বিশ্বকাপের পারফরম্যান্স মূল্যায়ন কমিটি কথা বলবে তামিম ইকবালের সঙ্গেও
বিশ্বকাপের পারফরম্যান্স মূল্যায়ন কমিটি কথা বলবে তামিম ইকবালের সঙ্গেও

বিশ্বকাপ দলে না থেকেও যে কারণে ব্যর্থতার তদন্তে তামিম

বিশ্বকাপের পারফরম্যান্স মূল্যায়ন কমিটিকে যখন বিশ্বকাপ শুরুর তিন মাস আগের ঘটনাতেও তদন্তের আলো ফেলতে হয়, তখন ব্যাপারটাকে কী বলবেন? কান টানলে মাথা আসে, নাকি মাথা কাছে এলেই না তবে কানটা টেনে দেওয়া যাবে?

ভারত বিশ্বকাপ থেকে মাত্র দুটি জয় নিয়ে ফেরা, বিশেষ করে নেদারল্যান্ডসের কাছেও হার; বাংলাদেশের ক্রিকেটামোদী মানুষের সহ্য ক্ষমতা এত বেশি হয়ে যায়নি যে তাঁরা এই সবই মেনে নিতে পারবেন। বাজে খেলে সমালোচনার তিরবিদ্ধ হয়েছেন ক্রিকেটার, কোচ, নির্বাচক থেকে শুরু করে বিসিবির কর্মকর্তারাও। বিসিবি তবু অনেকটা সময় এ নিয়ে প্রতিক্রিয়াহীন ছিল। এমনকি বিশ্বকাপে মাঠের বাইরের কিছু ঘটনা আলোচনায় এলেও বিসিবি ছিল ‘স্পিকটি নট’। বিশ্বকাপ পারফরম্যান্স মূল্যায়নে বোর্ডের তরফ থেকে তাৎক্ষণিক কোনো উদ্যোগও দেখা যায়নি।

বিসিবির মৌনতা ভাঙে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ শেষ ম্যাচ খেলে ফেলার ১৮ দিন পর। ১১ নভেম্বর পুনেতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ছিল শেষ ম্যাচ, ২৯ নভেম্বর রাতে বিসিবি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিশ্বকাপ পারফরম্যান্স মূল্যায়নের উদ্দেশ্যে তিন সদস্যের বিশেষ কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত জানায়। কী কী কারণে দলটা বিশ্বকাপে এ রকম বাজে খেলল, সেসব অনুসন্ধান করে বের করার দায়িত্ব দেওয়া হয় বোর্ড পরিচালক এনায়েত হোসেনের নেতৃত্বাধীন কমিটিকে। কমিটি তাদের পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ জানাবে বিসিবিকে। বিশেষ কমিটির অন্য দুই সদস্য বিসিবির আরও দুই পরিচালক মাহবুবুল আনাম ও আকরাম খান।

নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ঘরে–বাইরে পরপর দুটি সিরিজ ছিল বলে বিসিবি ধরেই নিয়েছিল কমিটির কাজ শেষ করতে সময় লাগবে। সে জন্য প্রতিবেদন দেওয়ার কোনো সময়সীমাও বেঁধে দেওয়া হয়নি। তবে জানা গেছে, বিশেষ কমিটির কাজ অনেকটাই শেষের দিকে। কাল মুঠোফোনে এই প্রতিবেদককে কমিটির প্রধান এনায়েত হোসেনও সেটাই বলেছেন, ‘আমরা আমাদের কাজ অনেকটাই গুছিয়ে এনেছি। সামান্য কিছু কাজ বাকি। আশা করি, দ্রুতই বোর্ডে প্রতিবেদন জমা দিতে পারব। সঙ্গে ভবিষ্যতের জন্য আমাদের কিছু দিকনির্দেশনাও থাকবে।’

সাকিব আল হাসানের সঙ্গেও কথা বলা বাকি বিশ্বকাপের পারফরম্যান্স মূল্যায়ন কমিটির

কমিটি প্রধান এ নিয়ে আর কিছু বলতে না চাইলেও জানা গেছে, তাঁরা এই মুহূর্তে আছেন তামিম ইকবালের সঙ্গে কথা বলার অপেক্ষায়। ব্যক্তিগত সফরে দুবাই যাওয়া তামিমের আজ ঢাকায় ফেরার কথা। কমিটি আরও আগেই কথা বলতে চাইলেও তামিম তাদের জানিয়েছেন, তিনি সময় দেবেন দুবাই থেকে ফিরে। তার মানে আজ থেকে যেকোনো সময় বিশেষ কমিটির মুখোমুখি হবেন তামিম।

বিশ্বকাপ অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের সঙ্গেও এখনো কথা বলতে পারেনি কমিটি। নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত সাকিব চেয়েছিলেন মাগুরা থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কাজটা সেরে নিতে। কিন্তু কমিটি সে প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে নির্বাচনের পর তাঁর সঙ্গে সামনাসামনিই কথা বলতে চেয়েছে। এই ফাঁকে তামিমের সঙ্গে আলোচনা সেরে ফেলা হবে। কমিটি এ–ও মনে করে যে তামিমের কথা শোনার পর সাকিবের সঙ্গে কথা বলার মতো নতুন বিষয় সামনে চলে আসতে পারে। কাজেই সাকিবের মুখোমুখি সবার শেষে হওয়াই ভালো।

