বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার গল্প যেন হতাশার কালিতে লেখা
বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার গল্প যেন হতাশার কালিতে লেখা

নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকা

অন্তহীন যে বেদনার কপাট ভাঙা যায়নি

ছয়বার সেমিফাইনাল থেকে শূন্য হাতে ফেরার পর ফাইনালের দেখা পেয়েছে নিউজিল্যান্ড। টানা দুই ফাইনালেই অবশ্য হারতে হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতি বিশ্বকাপ তো আরও বৈরী। বিচিত্র সব কারণ ভেঙে দিয়েছে তাদের বিশ্বকাপ–স্বপ্ন।

ফুটবলে কষ্টের রংটা যদি কমলা হয়, ক্রিকেটে সেটি কখনো কালো, আবার কখনো হলুদাভ সবুজ। নেদারল্যান্ডসের বিশ্বকাপ জিততে না পারা যেমন ফুটবলের চিরন্তন দুঃখগাথাগুলোর একটি, ক্রিকেটে নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার গল্পটাও তা–ই। পুরো গল্পটা যেন হতাশার কালিতে লেখা। যেখানে কাছে গিয়েও বিবর্ণ মুখে ফিরে আসাটাই নিয়তি।

‘অনেক বছর কেটে গেছে,/ আরও কিছুদিন চলে যাবে;/ ফুরিয়ে ফেলেছি নীড় শিশির অনেক,/ আরও রৌদ্র আকাশ ফুরাবে,/ অনেক চিহ্নিত গাছ মাছ স্তম্ভ জনতা বন্দর/ আছে, তবু কাছে নেই আর; মনন আভার মতো/ ঘিরে রেখেছে অন্ধকার।’

বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকা ও নিউজিল্যান্ডের ইতিহাস খুঁড়তে গেলে জীবনানন্দ দাশের জীবনবেদ কবিতার শুরুর এই লাইনগুলো যেন বারবার মনে পড়ে। যদিও জীবনানন্দ নিজেই বলেছেন, ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে।’ ভালো হয়তো কেউ বাসে না। কিন্তু চার বছর পরপর বিশ্বকাপ নামক ‘হেভেনস’ যখন দরজায় নক নক করতে থাকে, তখন শীতের অসুখের মতো জেঁকে বসে এসব বেদনাগাথা। যে বেদনার কপাট ভেদ করে কখনো স্বর্গে প্রবেশের অনুমতি পায়নি এ দুটি দল।

২০১৯ বিশ্বকাপ ফাইনালে মর্মান্তিক হার দেখতে হয়েছিল নিউজিল্যান্ডকে

নিউজিল্যান্ডের কথাই আগে বলা যাক। কিউইদের বিশ্বকাপ-যাত্রাটাই যেন ট্র্যাজিক কোনো মহাকাব্যের মঞ্চায়ন। কখনো সেটি সিনেমার শেষ দৃশ্যে প্রতি-নায়কের একপেশে হারের মতো, আবার কখনো ট্রোজান বীর হেক্টরের মতো লড়াই করে হারের। চিত্রায়ণটা যেমনই হোক, পরিণতিটা কেবল পরাজয়ের কালিতেই লেখা।

সাদা বলে সর্বশেষ পাঁচ বিশ্বকাপের তিনটিতে ফাইনালে উঠে একবারও ট্রফি হাতে নেওয়া হয়নি কিউইদের। আদৌ হবে কি না, সে প্রশ্নের উত্তর সময়ের হাতে তোলা। তবে যা হাতছাড়া হয়েছে, তা শুধু মন খারাপের গল্পই।

এর মধ্যে সর্বশেষ ওয়ানডে বিশ্বকাপ তো বেদনার তুলনাহীন এক গাথা। ২০১৯ বিশ্বকাপ ফাইনাল হেরে কিউই অলরাউন্ডার জিমি নিশাম উত্তর প্রজন্মকে পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, ‘বাচ্চারা খেলাধুলাকে পেশা বানিও না।’ সেদিন চাপ সামলাতে না পেরে খেলা চলাকালেই মারা গিয়েছিলেন নিশামের কোচ। এসব বেদনার প্রকাশযোগ্য কোনো ভাষা হয় না। নিউজিল্যান্ডের জন্য সেই ম্যাচটি যন্ত্রণার সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকলেও সেটিই কিন্তু একমাত্র নয়। দুঃখরজনীর শুরু আরও আগে।

