বাংলাদেশের অনুশীলনে মুশফিকুর রহিম ও সাকিব আল হাসান
বাংলাদেশের অনুশীলনে মুশফিকুর রহিম ও সাকিব আল হাসান

‌‘দোয়া করেন যেন টসটা জিতি’

‌‘দোয়া করেন যেন টসটা জিতি।’ হাসতে হাসতে বললেন সাকিব আল হাসান।

জিতলে কী করবেন, কেউ আর এই প্রশ্নটা করলেন না। উত্তরটা যে সবার জানাই।

জস বাটলার মনে হচ্ছে অন্য অধিনায়কদের বড় একটা উপকারই করে দিয়েছেন। মুম্বাইয়ে টস জিতলে কী করতে হবে, এ নিয়ে তাঁদের কাউকে আর একদমই ভাবতে হচ্ছে না।

তিন দিন আগে এই মাঠেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ২২৯ রানের বিশাল পরাজয়ে বিবর্ণ এখন ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ ধরে রাখার স্বপ্ন। ওই বিশাল পরাজয়ের নিশ্চয়ই আরও অনেক কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে। তবে আপাতত সবাই একমত, মুম্বাইয়ের এই অসহনীয় গরমে প্রথমে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েই ইংল্যান্ডের সর্বনাশ করেছেন বাটলার।

বাংলাদেশ-দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচের আগে তাই অদ্ভুত একটা আবহ। যেন প্রথম বলটি হওয়ার আধঘণ্টা আগেই ঠিক হয়ে যাবে এই ম্যাচের ফল! আধঘণ্টা আগে মানে দুই অধিনায়ক যখন টস করতে নামবেন আরকি। শুধু অসহ্য গরমে ফিল্ডিং করতে হওয়া না-হওয়াই একমাত্র বিবেচনা নয়। জস বাটলার আমলেই নেননি, এমন একটা তথ্যও বারবার সামনে আসছে। রান তাড়া করতে নামলেই দক্ষিণ আফ্রিকা বেশির ভাগ সময় গুবলেট পাকিয়ে ফেলে। শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডকে উড়িয়ে দেওয়া দল এই বিশ্বকাপে যে একটা ম্যাচই হেরেছে, সেটিতেও তো এই গল্পই।

মোহাম্মদ আশরাফুল এই বিশ্বকাপে দেখা দিয়েছেন অন্য ভূমিকায়। খেলোয়াড় হিসেবে তিনটি বিশ্বকাপে খেলেছেন, এবার এসেছেন বাংলাদেশের একটি স্পোর্টস চ্যানেলের বিশেষজ্ঞ হিসেবে।

অন্য ভূমিকায় আশরাফুল

মাঠে দাঁড়িয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত দিচ্ছেন। বাকি সময়ের বেশির ভাগই কাটাচ্ছেন প্রেসবক্সে। সাবেক বাংলাদেশ অধিনায়কও তো দেখছি বাংলাদেশের জয়ের প্রথম পূর্বশর্ত বলে ধরে নিয়েছেন টস জেতাটাকে! কারণ ওই দুটিই। গরম আর রান তাড়ায় দক্ষিণ আফ্রিকার দুর্বলতা। টসে জিতে প্রথমে ব্যাটিং করলেই বাংলাদেশ জিতে যাবে, এমন কথা অবশ্যই বলছেন না। এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে প্রলয়ংকরী ব্যাটিং লাইনআপকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে বাংলাদেশ দলের কাছে আশরাফুলের চাওয়া ৩২০-৩৩০ রান।

গুয়াহাটিতে আসাম ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন স্টেডিয়ামে অনুশীলনে বাংলাদেশ দল

মানে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে গত বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই যা করেছিল বাংলাদেশ। এই বিশ্বকাপের চার ম্যাচে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্কোর ২৫৬। ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে ওভালে ৬ উইকেটে ৩৩০ রানের সেই স্কোর এখন তাই একটু অসম্ভব কল্পনা বলে মনে হতেই পারে। ধরে নেওয়া যাক, এই ম্যাচেই জেগে ওঠা বাংলাদেশের ব্যাটিং ৩২০-৩৩০ রান করে ফেলল। তাতেও কিন্তু ‘বাংলাদেশ জিতবেই’ ঘোষণা দিতে রাজি নন আশরাফুল। তাঁর জয়ের রেসিপিতে পরের সংযোজন—শুরুতেই স্পিনার লাগিয়ে উইকেট তুলে নেওয়া।

