‘আমি টাকা দিতে পারব না। তুই একা কী করবি, কর!’
ছোট মেয়েকে রেগেমেগে বলেছিলেন আইমুল্লাহ। মেয়ের অপরাধ, সে ক্রিকেটার হতে চায়। অপরাধই তো! যে বাড়িতে নুন আনতে পান্তা ফুরায়, সে পরিবারের ছোট মেয়ের কাজকর্ম বাদ দিয়ে ক্রিকেটার হতে চাওয়া গরিবের ঘোড়া রোগ ছাড়া তো আর কিছুই নয়!
বেশি নয়, মাত্র চার বছর আগে মারুফা আক্তারের জীবনের কথা বলা হচ্ছে। আজ সেই মেয়েটা ঘাত-প্রতিঘাত জয় করে, দারিদ্র্যের মহাসাগর পাড়ি দিয়ে গত জুনে মেয়েদের ঢাকা প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগে হয়েছেন সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। লিগে তাঁর দল বিকেএসপি তৃতীয় হলেও ১১ ম্যাচে তাঁর উইকেট ২৩টি। দশম শ্রেণিপড়ুয়া মেয়ের মাথায় উঠেছে টুর্নামেন্টের সেরা উদীয়মান খেলোয়াড়ের মুকুটও। তারই পুরস্কার হিসেবে এবার মেয়েদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের জন্য ঘোষিত ১৫ জনের দলেও ডাক পেয়েছেন মারুফা আক্তার।
চেহারায় এখনো কৈশোরের ছাপ। কিন্তু বলটা হাতে গেলেই পরিণত এক ডান হাতি পেস বোলারের অবয়ব ফুটে ওঠে ১৬ বছরের মেয়েটার মধ্যে। বল হাতে নিয়ে ট্রাউজারে অনেকক্ষণ ‘শাইন’ করিয়ে শূন্যে বল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গ্রিপ ঠিক করে নেন। এরপর দুই কদম দৌড়ে ছোট্ট একটা লাফ, আবার সাত কদম দৌড়, তারপর পিচের ওপর আছড়ে ফেলেন বলটা। বল হাতে প্রতিটি কদমে যেন সব বাধা উপড়ে ফেলার অদম্য স্পৃহা
সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি হওয়ার পথে এক ম্যাচে সর্বোচ্চ ৭ উইকেট পেয়েছেন মারুফা। গুলশান ইয়ুথ ক্লাবের বিপক্ষে ম্যাচে দলকে জেতানোর পথে ৯ ওভারে রান দিয়েছিলেন মাত্র ১৫।
পরিসংখ্যানে চোখ রাখলে লেজের দিকে মারকুটে ব্যাটারের প্রতিশ্রুতিও পাওয়া যায় তাঁর ব্যাটে। ৬ ইনিংস ব্যাট করে ১৯.৮৩ গড়ে ১১৯ রান। এর মধ্যে সিটি ক্লাবের বিপক্ষে ৪৮ বলে ৬৩ রানের একটা ইনিংস আছে।
আরও একটি তথ্য যোগ করলে বোঝা যাবে মারুফার আগমনী বার্তার ব্যাপ্তি। মাত্র দ্বিতীয়বারের মতো মেয়েদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্রিকেটে খেলেছেন তিনি। ‘দ্বিতীয়বার’ কথাটাও ব্যাখ্যার দাবি রাখে। কারণ, আগেরবার ‘পিলু স্যার’-এর সহায়তায় মোহামেডানে নাম লিখিয়ে একটিমাত্র ম্যাচ খেলে মাত্র ২ বল ব্যাটিং করার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর। রান করেছিলেন ৪। মারুফা যে বলও করতে জানেন, সেটা তো তখন ভালো করে জানাই ছিল না মোহামেডান কোচিং স্টাফের!
