ইজ স্টুয়ার্ট ব্রড ব্যাটিং?
স্টুয়ার্ট ব্রড কি ব্যাটিং করছেন? ওভালে তৃতীয় দিন শেষের স্কোরকার্ড সে প্রশ্নের জবাবে ‘হ্যাঁ’ বলবে। ২ বলে ২ রানে অপরাজিত ইংল্যান্ডের প্রথম আত্মস্বীকৃত ‘নাইটহক’—এ ম্যাচে যিনি নেমেছেন দশ নম্বরে। বেন স্টোকস যদি রাতারাতি ইনিংস ঘোষণা করেন, তাহলে ব্রড আর ব্যাটিং করবেন না।
আর যদি স্টোকস ইনিংস ঘোষণা না করেন, তাহলে শেষবারের মতো ব্রড আরেকবার ব্যাটিং করতে নামবেন। সঙ্গী হবেন জেমস অ্যান্ডারসন। ইতিহাসের সফলতম বোলিং জুটি, টেস্ট ইতিহাসের সফলতম দুই পেসার একসঙ্গে শেষবার ব্যাটিং করতে নামবেন।
ব্রড ব্যাটিং করছেন কি না, ঠিক এ প্রশ্ন করার জন্য ওপরের ইংরেজি কথাটি বলা নয়। আদতে ‘ইজ স্টুয়ার্ট ব্রড ব্যাটিং?’ টুইটারের একটি আইডির নাম। ১৫ হাজার ফলোয়ার, ‘বায়ো’তে লেখা কথাটার অর্থ—‘গুরুত্বপূর্ণ এক প্রশ্নের উত্তর দিতে’।
নাম শুনেই হয়তো সে আইডির কার্যকলাপের কিছুটা অনুমান করে নিতে পারেন আপনি। ইংল্যান্ডের টেস্ট থাকলে ব্রডের ব্যাটিংকে ঘিরে সরব হয়ে ওঠে সে আইডি। ‘স্টুয়ার্ট ব্রড ইজ প্যাডিং আপ’, ‘স্টুয়ার্ট ব্রড ইজ ব্যাটিং’, ‘স্টুয়ার্ট ব্রড ইজ নো লঙ্গার ব্যাটিং’—টুইটের ভাষা সাধারণত এমন। সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় কোনো মিম।
সাংবাদিক জ্যারড কিম্বার যেমন ব্রডকে বলেন ক্রিকেটের ‘মিম কিং’ বা মিমের রাজা। ব্রডের কাজকারবার তো আদতেই অমন। এই তো অ্যাশেজের এই টেস্টেই মারনাস লাবুশেনের স্টাম্পের বেলস অদল-বদল করে ‘কালোজাদু’ করেছেন এক সময় ড্রেকো ম্যালফয় নাম পাওয়া ব্রড। সেটি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে মজা করেছেন, টুইটারেও তাই।
ব্রড নিজে টুইট করতে ভালোবাসেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সরব বেশ। বাবা ম্যাচ রেফারি ক্রিস ব্রড যখন ব্রডকে শাস্তি হিসেবে জরিমানা করেছিলেন, ব্রড সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোষণা দিয়েছিলেন—বড়দিনের উপহারের তালিকা থেকে বাবাকে বাদ দিয়ে দেবেন! এ অ্যাশেজের শুরুতে অস্ট্রেলিয়ার এক সংবাদমাধ্যম যখন ওলি রবিনসনকে ‘এক নম্বর ভিলেন’ বানিয়ে দিল, ব্রড আক্ষেপের সুরে কমেন্ট করেছিলেন, এত দ্রুত তিনি সেই খেতাবটা হারিয়ে ফেললেন!
