে গিয়েও সেঞ্চুরি মিস। এই বিশ্বকাপে ১০ ইনিংসে ৫৫ গড়ে ৫৫০ রান যথেষ্টই ভালো। কিন্তু এতে কি আর রোহিত শর্মাকে ধরা যায়! সে জন্য দরকার স্ট্রাইক রেটে চোখ রাখা। যা ১২৪, বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি রান করা ১০ ব্যাটসম্যানের মধ্যে সর্বোচ্চ।

বিশ্বকাপে রোহিতকে ধুমধাড়াক্কা ব্যাটিংয়ের লাইসেন্স দিয়েছেন দ্রাবিড়

দলকে আগেই জানিয়ে দেওয়ার কারণ ছিল। নইলে যে ভুল বোঝার অবকাশ থাকত। হয়তো উইকেট বেশি ভালো বা বোলিং ভালো হচ্ছে না বলেই শুরুতেই অমন ঝড় তোলা। তাতে দলকে দিতে চাওয়া বার্তাটাও পৌঁছাত না। সেই বার্তা হলো, আমি তোমাদের কাজটা শুরুতেই সহজ করে দিচ্ছি। পরে তোমরা তোমাদের স্বাভাবিক খেলাটা খেললেই আমাদের হয়ে যাবে। গত বিশ্বকাপে ৫টি সেঞ্চুরি, এবার মাত্র একটি—তাতে কী আসে–যায়! অধিনায়ক তো নিজের জন্য খেলেন না। অন্যদের কাজটা সহজ করে দিতে পারলেই হলো। সঙ্গে দলের মানসিকতা বদলে দেওয়া। রানসংখ্যায় যা লেখা থাকে না।

নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেমিফাইনালে কোহলির রেকর্ডভাঙা সেঞ্চুরি, শ্রেয়াস আইয়ারের সেঞ্চুরিটা হয়তো আরও ভালো, পরে মোহাম্মদ শামির ৭ উইকেট...তারপরও সাবেক ইংল্যান্ড অধিনায়ক নাসের হুসেইনের চোখে ওই ম্যাচের আসল নায়ক রোহিত শর্মা। নকআউট ম্যাচে অমন ঝুঁকি নিতে সাহস লাগে। দেখতে বা স্বভাবে যতই ভোলাভালা মনে হোক, এই সাহস ব্যাপারটা রোহিতের মধ্যে বরাবরই ছিল। বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ছক্কা মারায় ক্রিস গেইলকে ছাড়িয়ে গেছেন (৫১ আর ৪৯)। ৫১ ছক্কার ২৮টিই আবার এই বিশ্বকাপে। এক বিশ্বকাপে এত ছক্কাও কেউ মারেননি এর আগে।

বিশ্বকাপ ট্রফির সঙ্গে এই দূরত্বটুকু আর রাখতে চাইবেন না রোহিত

নেতৃত্বের ধরনটা আবার ব্যাটিংয়ের চেয়ে একেবারেই আলাদা। যাঁর কাছ থেকে ব্যাটনটা নিয়েছেন, সেই বিরাট কোহলির ঠিক বিপরীত। কোহলি-শাস্ত্রীর কোলাহলময় ভারতীয় ড্রেসিংরুম রোহিত-দ্রাবিড়ের সময়ে একেবারেই শান্ত। দলের সবাইকে নিজেদের ভূমিকা বুঝিয়ে দিয়ে সাফল্য-ব্যর্থতায় তাঁদের পাশে থাকাটাই রোহিত শর্মার কাছে অধিনায়কত্বের প্রথম ও শেষ মন্ত্র।

শুরুর আগে বলেছিলেন, বিশ্বকাপটা জিততে পারলে ভালো হবে। ফাইনালের আগেও একই রকম অনুচ্চ স্বরে একই কথার পুনরাবৃত্তি। জিততে পারলে ভালো হবে। না জিততে পারলেই সব শেষ হয়ে যাবে না। আজ ট্রফিটা হাতে নিতে পারলে অধিনায়ক রোহিত শর্মার নেতৃত্বের মডেলটা আরও বিখ্যাত হয়ে যাবে।