খেলা যদি দেখে থাকেন, মোহাম্মদ নাঈমের আউটটা নিশ্চয়ই চোখে ভাসছে এখনো। দাসুন শানাকার ওরকম একটা নিরীহ দর্শন বাউন্সারেও এই পর্যায়ের ক্রিকেটে এভাবে আউট হওয়া যায়!
১২৯ কিমি গতির বলটাতে পুল করতে নিয়েছিলেন, কিন্তু শেষ মুহূর্তে ঘাবড়ে গিয়ে আর কিছুই খেললেন না। নাঈমের ব্যাটের কানায় লেগে ওপরে উঠে আবার নেমে আসা বল সহজেই গ্লাভসে পুরে নেন শ্রীলঙ্কার উইকেটকিপার কুশল মেন্ডিস।
শানাকার বলেই সহজ ক্যাচ দিয়ে আরেক ওপেনার মেহেদী হাসান মিরাজ ফেরেন আরও ৫ রান আগে। এরপর নাঈমের ওই অদ্ভুত আউট, ৬০ রানের মধ্যে নেই ২ উইকেট। শ্রীলঙ্কার ২৫৭ তাড়া করতে গিয়ে সেখান থেকে বাংলাদেশ কেবল পিছিয়েছেই। তার মধ্যে নাঈমের আউটের বর্ণনা আলাদা করে দেওয়ার কারণ, এশিয়া কাপে আরও একবার বাংলাদেশের ব্যাটিং ব্যর্থতার ছবিটা সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট ওটাতেই।
প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামের উইকেটে রান করাটা আজ দুই ইনিংসেই বেশ কঠিন ছিল। বলে মুভমেন্ট পাচ্ছিলেন শ্রীলঙ্কার বোলাররাও। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা যে বলগুলোতে আউট হয়েছেন, সেগুলোর কোনোটাতেই সেরকম কোনো বিষ মাখানো ছিল না।
মাথিশা পাতিরানার অফ স্টাম্পের বাইরের বলে ব্যাট চালিয়ে সাকিব কট বিহাইন্ড, লিটনও অনেকটা তাই। শানাকার বলে মুশফিকুর রহিমের আউটে পঞ্চম উইকেটে তাওহিদ হৃদয়ের সঙ্গে তাঁর ৭২ রানের জুটি ভেঙে যাওয়ার পর তো আশাই শেষ হয়ে যায় বাংলাদেশের। অন্যদিকে ২৮ রানে ৩ উইকেট নিয়ে শানাকাও যেন দুর্ধর্ষ এক পেসার!
টুর্নামেন্টের আগের তিন ম্যাচেই ব্যর্থ তাওহিদ ফর্মে ফিরেছেন ৮২ রানের ইনিংস দিয়ে, এটাই যা একটু সান্ত্বনা। লাহোরে পাকিস্তানের কাছে হারের পর শ্রীলঙ্কার কাছেও ২১ রানে হার। সুপার ফোরে ভারতের বিপক্ষে নিজেদের শেষ ম্যাচ বাংলাদেশ খেলবে ১৫ সেপ্টেম্বর। তার আগে অন্য তিন দল মিলে ম্যাচ খেলবে আরও তিনটি।
বৃষ্টির আশঙ্কা আছে বলে কত কিছুই তো হতে পারে! অঙ্কের হিসেবে তাই এখনই হয়তো বলে দেওয়া যাচ্ছে না যে বাংলাদেশের এশিয়া কাপ শেষ। তবে এখান থেকেও শেষ দুইয়ে যাওয়ার আশা করতে পারা মানে অসম্ভবকে সম্ভব করার কল্পনা। যে কোনো উইকেট নিয়েই সাকিব আল হাসানের সহজ-সরল একটা থিওরি আছে। ম্যাচের আগে উইকেট কেমন জানতে চাইলে তিনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যা বলেন এক বাক্যে তার সারমর্ম দাঁড়ায়—উইকেট কেমন তা বোঝা যাবে খেলার পর। তবে আজ বোধ হয় একটু আগেই প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামের উইকেটের ভাষা পড়ে ফেলতে পারলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। অবশ্য দলের কোচ যখন শ্রীলঙ্কারই মানুষ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে, সাকিবের হয়ে অনুবাদকের ভূমিকা নিয়ে থাকতে পারেন তিনিও।
