মোহাম্মদ শামির ক্যারিয়ার থমকে যেতে পারত ২০১৮ সালেই। স্ত্রীর করা মামলা, ম্যাচ গড়াপেটার অভিযোগ আর বোর্ডের কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে বাদ পড়ে শামির দৈনন্দিন জীবন তখন জেরবার। পরিস্থিতির ভয়াবহতা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে শামি আত্মহত্যার চিন্তাও করে ফেলেছিলেন।
শামির ক্যারিয়ার থেমে যেতে পারত ২০২১ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পরেই। দুবাইয়ে গ্রুপ পর্বের খেলায় পাকিস্তানের কাছে ১০ উইকেটে হেরেছিল ভারত। সেদিন ভারতীয় বোলারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রান দেওয়ায় শামিকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলে নজিরবিহীন গালমন্দ। অনেকের চোখেই শামি হয়ে ওঠেন ‘বিশ্বাসঘাতক’।
এসবেরও আগে শামি আটকে যেতে পারতেন ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটেই। ভালো খেলেও উত্তর প্রদেশের বয়সভিত্তিক দলে জায়গা পাননি রাজনীতির কারণে। সুযোগ পেতে পশ্চিমবঙ্গে গিয়েও পড়েন নানা চ্যালেঞ্জে।
ক্যারিয়ারজুড়ে এমন নানা চ্যালেঞ্জ আর বাধাবিপত্তির মুখে পড়া শামিই এখন ভারতের হয়ে বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি উইকেটের মালিক। ওয়ানডেতে ভারতীয়দের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৫ উইকেটও তাঁরই। শুধু ভারত নয়, ৩৩ বছর বয়সী শামি শীর্ষে বিশ্বকাপ ইতিহাসেও—বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ৫ উইকেট নেওয়া দুই বোলারের একজন তিনি।
হার না মেনে সংকল্পে অটল থাকার গল্প লেখা শামি কিন্তু ভারতের বিশ্বকাপ পরিকল্পনায় শীর্ষে ছিলেন না। যশপ্রীত বুমরা ও মোহাম্মদ সিরাজদের কেউ খুব বাজে করলে কিংবা চোটে পড়লেই শুধু খেলানো হবে—এমনটাই ছিল টিম ম্যানেজমেন্টের পরিকল্পনা। কিন্তু হার্দিক পান্ডিয়ার চোট শামির জন্য দুয়ার খুলে দেয়। বাংলাদেশের বিপক্ষে চোট পেয়ে পান্ডিয়া পরের ম্যাচ থেকে ছিটকে গিয়েছিলেন (শেষ পর্যন্ত টুর্নামেন্টই শেষ হয়ে গেছে তাঁর)। পান্ডিয়ার সঙ্গে শার্দূল ঠাকুরকে দলে রেখে বোলিং সাজিয়েছিল ভারত। কিন্তু পান্ডিয়াকে হারিয়ে ফেলায় বোলিং শক্তি পোষানোর জন্য শার্দূলের জায়গায় শামিকে ফেরায় টিম ম্যানেজমেন্ট। আর সেটা যে কতটা ভালো সিদ্ধান্ত ছিল, সেটা শামি প্রমাণ করে প্রথম ডেলিভারিতেই।
২২ অক্টোবরে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে নিজের প্রথম ওভারের প্রথম বলেই উইল ইয়ংকে বোল্ড করেন শামি। সেখানেই থামেননি। সেদিন শামি তাঁর দশ ওভারের বোলিং কোটা শেষ করেন ৫৪ রানে ৫ উইকেট তুলে। যে পারফরম্যান্স তাঁর হাতে এনে দেয় ম্যাচসেরার স্বীকৃতিও।
শামি তাঁর পরের ম্যাচটি খেলেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। এই ম্যাচে তিনি সেরার পুরস্কার পাননি। তবে ৭ ওভারে মাত্র ২২ রান দিয়ে ৪ উইকেট নেওয়ার পথে ব্যাটসম্যানদের যে আতঙ্কের মধ্যে ফেলেন, ম্যাচ শেষে তাঁকে ‘বোলার অব দ্য টুর্নামেন্ট’ বলে অভিহিত করেন বেন স্টোকস, যিনি নিজেই শামির দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে বোল্ড হয়েছেন। বিশ্বকাপে শামি তৃতীয় ম্যাচ খেলেন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে, মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়েতে। এবার আরও শাণিত, আরও ভয়ংকর।
প্রথম ১৪ ডেলিভারিতেই ৪ উইকেট তুলে নিলে ওয়াংখেড়েজুড়ে শুরু হয় ‘শামি, শামি’ স্লোগান। ওই স্লোগানের মধ্যেই কাসুন রাজিতাকে দ্বিতীয় স্লিপে শুবমান গিলের ক্যাচ বানিয়ে পূর্ণ করেন ৫ উইকেট। বিশ্বকাপে তাঁর তৃতীয় ৫ উইকেট, এবারের আসরে দ্বিতীয়। রাজিতার উইকেটটিই শামিকে তুলে দেয় ভারতের হয়ে বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি উইকেটশিকারি তালিকার শীর্ষে। জহির খান ও জাভাগাল শ্রীনাথের ৪৪ উইকেট ছাড়িয়ে শামির উইকেট–সংখ্যা ৪৫। বিশ্বকাপ ছাড়িয়ে রেকর্ড গড়েন ওয়ানডেতেও।
