কোচ মূলত দুই প্রকার। কেউ বরখাস্ত হয়েছেন, কেউ হতে যাচ্ছেন। এটা মনে রাখলে চন্ডিকা হাথুরুসিংহের বরখাস্ত হওয়াটা এমন অস্বাভাবিক কিছু নয়। তার ওপর বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের যেখানে কোচ বরখাস্ত করার ব্যাপারে বিশেষ ‘সুনাম’ আছে।
তারপরও চন্ডিকা হাথুরুসিংহেকে বিদায় করে দেওয়াটা একটু ব্যতিক্রমীই। একটু নয়, বেশ ব্যতিক্রমী। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি ফারুক আহমেদ তাঁকে বরখাস্ত করার যে কারণের কথা বলেছেন, ক্রিকেট ইতিহাসেই সম্ভবত তা অভূতপূর্ব।
হাথুরুসিংহেকে বিদায় করে দেওয়া হচ্ছে অসদাচরণের জন্য। বরখাস্ত হওয়াটাকে নিয়তি মেনেই কোচরা কাজ করেন, তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অসদাচরণের জন্য কোনো কোচের চাকরি গেছে বলে এর আগে শোনা যায়নি।
ক্রিকেট ইতিহাসে সম্ভবত প্রথম কোচ হিসেবে যে কারণে হাথুরুসিংহের চাকরি যাচ্ছে, সেই ‘অসদাচরণ’টা কী? ফারুক আহমেদের কথা থেকে যা আঁচ করা গেল, সেটি গত বছর অক্টোবর–নভেম্বরে ভারতে অনুষ্ঠিত ওয়ানডে বিশ্বকাপের ঘটনা।
কোচদের সাধারণত চাকরি যায় দলের পারফরম্যান্সের কারণে। তা হাথুরুসিংহের দলের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স খুবই খারাপ। পাকিস্তান জয় করে আসার সুখস্মৃতি আবছা হয়ে গেছে ভারতে গিয়ে রীতিমতো নাস্তানাবুদ হয়ে আসায়। এই কারণে হাথুরুসিংহের চাকরি গেলেও একটা কথা ছিল। যদিও তখনো প্রশ্ন উঠত—একটা সিরিজে খারাপ করলেই কেন কোচকে সরিয়ে দেওয়া হবে, যেখানে আগের সিরিজেই স্মরণীয় সাফল্য আছে। তবে সেই প্রশ্নও বোধ হয় এতটা বড় হয়ে উঠত না, এখন যা উঠছে।
তা ক্রিকেট ইতিহাসে সম্ভবত প্রথম কোচ হিসেবে যে কারণে হাথুরুসিংহের চাকরি যাচ্ছে, সেই ‘অসদাচরণ’টা কী? ফারুক আহমেদের কথা থেকে যা বোঝা গেল, সেটি গত বছর অক্টোবর–নভেম্বরে ভারতে অনুষ্ঠিত ওয়ানডে বিশ্বকাপের ঘটনা। যে বিশ্বকাপের সময় বাংলাদেশ দলের বাঁহাতি স্পিনার নাসুম আহমেদকে হাথুরুসিংহে শারীরিকভাবে আঘাত করেছেন বলে অভিযোগ। ফারুক আহমেদ নাসুম আহমেদের নাম বলেননি। তবে হাথুরুসিংহের ‘অপরাধ’–এর কথা যেভাবে বর্ণনা করেছেন, তাতে বুঝে নিতে অসুবিধা হয়নি তিনি কোন ঘটনার কথা বলছেন। কারণ, এটি বিশ্বকাপের কিছুদিন পর বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে এসেছিল। যদিও এর সত্যাসত্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বিশ্বকাপ নিয়ে বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্টের রিপোর্টে এটি ছিল কি ছিল না, এ নিয়েও ধোঁয়াশা আছে।
ফারুক আহমেদ সেসব রিপোর্ট খুব মন দিয়ে পড়েছেন বলেই জানিয়েছেন। নাসুমের সঙ্গে নাকি কথাও বলেছেন। অবশ্যই তিনি নিশ্চিত হয়েছেন, এমন ঘটনা আসলেই ঘটেছিল। জাতীয় দলের বিদেশি কোচকে মেয়াদ শেষ হওয়ার মাত্র কয়েক মাস আগে বরখাস্ত করার মতো বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া কি মুখের কথা! নিশ্চয়ই তিনি অনেক ভেবেছেন। ভেবে ভেবে তাঁর মনে হয়েছে, না, এটা মোটেই মেনে নেওয়ার মতো নয়। দেরিতে হলেও হাথুরুসিংহেকে এর শাস্তি পেতেই হবে।
