ফাইনালের আগে ট্রফি নিয়ে দুই অধিনায়কের আনুষ্ঠানিক ছবি তোলাটাই বিশ্বকাপ ক্রিকেটের রীতি। আহমেদাবাদের উপকণ্ঠের ছোট শহর আদালাজের ঐতিহাসিক পাঁচতলা কূপের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কাল সেই আনুষ্ঠানিকতা সারলেন ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক রোহিত শর্মা ও প্যাট কামিন্স।
ফাইনালের আগে ট্রফি নিয়ে দুই অধিনায়কের আনুষ্ঠানিক ছবি তোলাটাই বিশ্বকাপ ক্রিকেটের রীতি। আহমেদাবাদের উপকণ্ঠের ছোট শহর আদালাজের ঐতিহাসিক পাঁচতলা কূপের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কাল সেই আনুষ্ঠানিকতা সারলেন ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক রোহিত শর্মা ও প্যাট কামিন্স।

ভারত থেকে উৎপল শুভ্র

ফাইনালে দুই দলের অন্য দুই প্রতিপক্ষ

বিশ্বকাপ ফাইনালও তো আরেকটা ক্রিকেট ম্যাচই, তাই না? সেই ব্যাটে-বলের লড়াই। শেষে গিয়ে এক দলের বিশ্বজয়ের আনন্দ। আরেক দলের সব হারিয়ে ফেলার হতাশা।

‘বিশ্বজয়’ কথাটা বাড়তি, নইলে প্রতিটি ক্রিকেট ম্যাচেরই কি এই একই গল্প নয়! বিশ্বকাপ ফাইনালও আরেকটা ক্রিকেট ম্যাচই।

বললেই হলো!  

এসব সময়ে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান মার্ক্সবাদী দার্শনিক ও ক্রিকেট লেখক সিএলআর জেমসের অমর সেই কথাটা মনে পড়ে যায়। যারা শুধু ক্রিকেট জানে, তারা ক্রিকেটের কী জানে!

কথাটা একটু ঘুরিয়ে এখানেও বলা যায়। যারা শুধু বিশ্বকাপ ফাইনাল জানে, তারা বিশ্বকাপ ফাইনালের কী জানে! শুধু ব্যাট-বলের লড়াই-ই কি এর নির্ধারক নাকি! আহমেদাবাদের দৈত্যাকার নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামের প্রেসবক্সে বসে যখন লিখছি, ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে সামনে তাকাতেই সেই ‘আরও কত কিছু’র টুকরা টুকরা ছবি দেখা যাচ্ছে। মাঠের এক পাশে মঞ্চ বানানো হয়েছে। বাজছে গান। গ্যালারিতে চলছে আলোর খেলা। ফাইনালের পর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের মহড়া। প্রায় দেড় মাস আগে যে মাঠে একটা প্রশ্নের উত্তর খোঁজা শুরু হয়েছিল, আজ সেই মাঠেই পাওয়া যাবে এর উত্তর। ২০২৩ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন কোন দল?

মাঠে যা হচ্ছে, তা তো চোখেই দেখা যায়। যা হবে, সেটিও। কিন্তু সেটিই কি সব! আজ ভারত-অস্ট্রেলিয়া ফাইনালে অদৃশ্য আরও অনেক কিছুই কি থাকবে না! আশা-হতাশা, স্বপ্নপূরণ-স্বপ্নভঙ্গ...এসব তো আসবে পরে। সবকিছুর আগে ‘চাপ’ নামে অদৃশ্য এক আততায়ী। যেটির সঙ্গে দুই দলের কমন লড়াই। ভারতেরই কি একটু বেশি?

ফাইনালের উইকেট দেখছেন ভারত অধিনায়ক রোহিত শর্মা। কাল নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে

নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামের মিডিয়া সেন্টারে ঢোকার রাস্তাতেই দুই পাশের দেয়ালে ছবি আর ছবি। এক পাশে ১৯৮৩। অন্য পাশে ২০১১। বিশ্বকাপ জয়ের পর ট্রফি হাতে কপিল দেবের পাশেই সেই দলের সব খেলোয়াড়ের ছবি। অন্য পাশে মহেন্দ্র সিং ধোনি আর তাঁর দল। ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপজয়ী দলের একটা ছবিও আছে ‘১৯৮৩’-এর পাশে। মাঝখানের পিলারে ট্রফি হাতে তিন বিশ্বকাপজয়ী দুই ভারতীয় অধিনায়কের ছবির কোলাজ বানিয়ে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। ৬০ ওভার, ৫০ ওভার ও ২০ ওভারের তিনটি বিশ্বকাপই জয়ের কৃতিত্ব আছে শুধু ভারতের।

কথা সত্যি। তার চেয়েও সত্যি, এই রেকর্ড আর কোনো দিনই ভাঙার নয়। ৬০ ওভারের বিশ্বকাপই তো আর নেই।

এই ছবিগুলোর পাশে ২০২৩ বিশ্বকাপের ছবিটাও যোগ করতে পুরো ভারত প্রত্যাশায় উন্মুখ হয়ে আছে, তা তো আর আপনাকে বলার দরকার পড়ছে না। উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটতে থাকা আহমেদাবাদ তো নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছি। বাকি ভারতের অবস্থা অনুমান করে নিতে হচ্ছে এবং তা অনুমান করা একটুও কঠিন কিছু নয়। অবস্থা দেখে মনে হতে বাধ্য, আজকের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়া নামেই ভারতের প্রতিপক্ষ। আসল প্রতিপক্ষের নাম প্রত্যাশার চাপ।

