নতুন মিশনে নেমেছেন জাতীয় দলের অলরাউন্ডার মেহেদী হাসান মিরাজ ও অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান ইমরুল কায়েস। ব্যাট তৈরির ব্যবসায় নামতে যাচ্ছেন তাঁরা।
‘ব্যাট–ডক্টর’—নামটা বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটারদের সবারই কমবেশি পরিচিত। ক্রিকেট ব্যাটের মেরামত থেকে শুরু করে নতুন ব্যাট তৈরি, সবই করে থাকেন এই ব্যাটের কারিগর। নাম তাঁর হুসাইন মোহাম্মদ আফতাব। রাজশাহীর এই ব্যাটের কারিগর অবশ্য নিজের ‘শাহিন’ ডাকনামেই সবার কাছে পরিচিত।
তাঁকে নিয়েই নতুন এক মিশনে নেমেছেন জাতীয় দলের অলরাউন্ডার মেহেদী হাসান মিরাজ ও অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান ইমরুল কায়েস। তিনজন মিলে ব্যাট তৈরির ব্যবসায় নামতে যাচ্ছেন। এটি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম ব্যাট প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান, নাম রাখা হয়েছে এমকেএস স্পোর্টস।
মিরাজ তো এ নিয়ে খুবই রোমাঞ্চিত। জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা তো আছেনই, বয়সভিত্তিক ক্রিকেট, হাই পারফরম্যান্স, মেয়েদের ক্রিকেট, এমনকি ক্লাব পর্যায়ে খেলা স্থানীয় ক্রিকেটারদের ব্যাটে ‘এমকেএস স্পোর্টস’–এর লোগো বসিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা তাঁর, ‘আমরা সবাইকে স্পনসর করব। কেউ বাদ যাবে না (হাসি)।’
বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা খেলবেন দেশে তৈরি ব্যাট দিয়ে, ইমরুল এমন স্বপ্নই দেখেন, ‘আমরা কিন্তু বাইরে থেকে অনেক দাম দিয়ে ব্যাট কিনি। কিন্তু আমাদের টপ প্লেয়ারদের ভারতীয় কোম্পানিগুলো সেরা ব্যাটটা দেয় না। সেটা তাদের বাজারেই বিক্রি করে। এখন আমরা টপ কোয়ালিটি উইলো পাচ্ছি, ব্যাট তৈরির সামর্থ্যও আছে। তাহলে আমরা কেন নিজেদের ব্যাট নিজেরা তৈরি করব না।’
মিরাজ-ইমরুলকে ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে পাওয়া শাহিনের কাছেও স্বপ্নপূরণের মতো ব্যাপার, ‘ভারতীয়, পাকিস্তানি ব্যাট-মেকাররা অনেক টাকা আয় করে। আমাদের দেশেই তাদের বিশাল বাজার। আমাদের ক্রিকেটারদের জন্য ভালোমানের লোকাল প্রোডাক্ট নেই। ওরা পারলে আমরা কেন পারব না—এমন একটা জেদ আমার মধ্যে কাজ করত।
এরপর ২০১৯-২০ থেকে জাতীয় দলের কয়েকজন ক্রিকেটারের জন্য ব্যাট বানানো শুরু করি। এখন তো বড় আকারেই এগোচ্ছি। ইমরুল ভাই আগে থেকেই সঙ্গে ছিলেন। মিরাজ পরে যোগ দিয়েছে। দুজনকেই ধন্যবাদ আমার স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে আসার জন্য।’
