সাকিব আল হাসান
সাকিব আল হাসান

সাকিবের বিশের বাঁশি কি এখানেই থামল

কানপুরে সংবাদ সম্মেলনে হাসিমুখেই সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন সাকিব আল হাসান। তখনো বোঝা যায়নি, কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝড় উঠবে গ্রিন পার্কের সংবাদ সম্মেলনকক্ষে।

সাকিব টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর ঘোষণার পর সেই ‘ঝড়’টা উঠল! সংবাদকর্মীদের আলোচনা, ফিসফাস এবং চারদিক থেকে ধেয়ে আসা প্রশ্নে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিটা সংবাদ সম্মেলনের অডিও শুনেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। সাকিব সেই ঝড়ের কেন্দ্রবিন্দু, আর ঝড়ের কেন্দ্র যে শান্ত থাকে সেটা মোটামুটি সবারই জানা। সাকিবও শান্ত ছিলেন।  

আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি শুরুর এক বছর পর ২০০৬ সালে সাকিবের এই সংস্করণে অভিষেক। একটু বয়স্ক ক্রিকেটপ্রেমীরা মাত্রই স্মরণ করতে পারবেন, সে সময় সাকিবকে নিয়ে বলা হচ্ছিল ব্যাটিং-বোলিংয়ে দক্ষ হওয়ায় সাকিব ‘ইউটিলিটি ক্রিকেটার।’ টি-টোয়েন্টিতে তো এমন ক্রিকেটারই চাই!

১৮ বছর পর সেই সাকিব আজ কানপুরে সংবাদ সম্মেলনে যখন জানিয়ে দিলেন, সর্বশেষ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই বাংলাদেশের হয়ে শেষ ম্যাচটা খেলে ফেলেছেন, তখন কুড়ি-কুড়ির এই ক্রিকেটে তাঁর ক্যারিয়ারে তাকিয়ে আমরা কি দেখি? ১২৯ টি-টোয়েন্টিতে ১২৭ ইনিংসে ২৫৫১ রান, গড় ২৩.১৯ এবং স্ট্রাইকরেট ১২১.১৮। বোলিংয়ে ১২৬ ইনিংসে পেয়েছেন ১৪৯ উইকেট। ৬.৮১ ইকোনমি রেটে বোলিং গড় ২০.৯১ ও স্ট্রাইক রেট ১৮.৪। ২০ রানে ৫ উইকেট ইনিংসে সেরা বোলিং।

বাংলাদেশের ক্রিকেটকে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছেন সাকিব

কিন্তু এসবই তো স্রেফ পরিসংখ্যান। সংখ্যা যেমন কখনো মিথ্যা বলে না, তেমনি এই সংখ্যাই সব সময় সবকিছু বোঝাতে পারে না। যেমন ধরুন, কেউ কেউ এরই মধ্যে হয়তো আক্ষেপ করতে শুরু করেছেন, টি-টোয়েন্টিতে ১৫০ উইকেট নিয়েও অবসর নিতে পারত!

আমার তো মনে হয়, টি-টোয়েন্টিতে আমার শেষ ম্যাচ খেলে ফেলেছি বিশ্বকাপে।
সাকিব আল হাসান, কানপুরে আজ সংবাদ সম্মেলনে

সাকিব কেন পারেননি কিংবা চাননি, সেসব তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে তৃতীয় সর্বোচ্চ উইকেটশিকারিকে একটা স্যালুট জানাতেই পারে। মাত্র ১৫ উইকেট বেশি নিয়ে সবার ওপরে নিউজিল্যান্ডের টিম সাউদি। দ্বিতীয় রশিদ খানের সঙ্গে ব্যবধান মাত্র ৩ উইকেটের। আক্ষেপটা তাই জাগবেই। তবে গব৴ও কম নেই। এই সংস্করণে সাকিব ছাড়া আর কারও ২ হাজার রান ও ১০০ উইকেটে ‘ডাবল’ নেই।

২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর টি-টোয়েন্টি অলরাউন্ডারদের র‌্যাঙ্কিংয়ে প্রথম শীর্ষে ওঠেন সাকিব। পরের বছর ১২ জানুয়ারি প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে একই সঙ্গে তিন সংস্করণেই অলরাউন্ডারদের র‌্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে ওঠেন। সাকিব টি-টোয়েন্টিতে সবচেয়ে বেশি সময় অলরাউন্ডারদের র‌্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে ছিলেন ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত। এ বছর জুনে সর্বশেষ আবারও উঠে এসেছিলেন শীর্ষে।

