শুবমান গিলকে আউট করার পর শ্রীলঙ্কার বাঁহাতি স্পিনার দুনিত ভেল্লালাগে
শুবমান গিলকে আউট করার পর শ্রীলঙ্কার বাঁহাতি স্পিনার দুনিত ভেল্লালাগে

ভেল্লালাগে আর ‘স্কুলবয় ক্রিকেটার’ নন

‘দুনিত ভেল্লালাগেকে কেমন দেখলেন? কাল (পরশু) তো খুব ভালো খেলল ছেলেটা...।’

অন্য কথা বলতে বলতে হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে গ্র্যান্ড সিনামন হোটেলের লবিতে হাঁটার গতি শ্লথ হয়ে এল চন্ডিকা হাথুরুসিংহের। ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, ‘বাচ্চা ছেলে, বয়স ১৯-২০ হবে। খুবই ভালো খেলল দেখলাম। ওকে আমি সেভাবে চিনি না, তবে ওর বাবা সম্পর্কে জানি। মোরাতুয়ার প্রিন্স অব ওয়েলস কলেজ দলের হয়ে খেলতেন।’

গত বছর জুনে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হওয়া ভেল্লালাগে শ্রীলঙ্কার স্কুল ক্রিকেট থেকে উঠে আসা সর্বশেষ বিস্ময়। শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটের উত্থানেই এখানকার স্কুল ক্রিকেটের আছে বড় অবদান। তার মধ্যে কলম্বোর সেন্ট জোসেফের মতো কিছু স্কুলের অবদান আবার একটু বেশি। শ্রীলঙ্কা অনূর্ধ্ব-১৯ দলের সাবেক অধিনায়ক ভেল্লালাগের আগে এই স্কুল থেকে শ্রীলঙ্কা জাতীয় দলে এসেছেন সাবেক অধিনায়ক অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসসহ আরও কয়েকজন। এখন তো ভেল্লালাগেও এই ২০ বছর বয়সেই অনেকের চোখে শ্রীলঙ্কার ভবিষ্যৎ অধিনায়ক! শ্রীলঙ্কা যুব দলের অধিনায়ক হিসেবেই নাকি সেই স্ফুলিঙ্গ দেখিয়েছেন ভেল্লালাগে।

গত বছর জুনে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আন্তর্জাতিক অভিষেকের পর এখন পর্যন্ত ১৩টি ওয়ানডে খেলে ভেল্লালাগের উইকেট ১৮টি। পরশু প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে ভারত শেষ পর্যন্ত ৪১ রানে জিতলেও একটা পর্যায়ে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলেন ভেল্লালাগে। প্রথমে বল হাতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের প্রথম ৫ উইকেট নিয়ে পরে ব্যাট হাতে ৪৬ বলে অপরাজিত ৪২ রানের ইনিংস আর ধনাঞ্জয়া ডি সিলভার সঙ্গে ৬৩ রানের জুটিতে আরেকবার।

এখন পর্যন্ত ১৩টি ওয়ানডে খেলে ভেল্লালাগের উইকেট ১৮টি

ভেল্লালাগের পাঁচ শিকারের মধ্যে বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা ছাড়াও ছিল লোকেশ রাহুল, শুবমান গিল আর হার্দিক পান্ডিয়ার উইকেট। স্বাভাবিকভাবেই কোহলি, রোহিতের উইকেটই সবচেয়ে বেশি তৃপ্তি দিয়েছে তাঁকে। পরশু রাতে ম্যাচ শেষের সংবাদ সম্মেলনে ভেল্লালাগে বলেছেনও সেটা। সঙ্গে বলেছেন, ‘ক্রিকেটার হিসেবে আমি মৌলিক কাজগুলোর ওপরই বেশি আস্থা রাখি আর বিশ্বাস রাখি নিজের ওপর।’

শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটে ভেল্লালাগে দৃষ্টি কাড়েন গত বছর অবজারভার এসএলটি মোবিটেল মোস্ট পপুলার স্কুল বয় ক্রিকেটারের স্বীকৃতি পেয়ে। বাবা সুরাঙ্গা ওয়ালেলাগা ছিলেন উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান, খেলেছেন মোরাতুয়ার প্রিন্স অব ওয়েলসের হয়ে। সুরাঙ্গা পরে ক্রিকেটে আর না থাকলেও ছেলে ঠিকই স্কুল ক্রিকেট ও বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের সিঁড়ি বেয়ে চলে এসেছেন শীর্ষ পর্যায়ে। পরশু ভেল্লালাগের খেলা দেখে মুগ্ধ তাঁর স্কুলজীবনের মেন্টর ও কোচ রজার বিজয়সুরিয়া স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, ‘সেন্ট জোসেফের আগে সে সেন্ট সেবাস্টিয়ানে পড়ত। ওই স্কুলের হয়েই একটা ম্যাচে আমি প্রথম ওকে দেখি। ব্যাট হাতে দারুণ টাইমিং ছিল ছেলেটার, বল হাতেও ভালো। এককথায় সহজাত প্রতিভা।’ 

বড় ক্রিকেটার হওয়ার ক্ষুধা ভেল্লালাগের মধ্যে তখনই আবিষ্কার করেছিলেন ১৯৮২ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার হয়ে চারটি টেস্ট খেলা সাবেক ক্রিকেটার বিজয়সুরিয়া। ভেল্লালাগে এই স্বপ্ন নিয়েই পরে সেন্ট সেবাস্টিয়ান থেকে চলে আসেন সেন্ট জোসেফে। তাঁর আগে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস ছাড়াও সেন্ট জোসেফ থেকে উঠে এসেছেন থিসারা পেরেরা, দিমুথ করুনারত্নের মতো ক্রিকেটাররা।

বিজয়সুরিয়া বলেছেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ক্রিকেটার হিসেবে বেড়ে উঠতে যত বেশি সম্ভব সুযোগ দেব ওকে। ছেলেটা কঠোর পরিশ্রমী ছিল, নিজের ক্যারিয়ার নিয়েও লক্ষ্য ছিল পরিষ্কার। আমরা শুধু তাকে সাহায্যই করেছি। স্কুল দলের হয়ে সে বড় বড় ইনিংস খেলত, নিয়মিত উইকেট নিত। ওর সময়ের অন্য ছেলেদের চেয়ে সে ছিল দুই-তিন ধাপ এগিয়ে।’

ভারতের বিপক্ষে ৪২ রানে অপরাজিত ছিলেন ভেল্লালাগে

অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ হয়ে এখন জাতীয় দলেও ভেল্লালাগে নিজেকে চেনাতে শুরু করেছেন। হাথুরুসিংহের চোখে যেটা শ্রীলঙ্কার স্কুল ক্রিকেটেরই অবদান। যদিও ম্যাথুস-ভেল্লালাগেদের সেন্ট জোসেফের চেয়ে নিজের স্কুলকেই বেশি এগিয়ে রাখছেন বাংলাদেশের শ্রীলঙ্কান কোচ, ‘আমার স্কুলের নামটা ভুলে যাচ্ছেন কেন! আমি ছিলাম আনন্দ কলেজে, এখান থেকে ১০-১৫ মিনিটের পথ। আনন্দ কলেজ থেকে শ্রীলঙ্কা দলে ২৮ জন টেস্ট ক্রিকেটার এসেছে। সেটাও অর্জুনা রানাতুঙ্গা, মারভান আতাপাত্তু, দীনেশ চান্ডিমালের মতো ক্রিকেটাররা। আমার চোখে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটে আনন্দের অবদানই সবচেয়ে বেশি।’

স্কুল ক্রিকেট থেকে শীর্ষ পর্যায়ে উঠে আসা শ্রীলঙ্কানদের মধ্যে এ নিয়ে নিশ্চয়ই স্বাস্থ্যকর বিতর্ক আছে। সবার কাছে কোনো না কোনো দিক দিয়ে তো তার স্কুল বা কলেজই সেরা। তবে এত বছর ধরে স্কুল ক্রিকেটই যে দেশটার ক্রিকেটকে শক্ত ভিত দিয়ে যাচ্ছে, তার সর্বশেষ উদাহরণ তো দুনিত ভেল্লালাগেই, ‘স্কুলবয় ক্রিকেটার’ থেকে যিনি এখন স্বপ্ন দেখেন আরও বড় কিছুর। এ নিয়ে নিশ্চয়ই শ্রীলঙ্কানদের মধ্যেও কোনো বিতর্ক নেই।