গত বছর বিকেএসপিতে ভর্তি হয়েই মারুফার জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু। বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়া নিয়েও কম নাটক হয়নি। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ভর্তির জন্য নির্বাচিত খেলোয়াড় তালিকায় নাম ছিল তাঁর, কিন্তু অর্থাভাবে আর বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়া হয়নি। একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে উঠতি মারুফার দৈন্যদশার ব্যাপারটি নজরে আসে বিসিবির। অবশেষে গত বছর বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সহায়তায় নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন মারুফা
প্রিমিয়ার লিগে সাফল্যের পর মারুফার চোখ এখন অনেক দূরে, ‘বোলিংয়ে আমি জাহানারা আপুকে অনুসরণ করি। আমার লক্ষ্য ছিল তাঁর চেয়ে বেশি উইকেট পাওয়া, সেটা পেয়েছি। এখন আমি জাতীয় দলের বোলিংয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার স্বপ্ন দেখি।’ মেয়েদের ক্রিকেটে তো জাহানারাকে অনুসরণ করেন, ছেলেদের বোলিংয়ে মারুফার আদর্শ কে? উত্তরটা ঠোঁটের ডগায় এসেই ছিল—মোস্তাফিজুর রহমান
নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার ঢেলাপীর এলাকার কৃষক পরিবার থেকে উঠে আসা মারুফার। মা-বাবা, চার ভাই-বোনসহ ছয়জনের বড় পরিবার। ছয়টি মুখের আহার জোগাড় করতেই বর্গাচাষি বাবা আইমুল্লাহর ঘাম ছুটে যায়। সে পরিবারে মেয়ে বাবার সঙ্গে কৃষিকাজ করবে, গরু দেখাশোনা করবে, গরুর খাবার জোগান দিতে বাড়ির পাশের জমিতে ঘাস চাষ করবে—এটাই তো বাবার চাওয়া। স্কুলের হয়ে ফুটবল খেলার পাশাপাশি সে কাজগুলো ছোটবেলা থেকে করেই এসেছেন মারুফা। এলাকায় আপন বড় দুই ভাইয়ের সঙ্গে খেলেছেন ক্রিকেটও।
ক্লাস সিক্সে উঠে মারুফা বায়না ধরেন প্রতিবেশী চাচা নাজমুল হুদার সঙ্গে সৈয়দপুরে গিয়ে কোচ ইমরানের কাছে ক্রিকেট বলে অনুশীলন করার। মা–বাবার আপত্তি ছিল। তা উপেক্ষা করেই ২০১৮ সালে বিকেএসপির প্রতিভা অন্বেষণ ক্যাম্পের মধ্য দিয়ে বিকেএসপির নজরে আসা। আর্থিক কারণে সেখানে ভর্তি হতে না পারলেও খুলনা বিভাগীয় দলে সুযোগ পান। ২০১৯ সালে জায়গা করে নেন অনূর্ধ্ব-১৯ জাতীয় দলের ক্যাম্পে। করোনার কারণে বয়সভিত্তিক দলের ক্যাম্প স্থগিত হয়ে গেলে আবার বাড়ি ফিরে বাবার সঙ্গে কৃষিকাজ
যেটির অন্য মূল্যও খুঁজে পান মারুফা। বিকেএসপির মাঠে দাঁড়িয়ে সেটাই বলছিলেন, ‘আমি যে অনেক পরিশ্রম করতে পারি, এটা কৃষিকাজ করার জন্যই। এখনো বাড়িতে গেলে মই দিই, মাটি সমান করি।
এখনই বোঝেন পরিবারের বড় দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। এমন কঠোর পরিশ্রমী, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শিষ্যকে নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখছেন বিকেএসপির কোচ ফাতেমা তুজ জোহরাও, ‘ভালো খেলে পরিবারের দায়িত্ব নেওয়ার ভাবনা এখনই ওর মধ্যে কাজ করে। এটা খুবই ইতিবাচক।
মারুফার বোলিংয়ের শক্তির দিকটাও বললেন জোহরা, ‘মেয়েটার মধ্যে প্রকৃতিগত শক্তি আছে। জোরে বল করতে পারে। সঙ্গে সুইংয়ের সমন্বয় করতে শিখেছে। ইনসুইংটা তো খুবই ভালো। ম্যাচের চাপ নেওয়া শিখতে পারলে অনেক দিন জাতীয় দলকে সাহায্য করতে পারবে।
এত দিন মারুফার ভাবনায় ছিল আগামী বছর জানুয়ারিতে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া অনূর্ধ্ব-১৯ নারী বিশ্বকাপ। তবে এখন যেহেতু জাতীয় দলে ডাক পেয়ে গেছেন, সেই ভাবনা এবং লক্ষ্য দুটোই নিশ্চয়ই আরও বড় হয়েছে মারুফার।