একটা সময় ছিল, যখন নিউজিল্যান্ডকে বলা হতো ‘সেমিফাইনালের দল’। স্যার রিচার্ড হ্যাডলি, মার্টিন ক্রো, স্টিভেন ফ্লেমিংরা পারেননি দেশকে ফাইনালে তুলতে। প্রথম ১০ ওয়ানডে বিশ্বকাপের ৬টিতেই সেমিফাইনাল থেকে বিদায়। ব্রেন্ডন ম্যাককালামের অধিনায়কত্বে ২০১৫ বিশ্বকাপে প্রথম ফাইনাল, যেটিতে তাসমান প্রতিবেশী অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে পাত্তাই পেল না তারা।

২০১৫ বিশ্বকাপ ফাইনালে উঠেও শিরোপার দেখা পায়নি নিউজিল্যান্ড

আর পরের ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালের বেদনার কথা তো আগেই বলা হয়েছে। যে ফাইনালের গল্পটা যেন বেন স্টোকসের ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ হয়ে ওঠা’র। যেখানে তাদের শিরোপা হারাতে হয়েছে বাউন্ডারি কম মারার কারণে, ভাবা যায়!

প্রজন্মের পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই মূলত একসময় নতুন দিনের গানও শুনতে শুরু করে নিউজিল্যান্ড। আগের প্রজন্মে ফ্লেমিং, ম্যাকমিলান, অ্যাস্টল, কেয়ার্নস কিংবা হ্যারিসরা যা করতে পারেননি, সেটাই করে দেখানোর প্রত্যয় নিয়ে ক্রিকেট মঞ্চে আবির্ভাব ঘটে ম্যাককালাম, টেলর, সাউদি, বোল্ট, উইলিয়ামসন, গাপটিলদের। ড্যানিয়েল ভেট্টোরি, ম্যাককালাম আর টেলর আবার ছিলেন দুই প্রজন্মের সেতুবন্ধ। সেমিফাইনালের বাধা পেরিয়ে ফাইনাল খেলে বিদায় নিয়েছেন কিউই ক্রিকেটের এই তিন তারকা। কে জানে, শিরোপার কাছাকাছি গিয়েও শেষ পর্যন্ত জিততে না পারার বেদনা হয়তো এখনো তাড়া করছে তাঁদের।

গল্পটা ভিন্ন হলেও দক্ষিণ আফ্রিকার পরিণতিটাও একই। তবে কার বেদনার ভার বেশি, তা বলা বেশ কঠিন। বর্ণবাদী নীতির কারণে প্রায় ২২ বছর নির্বাসিত ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। ১৯৯২ সালে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপ দিয়ে শুরু করে যাত্রা। তবে দিনের সূর্য যেমন সকালের পূর্বাভাস দেয়, তেমনি প্রথম বিশ্বকাপেই খোদাই হয়ে গিয়েছিল প্রোটিয়াদের বিশ্বকাপ-ভাগ্য। সেবার সেমিফাইনালে গিয়ে ভাগ্য তাঁর নির্মম রূপটা দেখায় দক্ষিণ আফ্রিকাকে। বৃষ্টির কারণে ১৩ বলে ২২ রানের সমীকরণ হয়ে যায় ১ বলে ২২। ১২ মিনিটের বৃষ্টি সেদিন রীতিমতো ঘূর্ণিঝড় বইয়ে দিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা শিবিরে। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে অবশ্য ভাগ্য নয়, দক্ষিণ আফ্রিকার বিদায়ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছিলেন ব্রায়ান চার্লস লারা নামের ক্রিকেটের এক বরপুত্র।

১৯৯৯ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ডোনাল্ড ও ক্লুজনারের সেই আত্মঘাতী দৌড়