উইকেটের ছবি তুলছেন অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক প্যাট কামিন্স

রোহিত শর্মা যা সামলানোর সহজ একটা পথ বের করে নিয়েছেন। ফাইনালটাকেও অন্য দশটা ম্যাচের মতো মনে করলেই তো হয়। যে কারণে ফাইনালের আগে দলকে বিশেষ কিছু বলারও পরিকল্পনা নেই। কিছু যদি বলেনও, তা হবে এ রকম—এত দিন যেভাবে খেলে এসেছ, সেভাবেই খেলো সবাই। আর প্রত্যাশার চাপ? ভারতীয় ক্রিকেটারদের চেয়ে আর কাদের এর সঙ্গে বেশি পরিচয়! বিমানবন্দরে, হোটেলে সবাই তো বলেই যাচ্ছে, জিততে হবে, সেঞ্চুরি করতে হবে, ৫ উইকেট নিতে হবে। এসবে ভারতীয় ক্রিকেটারদের অভ্যাস হয়ে গেছে।

তা তো হয়েছেই। তবে বিশ্বকাপ ফাইনাল হলো বিশ্বকাপ ফাইনাল। রোহিত শর্মা তাঁর দলের খেলোয়াড়দের বললেন, এটাকে আর দশটা ম্যাচের মতোই ভাবো আর সবাই তা ভাবতে শুরু করল—এতই সহজ নাকি! আর দশটা ম্যাচের আগে ‘জিততেই হবে’ শোনা আর ফাইনালের আগে শোনা কি আর এক। এই ফাইনাল হেরে গেলে কত বছর সেই ক্ষত দগদগে হয়ে থাকবে, তা অনুমান করাও কঠিন।

যেমন দগদগে হয়ে আছে ২০০৩ বিশ্বকাপের জোহানেসবার্গ। এরপর ভারত আরেকটি বিশ্বকাপ জিতেছে। তবে সেটি তো আর অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে নয়। অস্ট্রেলিয়াকে ফাইনালে পাওয়ার দিন থেকেই বদলা-বদলা রব উঠেছে তাই।

বিশ্বকাপের ভেন্যু নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়াম

অন্য সব অনুষঙ্গ যদি ভুলেও যান, শুধুই একটা ক্রিকেট ম্যাচ হিসেবে বিবেচনা করলেও জিবে জল এনে দেওয়ার মতো এক ফাইনাল। যেটির এক দল এই বিশ্বকাপের সন্দেহাতীত সেরা। আরেক দল সেরা বিশ্বকাপ ইতিহাসের। ভেন্যুটাও যাতে যোগ করছে নতুন মাত্রা। এক লাখ ছুঁই ছুঁই দর্শকের ফাইনাল আগেও দেখেছে বিশ্বকাপ ক্রিকেট। ১৯৮৭ বিশ্বকাপে কলকাতার ইডেন গার্ডেনে অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড। ২০১৫ বিশ্বকাপে মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড। কিন্তু এক লাখ ছুঁই ছুঁই আর ১ লাখ ৩০ হাজার তো এক নয়। বাড়তি ৩০ হাজার তো অনেক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের মোট ধারণক্ষমতাই। এই ১ লাখ ৩০ হাজার দর্শক একসঙ্গে চিৎকার করলে তা কেমন গর্জনের রূপ নেয়, সেটির সঙ্গে এই বিশ্বকাপেই পরিচয় হয়েছে সবার। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের মতো আজও গ্যালারি শুধু এক দলের জন্যই চিৎকার করবে। প্রত্যাশার চাপ যদি ভারতের আসল প্রতিপক্ষ হয়, এই বিরুদ্ধ গ্যালারিকেও কি অস্ট্রেলিয়ার প্রতিপক্ষ বলা যায়? প্যাট কামিন্স মোটেই তা মনে করেন না। অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক বরং এটাকে অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়েছেন। সেটি কীভাবে?

কামিন্সের কথায় অস্ট্রেলিয়ানসুলভ অহম কখনোই প্রকাশ পায় না। বিশ্বকাপে এই প্রথম তাঁকে অস্ট্রেলিয়ান মনে হলো, যখন বললেন, গর্জনশীল গ্যালারিকে নীরব করে দেওয়ার মতো তৃপ্তিদায়ক আর কিছু নেই। সেটাই যে করতে চান, তা আর বললেন না। বলার দরকারও নেই।  

এই স্টেডিয়াম সর্বশেষ যে ম্যাচে ১ লাখ ৩০ হাজার দর্শকের সম্মিলিত গর্জন শুনেছিল, সেই ম্যাচও ফিরে এল ফাইনালের আগে। খেলা হবে যে সেই ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের উইকেটেই। মুম্বাইয়ে ভারতের সেমিফাইনাল ব্যবহৃত উইকেটে সরিয়ে নেওয়া নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। এখানে অবশ্য দেখা গেল, প্যাট কামিন্সও এটাকে কোনো ব্যাপার মনে করছেন না। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ হয়েছে ১ মাস ৫ দিন আগে, এটা তো অবশ্যই একটা কারণ। আরেকটা কারণ কি এটাও যে শুরুতে বিবর্ণ অস্ট্রেলিয়া অভ্যাসমতো ফাইনালে ওঠার পর কোনো কিছুকেই আর ব্যাপার মনে করছে না!