বিশ্ব ক্রিকেটে বড় দলগুলোর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষেই সম্ভবত সবচেয়ে ভালো রেকর্ড বাংলাদেশের। একাধিক দ্বিপাক্ষিক সিরিজে জয় আছে। বিশ্বকাপেও জয় আছে দুটি। বাংলাদেশকে তাই যথেষ্টই সমীহ করছে দক্ষিণ আফ্রিকা। ম্যাচপূর্ব সংবাদ সম্মেলনে এইডেন মার্করামের কথায় যা ফুটে উঠল পরিষ্কার। যা বললেন, তার সারকথা একটাই। আগের ম্যাচে কী করেছেন না করেছেন, সেসব এখন অতীত। এখন আরেকটা ম্যাচ, আরেকটা দিন। নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে পরাজয়ে যা আরও ভালো করে টের পেয়েছেন তাঁরা।

ক্লাসেন ঝড়ে সর্বশেষ ম্যাচে ৩৯৯ রান করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা

সাকিব আল হাসানও আগের ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকা কী করেছে, তা নিয়ে বেশি ভাবতে রাজি নন। না ভাবাই ভালো। ভাবতে গেলে হাত-পা অসাড় হয়ে পড়তে পারে। মোহাম্মদ আশরাফুলের সঙ্গে বাংলাদেশের এই দলের খুব একটা যোগাযোগ নেই। নইলে সাকিবকে ভালো একটা টোটকা দিতে পারতেন। যে মাঠে একটা দল তিন দিন আগেই ৩৯৯ রান করেছে, সেই দলের মুখোমুখি হওয়ার আগে কেমন লাগতে পারে?

কথাচ্ছলেই প্রশ্নটা করা। আশরাফুল নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই উত্তরটা দিলেন। ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচ ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে। এর আগে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেই বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচেই টি-টোয়েন্টিতে প্রথম সেঞ্চুরি করে বসেছেন ক্রিস গেইল। ওয়েস্ট ইন্ডিজ করেছে ২০৫ রান। তা তাড়া করে আবার জিতেও গেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। তখন বাংলাদেশের অধিনায়ক মোহাম্মদ আশরাফুল। দলের মধ্যকার অস্বস্তিটা যিনি ঠিকই টের পাচ্ছিলেন। ‘আমরা তো ভাবছি, ওরে বাবা, ক্রিস গেইলের সামনে পড়লে আমাদের কী হবে! কি হয়েছিল জানেন, তৃতীয় বলেই শূন্য রানে আউট গেইল।’

সেদিন অবিশ্বাস্য এক ইনিংস খেলা হেনরিক ক্লাসেন-ও আজ শূন্য রানে আউট হয়ে যেতেই পারেন। হতে পারে আরও অনেক কিছুই। তবে টস নিয়ে এত কথাবার্তায় আরেকটা তথ্যও যোগ করে নেওয়া উচিত। দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথম ব্যাট হাতে তুললেই কিন্তু মহাবিপদ। প্রথমে ব্যাটিং করলে এই দল তিন শর কম করে না। সবকিছু ঠিকঠাক হলে চার শ-ও করে ফেলে। এই বিশ্বকাপে তিনবার আগে ব্যাটিং করে স্কোর ৪২৮, ৩১১ ও ৩৯৯।

মিরাজরা আজ কঠিন পরীক্ষার সামনে

বাংলাদেশের বোলিং আজ তাই কঠিনতম পরীক্ষার সামনে। অথচ সাম্প্রতিক অতীতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশে সফলতম বোলারই আজ নেই। তাসকিন আহমেদের কাঁধের পুরোনো সমস্যা একটু বেশিই ভোগাচ্ছে এখন। ভারতের বিপক্ষে গত ম্যাচেও খেলেননি। খেলছেন না আজও।

এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম তিন ম্যাচে যতই নিজের ছায়া হয়ে থাকুন না কেন, তারপরও তাসকিনকে না পাওয়াটা বড় একটা ধাক্কা। সুখবরও অবশ্য আছে একটা। অধিনায়ককে ফিরে পাচ্ছে বাংলাদেশ। এই বিশ্বকাপে অন্য অধিনায়কেরা একাধিকবার সংবাদ সম্মেলনে এসেছেন, সাকিবই হয়ে ছিলেন একমাত্র ব্যতিক্রম। নিজের মুখে সুখবরটা জানাতেই হয়তো কালই প্রথম এলেন সংবাদ সম্মেলনে। সেখানে যথারীতি ইতিবাচকতার প্রতিমূর্তি। টানা তিন পরাজয়েও সব শেষ হয়ে যায়নি ঘোষণা করে জানিয়ে দিলেন, সেমিফাইনালের স্বপ্ন তিনি এখনো দেখছেন। মজা করেই বললেন, ‘পয়েন্ট টেবিলটা দেখেন না! আমরা যা-ই করি না কেন, অন্যরা আমাদের সাহায্য করছে।’

সাকিব তো তখনো জানেন না, সাহায্য আরও আসছে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পাকিস্তানকেও হারিয়ে দিয়ে সেমিফাইনালে ওঠার লড়াইটাকে আরও জমিয়ে তুলবে আফগানিস্তান!