বৃষ্টির কারণে কয়েক দিন কাভারে ঢাকা থাকায় পরশুর আগ পর্যন্ত টানা রোদ পায়নি কলম্বোর উইকেট। শ্রীলঙ্কা ম্যাচের উইকেট নিয়ে একটু দ্বিধাদ্বন্দ্ব তাই হাথুরুসিংহের ছিলই। কে জানে, হয়তো উইকেটের সম্ভাব্য আচরণ আঁচ করতে না পেরেই টুর্নামেন্টে টানা চতুর্থ ম্যাচে টসে জিতেও প্রথমবারের মতো আগে বোলিংয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন সাকিব।
ঝামেলা যেহেতু উইকেটে আছে বলেই মনে হচ্ছে, এখানে শ্রীলঙ্কাকেই আগে ব্যাটিংয়ে পাঠিয়ে দেখা যাক না পরিস্থিতি কী দাঁড়ায়। ম্যাচটা বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত হারলেও শুরুতে উইকেটের সুবিধা নিতে পেরেছেন বোলাররা। তিন পেসার তাসকিন আহমেদ, শরীফুল ইসলাম আর হাসান মাহমুদ শুরু থেকে মুভমেন্ট পেয়েছেন, ছিল অসমান বাউন্সও। শ্রীলঙ্কান ব্যাটসম্যানদের তাতে রান তুলতে বেশ সমস্যাই হচ্ছিল। উইকেটও দিয়েছেন তাঁরা পেসারদের বলেই। তাসকিন ও হাসান ৩টি করে এবং শরীফুল নিয়েছেন ২টি। তিন পেসার মিলেই নেন শ্রীলঙ্কার ৮ উইকেট, একমাত্র দুনিথ ভেল্লালাগে হয়েছেন রান আউট।
তবে তিন পেসারের কারো ইকোনমি রেটই ৬ এর নিচে না থাকাটা প্রমাণ করে শ্রীলঙ্কান ব্যাটসম্যানদের ওপর দেওয়া শুরুর চাপটা পরে আর তাঁরা ধরে রাখতে পারেননি। প্রথম ২০ ওভারে ১ উইকেটে ৮৫ রান করা শ্রীলঙ্কাই তাই শেষ পর্যন্ত আড়াই শ পেরিয়েছে।
অথচ এ মাঠে প্রথম ইনিংসের গড় রানই হলো ২২৫! তার মধ্যেও রান আটকে রাখার কিছুটা কৃতিত্ব পাবেন বাংলাদেশের তিন স্পিনার। সাকিব, নাসুম আহমেদ ও মিরাজ মিলে করা ২৩ ওভারে কোনো উইকেট না এলেও এই স্পিনারদের কারও ইকোনমি রেটই ৫ (সর্বোচ্চ মিরাজের ৪.৬৬) স্পর্শ করেনি।
শ্রীলঙ্কান ব্যাটসম্যানরাও অবশ্য জানতেন প্রেমাদাসার উইকেটের এমন আচরণের উপযুক্ত ওষুধ কোনটা। ৩৪ রানে প্রথম উইকেট পড়ার পর ওপেনার পাতুম নিশাঙ্কা ও কুশল মেন্ডিস এগোতে থাকেন সতর্ক ব্যাটিংয়ে। দ্বিতীয় উইকেটে তাঁদের ৭৪ রানের জুটির পর ছোটখাটো একটা বিপর্যয়, এরপর পঞ্চম উইকেটে সাদিরা সামারাবিক্রমা ও শানাকার ৬০ রানের জুটি।
তাসকিনের বলে শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে বদলি ফিল্ডার আফিফ হোসেনের হাতে ক্যাচ দেওয়ার আগে সামারাবিক্রমা করেছেন ৯৩ রান। মাত্র ৭ রানের জন্য ওয়ানডেতে নিজের প্রথম সেঞ্চুরিটা মিস করলেন। তবে তাঁর ৯৩ রানই শ্রীলঙ্কাকে যে জায়গায় নিয়ে যায়, তখনই শঙ্কা হচ্ছিল প্রেমাদাসার উইকেটের জটিল অংক বুঝে বাংলাদেশ হয়তো সেখান পর্যন্ত যেতে পারবে না। বাংলাদেশের ভুলত্রুটি ছিল ফিল্ডিংয়েও।
১৯তম ওভারে হাসানের বলে ডান দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিশাঙ্কার ক্যাচ নিতে পারেননি মুশফিক। ব্যক্তিগত ২৯ রানে জীবন পেয়েছেন পরে ফিফটি করা কুশল মেন্ডিসও। শরীফুলের বলে ডিপ স্কয়ার লেগে শামীম হোসেন হাতে রাখতে পারেননি ক্যাচ, উল্টো তাঁর হাতে লেগেই হয়ে যায় ছক্কা। পেসাররা পারেননি শুরুর চাপ ধরে রাখতে, ব্যাটসম্যানরা ব্যর্থ শ্রীলঙ্কার ব্যাটিং দেখেও প্রেমাদাসার উইকেটে সাফল্যের সূত্র খুঁজে বের করতে, সঙ্গে ওই ফিল্ডিং ব্যর্থতা। সব কিছুতেই বাংলাদেশের হারের ম্যাচে ফলাফলই আর অন্য হয় কী করে!