কিন্তু যে তামিম কিনা বিশ্বকাপের দলেই ছিলেন না, বিশ্বকাপ পারফরম্যান্স মূল্যায়ন করতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে কেন কথা বলতে চাইছে বিসিবির বিশেষ কমিটি! চাইছে কারণ, কমিটির সদস্যদের মনে হয়েছে, বিশ্বকাপ–ব্যর্থতার সঙ্গে সম্পর্ক থেকে থাকতে পারে গত জুলাইয়ে আফগানিস্তান সিরিজের মধ্যে চট্টগ্রামে তামিমের হঠাৎ অবসরের সিদ্ধান্ত জানানোর সঙ্গেও।

একই ফ্রেমে তামিম–সাকিব

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে এক দিনের মধ্যে তামিম সিদ্ধান্ত থেকে সরে এলেও ঘটনার শেষ সেখানেই হয়নি। পরে বিশ্বকাপের দল থেকে বাদ পড়েন তিনি, যার পেছনে কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে ও সাকিবের ভূমিকা আছে বলে গুঞ্জন। তাঁরা দুজনই এ ধরনের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করলেও কমিটি মনে করে তামিমের অবসরের সিদ্ধান্ত থেকে শুরু করে বিশ্বকাপ দল থেকে তাঁর বাদ পড়ার ঘটনাপ্রবাহ খেলা থেকে ক্রিকেটারদের মনোযোগ বিচ্যুতির কারণ হতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে এক দিনের মধ্যে তামিম অবসরের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এলেও ঘটনার শেষ সেখানেই হয়নি। পরে বিশ্বকাপের দল থেকে বাদ পড়েন তিনি, যার পেছনে কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে ও সাকিবের ভূমিকা আছে বলে গুঞ্জন।

বিশেষ কমিটি গত এক মাসের বেশি সময়ে কথা বলেছে বিশ্বকাপের অনেকটা সময় দলের সঙ্গে থাকা বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা প্রধান জালাল ইউনুস থেকে শুরু করে কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে, দুই নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন ও হাবিবুল বাশার, ম্যানেজার রাবীদ ইমাম এবং দলের প্রায় সব ক্রিকেটারের সঙ্গে। খেলোয়াড়দের মধ্যে বাকি বলতে শুধু সাকিবই।

মজার ব্যাপার হলো, তিন সদস্যের বিশেষ কমিটি করার উদ্দেশ্য ‘বিশ্বকাপের পারফরম্যান্স মূল্যায়ন’ হলেও কমিটি মনেই করে না অন্তত মাঠের পারফরম্যান্স নিয়ে মূল্যায়নের কিছু আছে। কারও ইচ্ছা করে খারাপ খেলার মতো কিছু তাঁরা দেখছেন না, দেখছেন শুধু ক্রিকেটীয় ব্যর্থতা। কমিটি এ–ও মনে করে যে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচটা জিতে গেলে এ ধরনের কমিটি করারই প্রয়োজন পড়ত না বিসিবির। বিশ্বকাপ দল–সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে ব্যর্থতার যা কিছু কারণ তাঁদের উপলব্ধিতে এসেছে, তার সবই অক্রিকেটীয়। সরাসরি পারফরম্যান্সের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, তদন্তের আলো পড়ছে সে রকম ঘটনায়ও।

বাংলাদেশ দলের প্রধান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে

এর অন্যতম সংবাদমাধ্যমে আসা নাসুম আহমেদের সঙ্গে কোচ হাথুরুসিংহের অসদাচরণের অভিযোগ। জানা গেছে, নাসুমসহ অনেকের কথা থেকে কমিটির মনে হয়েছে, এ রকম কিছু একটা ভারতে ঘটে থাকলেও থাকতে পারে। তবে এ ব্যাপারে হাথুরুসিংহের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাঁড় করানোর মতো সুনির্দিষ্ট ও যথেষ্ট শক্ত তথ্য–প্রমাণ নাকি তাঁরা এখনো পাননি। হাথুরুসিংহেও অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর বলে কমিটি এখন পর্যন্ত এ নিয়ে বিসিবির কারও সঙ্গেও কথা বলেনি। এ বিষয়ে যা বক্তব্য, সেটা তারা প্রতিবেদনেই উল্লেখ করবে।

সূত্র জানিয়েছে, ১০ ডিসেম্বর হাথুরুসিংহের সঙ্গে কমিটির আলোচনায় নাসুমের বিষয়টি ছাড়াও প্রাধান্য পেয়েছে তামিমের অবসর–কাণ্ড ও বিশ্বকাপের দল থেকে বাদ পড়ার ঘটনা। কোচের কাছে জানতে চাওয়া হয়, কী এমন ঘটেছিল যে বিসিবিকেও কিছু না জানিয়ে একটা আন্তর্জাতিক সিরিজের মধ্যে হঠাৎ অবসরের ঘোষণা দিয়েছিলেন তামিম? হাথুরুসিংহে নাকি বলেছেন, এ বিষয়ে তাঁর ধারণা নেই। বিষয়টা নিয়ে তামিমই ভালো বলতে পারবেন।

এরপরই বিশেষ কমিটি সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্বকাপ দলে না থাকলেও তামিমের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাঁর ওই সিদ্ধান্তের কারণ জানাটা ভবিষ্যতের জন্যও জরুরি। আর সে কারণেই বিশ্বকাপ–ব্যর্থতার তদন্তের আলো পড়ছে বিশ্বকাপ দলে না থাকা তামিমের অবসর–কাণ্ডেও।