শ্রীনাথ ও হরভজন সিংকে (৩) ছাড়িয়ে ভারতের হয়ে ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ চারটি ৫ উইকেট। আর মিচেল স্টার্কের মতো বিশ্বকাপে তিনটি ৫ উইকেটে ভাগ তো আছেই।
উচ্ছ্বাসে, কৃতজ্ঞতায় উদ্যাপন করতে গিয়ে মাটিতে হাত ঠেকিয়ে হাঁটু গেড়ে বসেন শামি। কিছুক্ষণের মধ্যে সতীর্থরা এসে গেলে ফের মাথা উঁচু করে দাঁড়ান। এই উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়াটাই শামির ক্যারিয়ারের আসল ‘হাইলাইটস’।
২০১৪ সালে ক্রিকেটমান্থলিকে মোরাদাবাদের কোচ বাহারুদ্দিন সিদ্দিকী শুনিয়েছিলেন, কীভাবে অনুশীলনে পরিশ্রমী একটা ছেলেকে ক্রিকেটের জন্য নিজের রাজ্য ছাড়তে হয়েছিল, ‘অনুশীলনে খুবই পরিশ্রমী এবং নিয়মিত ছিল। একটা দিনও ছুটি নিত না। উত্তর প্রদেশের অনূর্ধ্ব–১৯ ট্রায়ালে ভালো বোলিংও করে। কিন্তু রাজনীতির কারণে জায়গা পায়নি।’ সিদ্দিকীই শামির বাবাকে ছেলেকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন।
উত্তর প্রদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে আসার পরের যাত্রাটাও অবশ্য অনুকূলে ছিল না। শুরুতে খেলতেন নিচের দিকের ক্লাব ক্রিকেটে। পরে ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গলের সাবেক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি দেবব্রত দাস তাঁকে টাউন ক্লাবে জায়গা করে দিলে সামর্থ্যের প্রমাণ রেখে একটা সময় জায়গা করে নেন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য দলেও। এ নিয়ে দেবব্রত ক্রিকইনফোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘শামি কখনোই টাকা চাইত না। ওর লক্ষ্য ছিল স্টাম্প, বল স্টাম্পে আঘাত করার শব্দটা।’
ভারতের প্রথম শ্রেণির সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতা রঞ্জি ট্রফির প্রথম আসরেই (২০১২–১৩) ৫ ম্যাচে ২৮ উইকেট তুলে নির্বাচকদের দৃষ্টিতে চলে আসেন শামি। ২০১৩ সালে পাকিস্তান ম্যাচ দিয়ে অভিষেক হয়ে যায় জাতীয় দলেও।
যে পশ্চিমবঙ্গে শামির জীবনের মোড় ঘুরে যায়, সেখানেই ২০১৪ সালে বিয়ে করেন হাসিন জাহান নামের এক মডেলকে। এই হাসিনকে কেন্দ্র করে পরবর্তী সময়ে শামির ক্যারিয়ারে রীতিমতো দুর্যোগ নেমে আসে। ২০১৮ সালে হাসিন শামির বিরুদ্ধে বিবাহবহির্ভূত একাধিক সম্পর্কে জড়ানোর অভিযোগ তোলেন। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগে শামির বিরুদ্ধে মামলাও করেন।
হাসিনের অভিযোগগুলোর অন্যতম ছিল ম্যাচ গড়াপেটার অভিযোগ। শামি ফিক্সিং করেছেন—এমন অভিযোগে তদন্ত শুরু করে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড বিসিসিআই। এমনকি শামির সঙ্গে থাকা কেন্দ্রীয় চুক্তি স্থগিতও করা হয়।
২০২০ সালে করোনা মহামারির সময় রোহিত শর্মার সঙ্গে এক ইনস্টাগ্রাম চ্যাটে শামি জানান, হাসিনের মামলা ও বোর্ডের চুক্তি হারানো টালমাটাল ওই সময়ে তিনবার আত্মহত্যার চিন্তা করেছিলেন তিনি। পরিবারের শঙ্কা ছিল, ২৪ তলা অ্যাপার্টমেন্ট থেকে ঝাঁপ দিতে পারেন শামি, এ জন্য সার্বক্ষণিক দুই–তিনজন বন্ধু তাঁকে পাহারা দিতেন। শামি অবশ্য সেই দুঃসময় কাটিয়ে মাঠে ফিরেছেন ভালোভাবেই। তবে ২০২১ বিশ্বকাপে আবারও দুঃসময় ধেয়ে আসে তাঁর জীবনে। পাকিস্তানের বিপক্ষে ৩.৫ ওভারে ৪৩ রান দেওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গালমন্দ, হুমকিও দেওয়া হয় তাঁকে।
পরিস্থিতি এতটাই অস্বস্তিকর ছিল যে ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহলি সংবাদ সম্মেলনে এসে শামিকে দোষারোপকারীদের ‘মেরুদণ্ডহীন’ বলে আখ্যা দেন। এরপরও অবশ্য বিদ্বেষী আচরণ থেকে পুরোপুরি মুক্তি পাননি শামি। চলতি বছর বোর্ডার–গাভাস্কার ট্রফির আহমেদাবাদ টেস্টে শামিকে উদ্দেশ করে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দেওয়া হয় নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামের গ্যালারি থেকে। এ সময় সূর্যকুমার যাদব দর্শকদের চুপ করতে বললেও কাজ হচ্ছিল না।
শামি জানেন, দর্শকদের দুয়ো স্লোগানে পরিণত করতে লাগে দারুণ কিছু পারফরম্যান্স। আর তাই তো দমে না গিয়ে সুযোগের অপেক্ষায় থেকেছেন সব সময়। আর সেটিরই ফসল—ওয়াংখেড়েতে ‘শামি শামি’ স্লোগান।