ছয় মাস-এক বছর পরে যদি বিসিবি মনে করে আমার টি-টোয়েন্টিতে কন্ট্রিবিউট করার সুযোগ আছে, আমি পারফর্ম করছি এবং ফিট আছি, এরপর আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি।
সাকিব আল হাসান, টি–টোয়েন্টিতে অবসর ঘোষণার পর ফেরা প্রসঙ্গে

আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতেও সাকিবের মতো দীর্ঘ ক্যারিয়ার আর কারও নেই। ১৭ বছর ২০৯ দিনের এই ক্যারিয়ার যেন আনন্দ-বেদনারই উপাখ্যান। দেশের হয়ে একই সঙ্গে তিনটি সংস্করণ খেলার চাপ নিয়েই সংক্ষিপ্ত সংস্করণে দীর্ঘতম ক্যারিয়ার গড়েছেন সাকিব। টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নেওয়া জিম্বাবুয়ের শন উইলিয়ামস এ তালিকায় দ্বিতীয় (১৭ বছর ১৬৬ দিন)। কিংবা এই সংস্করণে এক ভেন্যুতে সর্বোচ্চ উইকেট নেওয়ার তালিকায়ও সাকিব শীর্ষে। মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ৩৪ ম্যাচে নিয়েছেন ৪৫ উইকেট। বাংলাদেশেরই মোস্তাফিজুর রহমান একই ভেন্যুতে ২টি উইকেট কম নিয়ে দ্বিতীয়।

আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ৮ বার ৪ উইকেট নিয়েছেন, এই রেকর্ডে তাঁর ওপরে আছেন শুধু আফগানিস্তানের রশিদ খান—৯ বার। এই সংস্করণে সাকিবের চেয়ে বেশি বল করেছেন শুধু নিউজিল্যান্ডের টিম সাউদি। সাউদি করেছেন ২৭৫৩ বল, সাকিব করেছেন ২৭৪৫ বল। টি-টোয়েন্টিতে ব্যাটসম্যানদের সবচেয়ে বেশিবার  স্টাম্পড আউট করার রেকর্ডটাও সাকিবের—১৯ বার। টি-টোয়েন্টিতে ৫ বার সিরিজসেরা হয়েছেন সাকিব, এই রেকর্ডে তাঁর ওপরে আছেন শুধু ভারতের বিরাট কোহলি—৬ বার।

সাকিব তো এরই মধ্যে বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার। তবে বয়সের ভার কিংবা যে কারণেই হোক, সর্বশেষ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভালো করতে পারেননি। ৭ ম্যাচের ৬ ইনিংসে বোলিং করে নিয়েছিলেন ৩ উইকেট। ইকোনমি রেট ৭.৫০। ব্যাটিংয়ে ৭ ইনিংসে ১৮.৫০ গড়ে করেছেন ১১১ রান। সর্বোচ্চ অপরাজিত ৬৪। গত জুনে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে কিংস্টনে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটাই হয়ে রইল এই সংস্করণে দেশের হয়ে সাকিবের শেষ ম্যাচ। কারণটা এতক্ষণে নিশ্চয়ই জানা। কানপুর টেস্টের আগে আজ সংবাদ সম্মেলনে সাকিব বলেছেন, ‘আমার তো মনে হয়, টি-টোয়েন্টিতে আমার শেষ ম্যাচ খেলে ফেলেছি বিশ্বকাপে।’

তবে কথায় একটি ফাঁকও রেখেছেন। জানিয়েছেন, পরবর্তী সময়ে দেশের প্রয়োজনে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে আবার ফিরতেও পারেন, ‘ছয় মাস-এক বছর পরে যদি বিসিবি মনে করে আমার টি-টোয়েন্টিতে কন্ট্রিবিউট করার সুযোগ আছে, আমি পারফর্ম করছি এবং ফিট আছি, এরপর আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি।’

ভক্তরা নিশ্চয়ই মনে মনে এই অপেক্ষাই করবেন। ততক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশের হয়ে থামল সাকিবের বিশের বাঁশি।