২০১৩ সালে ট্রেন্টব্রিজে অ্যাশটন অ্যাগারের বলে স্লিপে ক্যাচ তুলেও আম্পায়ার আউট না দেওয়াতে বেঁচে যান ব্রড, ‘ওয়াক’ না করে পরিণত হন অস্ট্রেলীয়দের এক নম্বর খলনায়কে। পরের অ্যাশেজে স্থানীয় একটি পত্রিকা ব্রডের নাম ছাপাতে অস্বীকৃত জানায়, ৫ উইকেট নেওয়ার পর সংবাদ সম্মেলনে সে পত্রিকার একটি কপি বগলদাবা করে ঢুকেছিলেন ব্রড। এমনকি এক সময় মাঠে দর্শকদের কটূক্তির সুরে ধরা কোরাসে নিজেও সুর মিলিয়েছিলেন!
ব্রড অ্যাশেজকে ভালোবাসেন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তাঁর চেয়ে বেশি উইকেট আর কোনো ইংলিশ বোলারের নেই, ক্রিকেটের সবচেয়ে পুরোনো লড়াইয়ে তাঁর চেয়ে সফল বোলারের নাম—শেন ওয়ার্ন ও গ্লেন ম্যাকগ্রা। অভিষেকের পর থেকে ১৪ বছর সময় নিয়ে অ্যাশেজে দেশের মাটিতে একটি টেস্টও মিস দেননি ব্রড—খেলেছেন টানা ২৫টিই। আর হয়ে উঠেছেন অস্ট্রেলিয়ার ‘খলনায়ক’।
এক সময় ক্লাব ক্রিকেট খেলতে অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিলেন ব্রড, তখনো তিনি বাবা ক্রিস ব্রডের মতো বাঁহাতি ওপেনার, যিনি পেস বোলিং-ও করেন। তবে অস্ট্রেলিয়ায় ওই মৌসুমের পর থেকে ব্রড হয়ে গেলেন পুরোদস্তুর পেসার, যিনি ব্যাটিং-ও করেন। স্টিভ ওয়াহ একবার বলেছিলেন, যাঁদের অস্ট্রেলীয়রা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক মানসিকতায় নিজেদের সমকক্ষ মনে করেন, তাঁদের নাকি দেখতে পারেন না তারা। ব্রড সে শ্রেণিতেই পড়েন।
ক্যারিয়ারের শুরুতে যুবরাজ সিংয়ের হাতে ছয় ছক্কার শিকার হয়েছিলেন, ব্রডকে ঘুরে দাঁড়াতে হয়েছে সেখান থেকে। ২০১৫ সালের পর থেকে সেভাবে সীমিত ওভারে সুযোগ না পাওয়া নিশ্চিতভাবেই অ্যান্ডারসনের মতো তাঁকেও সহায়তা করেছে টেস্ট ক্যারিয়ারটা দীর্ঘ করতে।
ব্রড এখনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাচ্ছিলেন, ক্রিকেট খেলাকে এখনো ভালোবাসছিলেন আগের মতোই। শুধু আগের মতো কেন, ব্রেন্ডন ম্যাককালাম ও বেন স্টোকসের এই নতুন ইংল্যান্ডের যুগে ক্রিকেটকে অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি উপভোগ করছিলেন বলেই বলেছেন বারবার। তবুও সেরা ফর্মে থাকা অবস্থাতেই বিদায় বলতে চান। এ সিরিজে দ্বিতীয় পেসার হিসেবে ৬০০ উইকেট পেয়েছেন, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে কোনো ইংলিশ বোলারের সর্বোচ্চ উইকেটের রেকর্ড নিজের করে নিয়েছেন।