শাহিন এখন পর্যন্ত মুশফিকুর রহিম, মুমিনুল হক, আফিফ হোসেন, নাজমুল হোসেন, মোসাদ্দেক হোসেন, মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনের জন্য ব্যাট তৈরি করেছেন। জাতীয় দলের বাইরেও অনেকে তাঁর কাছ থেকে নিয়মিত ব্যাট নেন। ব্যাটে শাহিনের কাজ পছন্দ হয়েছিল এবারের বিপিএল খেলতে আসা পাকিস্তানের খুশদিল শাহ, সিকান্দার রাজা, আন্দ্রে রাসেলদেরও। এর মধ্যে খুশদিলের জন্য নতুন ব্যাট বানিয়ে দিয়েছিলেন শাহিন। অর্ডার ছিল রাসেলেরও।
আর সিকান্দার রাজা তো শাহিনের কাজের ভক্তই। গত বছর জুলাইয়ে বাংলাদেশ দলের হয়ে জিম্বাবুয়ে সফরে গিয়ে ব্যাট নিয়ে সমস্যায় পড়েন এনামুল হক। সমাধানের জন্য এনামুল রাজার শরণাপন্ন হয়ে হতাশই হন। রাজা নাকি এনামুলকে বলেছিলেন, ‘এই দেশে তো কোনো শাহিন নেই যে তোমার ব্যাট ঠিক করে দেবে।’
শুধু বাংলাদেশের ক্রিকেটার নয়, বিভিন্নভাবে যোগাযোগ হওয়ার পর এখন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ফ্রান্স জাতীয় দলের অনেক ক্রিকেটারের ব্যাট তৈরির কাজও পেয়েছেন শাহিন।
অন্য সবার মতো শাহিনেরও স্বপ্ন ছিল ক্রিকেটার হওয়ার। ২০০১ সালে জাতীয় পর্যায়ে অনূর্ধ্ব-১৫ দলের প্রাথমিক তালিকায় ডাকও পেয়েছিলেন। কিন্তু বয়স বেশি হওয়ায় অনূর্ধ্ব-১৫ দলে আর রাখা হয়নি তাঁকে। এরপরও টুকটাক খেলেছেন কিন্তু পেশাদার ক্রিকেটার আর হতে পারেননি। ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে কাজ করার সুপ্ত ইচ্ছা অনেক আগে থেকেই ছিল শাহিনের। সে জন্য কারিগরি শিক্ষার কোর্সে কাঠ নিয়ে দুই বছর পড়াশোনাও করেছেন।
টুকটাক ব্যাট মেরামতের কাজ তখন থেকেই শুরু শাহিনের। পড়াশোনা শেষে চাকরিজীবন শুরু করলেও পাশাপাশি ঘরোয়া পর্যায়ে খেলা ক্রিকেটারদের ব্যাট নিয়ে কাজ করতেন। দিনে অফিস, রাতে ক্রিকেটারদের ব্যাট ঘষেমেজে নতুন করা—শাহিনের শুরুটা এভাবেই। ২০১৩ সালে বিপিএলের প্রথম বছরই শাহরিয়ার নাফীসের ব্যাট মেরামত করেন শাহিন। সে ব্যাট দিয়েই পরের ম্যাচে সেঞ্চুরি করেন এই বাঁহাতি। বিপিএলে নাফীসের সতীর্থ অস্ট্রেলীয় ব্যাটসম্যান ট্রেভিস ব্রিটের ব্যাট নিয়ে কাজ করেছেন শাহিন।
এর পর থেকে বিপিএলে নিয়মিতই দেশি-বিদেশি ক্রিকেটারদের ব্যাট নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন শাহিন। সেটা করতে গিয়ে অনেক মজার অভিজ্ঞতাও হয়েছে। বিপিএল খেলতে আসা কাইরন পোলার্ডের ব্যাট ঠিক করার গল্পটা এমন মজার, ‘পোলার্ড ১৩৫০ গ্রাম ওজনের ব্যাট দিয়ে খেলে। আমার মনে হয় না বিশ্বে আর কোনো ব্যাটসম্যান এত ভারী ব্যাট ব্যবহার করে। সঙ্গে পাঁচটি গ্রিপ। ব্যাট এত ভারী যে তুলতে গিয়ে আমার হাত ব্যথা করছিল।’
বাংলাদেশ দলের কোন ক্রিকেটার কেমন ওজনের ব্যাট দিয়ে খেলেন, সেটি এখন মুখস্থ শাহিনের। কার কী চাহিদা, সেটি এখন আর শাহিনের কাছে আলাদা করে উল্লেখ করতে হয় না। শাহিনের স্বপ্ন, একদিন ভারত-পাকিস্তানে তৈরি ব্যাটের সঙ্গে পাল্লা দিতে দেবে এমকেএস স্পোর্টসের ব্যাট। ভালো ব্যাট তৈরি করেই সেই সুনাম অর্জন করতে চান ‘ব্যাট-ডক্টর’।