ডালাসে বাংলাদেশ দলের আবাস গেলর্ড টেক্সান রিসোর্ট অ্যান্ড কনভেনশন সেন্টার যেন বিষম এক গোলকধাঁধা। আয়তনে বিশাল। যতভাবে সম্ভব সেই বিশালত্ব প্রকাশের আয়োজনও করে রাখা হয়েছে এখানে। পুরোটাই মনে হয় পাথরে তৈরি। তা জানাতে দৈত্যাকার পিলারগুলো থেকে বেরিয়ে এসেছে এবড়োখেবড়ো পাথর। কোথায় হোটেলের লবি, কোথায় রুম…দর্শনার্থীদের তা বুঝে ওঠাই কঠিন। সুইমিংপুল, রেস্টুরেস্ট, দোকানপাট—এসব তো আছেই; ১০ একর জায়গাজুড়ে বিশাল এক ওয়াটার পার্কও।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ডালাসে সব দলেরই ঠিকানা এই গেলর্ড টেক্সান রিসোর্ট। যুক্তরাষ্ট্রের ক্রীড়া অভিধানেও যেটির নাম খুঁজে পাবেন। কারণ, এটি টেক্সাসের সবচেয়ে বিখ্যাত স্পোর্টস টিম ডালাস কাউবয়েজের অফিশিয়াল হোটেল। সেই ডালাস কাউবয়েজের কিংবদন্তি ল্যারি অ্যালেনের আকস্মিক মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে টেক্সাসে। ছুটি কাটাতে মেক্সিকো গিয়েছিলেন, গত রোববার সেখানেই হঠাৎ চলে গেছেন কাউবয়েজের হয়ে সুপার বোল জেতা ৫২ বছর বয়সী অ্যালেন। এনএফএল, বুঝতে সুবিধার জন্য যেটিকে আমরা আমেরিকান ফুটবল বলি—তা এখানে কতটা জনপ্রিয়, এটি বুঝতে খুব একটা সময় লাগে না। উবার ট্যাক্সি ড্রাইভার বিদেশি অতিথিকে শহরের একটা দর্শনীয় কিছু দেখালেও অবশ্যম্ভাবীভাবেই সেটি হয় কাউবয়েজ স্টেডিয়াম।
ডালাসে আইসিসির অফিশিয়াল হোটেল, অথচ গেলর্ড টেক্সান রিসোর্টে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের কোনো চিহ্নই নেই। ডালাসের কোথায়ই–বা আছে! একমাত্র গ্র্যান্ড প্রেইরি স্টেডিয়ামে গেলেই শুধু বোঝা যায়, এখানে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ হচ্ছে।আমেরিকানদের ক্রিকেটে আগ্রহী করে তোলাই যদি এখানে বিশ্বকাপ আয়োজনের উদ্দেশ্য হয়, সে জন্য একটু প্রচার তো করা উচিত ছিল। অন্তত শহরে কয়েকটা বিলবোর্ডে বিশ্বকাপ ক্রিকেট থাকতেই পারত! লিওনেল মেসি যেমন আছেন।
গেলর্ড টেক্সান রিসোর্ট যত বড়ই হোক, বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের তা মোটামুটি দেখে ফেলার কথা। নিউইয়র্কে ভারতের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলে ডালাসে আসার পর দুই দিন তো বলতে গেলে হোটেলেই তাঁদের দিনরাত ২৪ ঘণ্টা। গত রোববার ডালাসে আসার দিন সন্ধ্যায়ই অবশ্য সাকিব আল হাসানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের চার ক্রিকেটার একটা অনুষ্ঠানে গেছেন। স্থানীয় এক মসজিদের জন্য চাঁদা তোলাই নাকি ছিল উদ্দেশ্য। সাকিবের সঙ্গে ছিলেন মাহমুদউল্লাহ, হাসান মাহমুদ ও তানজিম হাসান। উদ্দেশ্য যেটাই হোক, বিশ্বকাপের মতো আসরে খেলতে এসে এসব অনুষ্ঠানে যাওয়া কতটা শোভন বা মনঃসংযোগের জন্য তা ভালো না খারাপ—এ বিতর্ক কিন্তু আছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড কী ভেবে এসবের অনুমোদন দেয়, এই প্রশ্নও।
ক্রিকেট দলের যেকোনো সফরে এ ধরনের কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া না দেওয়ার এখতিয়ার দলের ম্যানেজারের। ম্যানেজার রাবীদ ইমাম অবশ্য ওই চারজন তাঁর অনুমতি নিয়ে গেছেন কি না, এ প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর দিলেন না। শুধু বললেন, ‘ওটা তো মনে হয় চ্যারিটি ইভেন্ট ছিল।’
চ্যারিটি হোক বা বাণিজ্যিক—বিশ্বকাপ চলার সময় এসব থেকে দূরে থাকাই কি ভালো নয়! নিউইয়র্কে সাকিব তাঁর ক্যানসার ফাউন্ডেশনের যে অনুষ্ঠান করেছেন, সেটি নিয়েও এ প্রশ্ন উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ কাভার করতে আসা বাংলাদেশের সাংবাদিকের মধ্যে আরেকটা প্রশ্নও খুব আলোচিত দেখলাম। তা হলো বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা যথেষ্ট অনুশীলন করছেন কি না?
যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক পেস বোলার গোলাম নওশের আগেই এ প্রশ্ন তুলেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে হেরে যাওয়ার পরও পরদিন বাংলাদেশ দলের বেশির ভাগ খেলোয়াড়কে অনুশীলনে না দেখে বিস্মিত গোলাম নওশেরের প্রতিক্রিয়া হয়তো প্রথম আলোতে পড়েও থাকবেন। দলের টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানদের কেউই যেখানে ফর্মে নেই, নেটে তাঁদের আরও বেশি সময় কাটানোই হয়তো স্বাভাবিক হতো। কে জানে, ফর্মে ফিরতে একেক ক্রিকেটারের একেক টোটকা। কেউ আরও বেশি করে অনুশীলন করেন, কেউবা ব্যাট-বল থেকে একটু দূরে থাকেন। কৌতূহলের উত্তরে বাংলাদেশ দলের ম্যানেজার জানা কথাটাই বললেন—অনুশীলনের ব্যাপারটা পুরোপুরিই কোচিং স্টাফের ওপর। তা ছাড়া সারা বছরই তো প্র্যাকটিস হয়, এখানে এসে এক দিন বেশি বা কম প্র্যাকটিস করায় কিছু আসে–যায় না। হোটেলে থাকলেও ক্রিকেটারদের যে জিম সেশন থাকে, কখনো অন্য কোনো দলীয় কাজও—মনে করিয়ে দিলেন সেটিও।
গত সোমবার সকালেই যেমন হোটেলের একটা হলরুমে বড় পর্দায় দক্ষিণ আফ্রিকা-শ্রীলঙ্কা ম্যাচ দেখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বাংলাদেশ দল একসঙ্গে বসে গ্রুপে সবচেয়ে শক্ত দুই প্রতিপক্ষের খেলা দেখেছে। প্রথম ম্যাচের প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কার দুরবস্থা দেখে হয়তো একটু খুশিও হয়েছে। আবার দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতাপ দেখে একটু চিন্তিতও। ১০ জুন দ্বিতীয় ম্যাচে তো নিউইয়র্কের ওই অসমান বাউন্সের উইকেটেই নর্কিয়াদের মুখোমুখি হতে হবে।
চোট নিয়ে ভাবনাও আছে। হ্যামস্ট্রিংয়ের চোট নিয়েই এখানে আসা তাসকিন আহমেদ যদিও সেরে ওঠার পথে। শুক্রবার শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তাঁকে পাওয়াটা প্রায় নিশ্চিত। যদিও বাংলাদেশ দলের ফিজিও নিশ্চিত করে তা বলার আগে অনুশীলনে তাসকিনকে বোলিং করতে দেখার জন্য অপেক্ষা করতে চান। ভারতের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে হাতে ছয়টি সেলাই পড়া শরীফুলের ব্যাপারেও অপেক্ষা করার নীতি। তবে প্রথম ম্যাচে নিশ্চিতভাবেই থাকছেন না এই বাঁহাতি পেসার, দ্বিতীয় ম্যাচ নিয়েও বড় প্রশ্ন আছে।
এসব তো দৃশ্যমান প্রশ্ন। বাংলাদেশ দলকে নিয়ে অদৃশ্য প্রশ্ন তো আরও কত! সেসবের উত্তর পেতে অপেক্ষাটা কি একটু বেশিই দীর্ঘ মনে হচ্ছে আপনার?