২০০৯ সালে এই ওভালেই নিজের আগমনী বার্তাটি দিয়েছিলেন ব্রড। সিরিজের শেষ টেস্টে ম্যাচ জেতানো এক স্পেলে বোলিং করে। ক্যারিয়ারজুড়েই ব্রডকে শুনতে হয়েছে, তিনি ঠিক ‘গ্রেট’ বোলার নন। তবে তিনি এমন বোলার, যাঁর অনেক ‘গ্রেট’ স্পেল আছে। ২০১৫ সালে ট্রেন্ট ব্রিজ টেস্টে অস্ট্রেলিয়াকে ৬০ রানে অলআউট করে দেওয়া সে ইনিংসে তাঁর ১৫ রানে ৮ উইকেটের স্পেল যেমন। ট্রেন্টব্রিজে ব্রড সেদিন ‘ব্রুটাল’ হয়ে উঠেছিলেন। যেটিকে অ্যাশেজের ইতিহাসেরই সেরা না হলেও অন্যতম সেরা তো ধরাই হয়। ব্রডের ক্যারিয়ারেরও অন্যতম হাইলাইটস সেটি।
সে ম্যাচে চোটের কারণে বাইরে ছিলেন অ্যান্ডারসন। দুজন বেশ ভালো বন্ধু হলেও ক্যারিয়ারে বরাবরই ওই মানুষটার ছায়ায় ছিলেন ব্রড। তবে যখনই সুযোগ পেয়েছেন, ব্রড অমন বোলিং করে যেন বারবার বলেছেন—সে ছায়াতে তাঁর ঔজ্জ্বল্য ঢাকা পড়ে না মোটেও।
অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সর্বশেষ অ্যাশেজে একটি টেস্ট ড্র করাই ছিল ইংল্যান্ডের অর্জন (যে সিরিজটিকে আবার করোনাভাইরাসের বিধিনিষেধের কারণে অ্যাশেজ হিসেবে গণ্য না করার ঘোষণা দিয়েছিলেন ব্রড), সিডনিতে ম্যাচ বাঁচিয়েছিল ব্রড-অ্যান্ডারসনের শেষ উইকেট জুটি। এরপর যখন দল থেকে দুজনই বাদ পড়েছিলেন, অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন, ব্রড-অ্যান্ডারসনের শেষ ছবি হয়ে থাকছে সেটিই। অথচ ইংল্যান্ড এখন ড্র-কে টেস্টের ‘অপশন’ হিসেবে বিবেচনা না করার ঘোষণা দেয়! আর ব্রড দুর্দান্ত একটি সিরিজ শেষে বিদায় নেওয়ার আচমকা ঘোষণা দেন।
ব্রড এমনই একজন, তাঁর অমন বিদায়ের পর তাই মনে পড়ে ওই টুইটার আইডির কথা। সেখানে অন্যান্য কথার ভিড়ে আছে, ‘ফলে আরেকবার তার ব্যাটিং উদ্যাপনের সুযোগ আমাদের সামনে (বেন স্টোকস, এবার যদি আপনি সাহস দেখিয়েছেন!), আরেকবার তাকে দেখার সুযোগ, আশা করি কাভারের ওপর দিয়ে বা ডিপ মিডউইকেটের ওপর দিয়ে মারবেন তিনি। আর এরপর, বিদায়…। আরেকবার, স্টুয়ার্ট, শুধু আর একবার।’
ব্রডের ব্যাটিংয়ের সুযোগ পাওয়াটা স্টোকসের ওপর নির্ভর করছে। বোলিংয়ের সুযোগও পাবেন আর এক ইনিংসেই। ওভাল ব্রডের অন্যতম প্রিয় একটি ভেন্যু, অ্যাশেজ তাঁর প্রিয় সিরিজ, অস্ট্রেলিয়া তাঁর প্রিয় প্রতিপক্ষ। ব্রডের জন্য মঞ্চটা প্রস্তুত। হয়তো আরেকবার দর্শকদের জাগিয়ে তুলবেন তিনি। হয়ত আরেকবার আম্পায়ার আউট দেওয়ার আগেই শুরু করে দেবেন উদ্যাপন। হয়তো রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে ভেতরের দিকে ঢোকা কোনো বল পড়ার পর বেরিয়ে যাবে বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের কাছ থেকে, তার আগে চুমু দিয়ে যাবে ব্যাটের কানা। হয়তো ওভার দ্য উইকেট থেকে ওবল সিমের কোনো বল ধোঁকা দেবে কোনো ডানহাতিকে।
আর এরপর, বিদায়।
‘ইজ স্টুয়ার্ট ব্রড ব্যাটিং?’ নামের টুইটার আইডিটা এরই মধ্যে বিদায় চেয়ে নিয়েছে। কারণ, এই অ্যাশেজ শেষে ‘স্টুয়ার্ট ব্রড ইজ নো লঙ্গার প্লেয়িং’।