ইংল্যান্ডে ১৯৯৯ বিশ্বকাপে যতটা না ভাগ্য, তার চেয়ে বেশি ছিল চাপ সামলাতে না পেরে চোক করা। সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শেষ দিকে ঝড় তুলে দলকে জয়ের কাছাকাছি নিয়ে যান ল্যান্স ক্লুজনার। শেষ পর্যন্ত লক্ষ্য গিয়ে দাঁড়ায় ৪ বলে ১ রান। আর অস্ট্রেলিয়ার প্রয়োজন ছিল ১ উইকেট। কিন্তু এরপর সব এলোমেলো করে বসেন সেই ক্লুজনারই। ভুতুড়ে এক দৌড় দিয়ে দেখেন নন স্ট্রাইকে থাকা অ্যালান ডোনাল্ড জায়গাতেই দাঁড়ানো। দক্ষিণ আফ্রিকার যখন অলআউট হয়, তখনো বাকি দুই বল। একে কী বলা যায়—দুর্ভাগ্য নাকি আহাম্মকি!

পরেরটা অবশ্য নিশ্চিতভাবেই আহাম্মকিই। বলছি ২০০৩ সালের বিশ্বকাপের কথা। গ্রুপ পর্বের সে বাঁচা-মরার ম্যাচে উসকানিটা অবশ্য বৃষ্টিই দিয়েছিল। ডাকওয়ার্থ-লুইসে প্রোটিয়াদের লক্ষ্য দাঁড়ায় ৪৫ ওভারে ২৩০ রানের। হিসাব ভুল করে অধিনায়ক শন পোলক মাঠে বার্তা পাঠান ২২৯ রানের। মুত্তিয়া মুরালিধরনকে ছক্কা মেরে ২২৯ রানে পৌঁছেও দেন মার্ক বাউচার। আর শেষ বলটি করেন ব্লক। উদ্‌যাপন করার পর জানতে পারেন ভুল হিসাবের কথা।

এরপর ২০১১ সালে আকস্মিক ব্যাটিং–বিপর্যয়ে বিদায়ের পর ২০১৫ সেমিফাইনালে আবারও বৃষ্টি, আবারও শেষ ওভারে গিয়ে হার। আর ২০১৯ সালে অসহায় আত্মসমর্পণ। ১৯৯২ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত প্রতিটি বিশ্বকাপে পথটা যেমনই হোক, দক্ষিণ আফ্রিকার পরিণতিটা একই। হতাশার এবং না পাওয়ার। এবার কি ভাগ্য বদলাবে? বিশ্বকাপে জায়গা পাওয়ার পথে তাদের দুর্ভাগ্যের প্রতীক বৃষ্টি কিন্তু উল্টো রূপ দেখিয়েছে। বাধা দেওয়ার বদলে তাদের পরের পর্বে যেতে সহায়তা করেছে। তবে চূড়ান্ত লড়াইয়ে বৃষ্টি তার দায় শোধ করে কি না, দক্ষিণ আফ্রিকা নিজেদের গা থেকে চোকার্স তকমাটা ঝেড়ে ফেলতে পারে কি না, এটাই দেখার।

২০১৫ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে বৃষ্টি ও শেষ ওভারে হারতে হয় দক্ষিণ আফ্রিকাকে

দক্ষিণ আফ্রিকা ও নিউজিল্যান্ডকে নিয়ে এসব কথা অবশ্য নতুন কিছু নয়। প্রতিবার বিশ্বকাপের আগেই এসব আলাপ সামনে আসে। কিন্তু কোনোবারই ভিন্ন আলাপের কোনো উপলক্ষ মেলে না। পরেরবার কি মিলবে, নাকি বিশ্বকাপ এই দুই দলের জন্য মৃত্যুর আগ মুহূর্তে বিশ্বখ্যাত ডাচ চিত্রশিল্পী ভ্যান গঘের শেষ কথাটির মতো হয়ে থাকবে? মৃত্যুর ঠিক আগ মুহূর্তে ভ্যান গঘ বলেছিলেন, ‘দ্য স্যাডনেস উইল লাস্ট ফর এভার।’