ফারুক আহমেদের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক এখানেই শেষ বলে মনে হয় না। আরও বেশ কিছুদিন তা চলবে। হাথুরুসিংহের অতীত ইতিহাস মনে রাখলে এটি আইনি লড়াইয়ে না গড়ালে একটু অবাকই হব।
হাথুরুসিংহে সত্যি সত্যি শারীরিকভাবে আঘাত করার উদ্দেশ্যেই নাসুমকে চাপড় দিয়ে থাকলে এটা যে গ্রহণযোগ্য নয়, এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। তবে যা নিয়ে অবশ্যই প্রশ্ন উঠবে, তা হলো সেই ‘অপরাধ’–এর শাস্তি এত দিন পরে কেন? ফারুক আহমেদের অবশ্য একটা বর্ম আছে, যা ব্যবহারও করছেন। তিনি তো দায়িত্ব নিয়েছেন দুই মাসও হয়নি। জুলাই–বিপ্লবের জের হিসেবে হঠাৎই বোর্ড সভাপতি হয়ে যাওয়ার পর এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো বড় সিদ্ধান্ত নেননি। প্রথম বড় সিদ্ধান্ত বলতে এটাই, যা হয়তো তাঁর অগ্রাধিকার তালিকার এক নম্বরেই ছিল। এ কথা বলার একটাই কারণ, বোর্ড সভাপতি হিসেবে প্রথম সংবাদ সম্মেলনেই তিনি এর ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছিলেন। যার আগে হাথুরুসিংহের ‘অসদাচরণ’ সম্পর্কে তাঁর নিশ্চিত হওয়ার কোনো উপায়ই ছিল না। তাহলে কি এটাই ধরে নেওয়া স্বাভাবিক নয় যে হাথুরুসিংহেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরই বোর্ড সভাপতি ‘কীভাবে তা করা যায়’—সেই কারণ অনুসন্ধানে নেমেছেন। নইলে এত দিন পর এসে কবে হাথুরুসিংহে বেশি ছুটি নিয়েছেন, কবে তা সময়মতো জানাননি—এসব পুরোনো কাসুন্দি কেন ঘাঁটা হবে?
যা ঈশপের সেই বিখ্যাত গল্পটাও মনে করিয়ে দিচ্ছে। ওই যে সিংহ আর মেষশাবকের গল্প। ঝরনার নিচে থেকে ওপরের পানি ঘোলা করা সম্ভব নয়—মেষশাবকের এই যুক্তির পর সিংহের দাবি, তাহলে মেষশাবকের বাবা এর আগে জল ঘোলা করেছিল। কাজেই মেষশাবককে মেরে ফেলার পূর্ণ অধিকার আছে তার।
ফারুক আহমেদের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক এখানেই শেষ বলে মনে হয় না। আরও বেশ কিছুদিন তা চলবে। হাথুরুসিংহের অতীত ইতিহাস মনে রাখলে তা আইনি লড়াইয়েও গড়াতে পারে। হাথুরুসিংহের অতীত ইতিহাস প্রসঙ্গেই মনে পড়ে গেল, বাংলাদেশের ক্রিকেট থেকে তাঁর প্রথম দফায় বিদায়টাও খুব বিতর্কিত ছিল।
ক্রিকেট নাকি সবকিছু্ই ফিরিয়ে দেয়। হাথুরুসিংহেকেও কি তা–ই দিল! বাংলাদেশের কোচের পদ ছেড়ে দেওয়ার মেইলটা পাঠিয়েছিলেন এক অক্টোবরে। আরেক অক্টোবরে সেই একই পদ থেকে অপমানজনক বিদায়ের বার্তাটাও পেলেন আরেকটি মেইলে।
২০১৭ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের একটা সফরের মাঝপথে ই–মেইলে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। অথচ কথা ছিল, ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপ পর্যন্ত তিনিই কোচ থাকবেন। ওভাবে দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়াটা পেশাদারত্বের সঙ্গে মোটেই সংগতিপূর্ণ ছিল না। ক্রিকেট নাকি সবকিছু্ই ফিরিয়ে দেয়। হাথুরুসিংহেকেও কি তা–ই দিল! বাংলাদেশের কোচের পদ ছেড়ে দেওয়ার মেইলটা পাঠিয়েছিলেন এক অক্টোবরে। আরেক অক্টোবরে সেই একই পদ থেকে অপমানজনক বিদায়ের বার্তাটাও পেলেন আরেকটি মেইলে। সেবার দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের মাঝপথে, এবার দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের ঠিক আগে। চক্রপূরণ বলবেন? বলতেই পারেন।