৩৬ রান করেছেন লিটন
৩৬ রান করেছেন লিটন

উৎপল শুভ্রর লেখা

মেরুন জ্যাকেট গায়ে নিউইয়র্কে লিটন দাস

শিরোনামটাকে আক্ষরিক অর্থে নেবেন না। শনিবার দুপুরে ডালাস থেকে নিউইয়র্কে এসেছে বাংলাদেশ দল। লিটন দাস অবশ্যই তখন মেরুন জ্যাকেট পরে ছিলেন না। তবে অদৃশ্য একটা মেরুন জ্যাকেট তো ছিলই তাঁর গায়ে। সেটি আবার কেমন? একটু ধীরে ধীরে বলি। এর আগে ফিরিয়ে নিয়ে যাই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচে।

অল্প রানের ম্যাচ। তবে নায়ক অনেক। তারপরও ম্যাচসেরা হিসেবে কাউকে না কাউকে বেছে নিতে হয়। সেই স্বীকৃতি পেয়েছেন রিশাদ হোসেন। শ্রীলঙ্কান ইনিংসের মাঝপথে ৩ উইকেট নিয়ে জয়ের ভিতটা তো এই লেগ স্পিনারেরই গড়ে দেওয়া।

ব্যাটিংয়ে দারুণ একটা শুরুর পর শ্রীলঙ্কাকে পথ ভুলিয়ে দেওয়ার কাজটা করেছেন রিশাদই। এরপর ম্যাচটা সহজেই জেতার কথা ছিল বাংলাদেশের। কিন্তু ‘কথা ছিল’ কথাটাই ক্রিকেটে অচল। শ্রীলঙ্কার মামুলি সংগ্রহ টপকে যেতে বাংলাদেশের কেমন জীবন বেরিয়ে গেছে, এটা তো আপনার জানাই।

সেরা বোলার অবশ্যই রিশাদ। তবে সাকিবকে বাদ দিলে বাংলাদেশের সব বোলারই ভালো করেছেন। মোস্তাফিজ ছিলেন দুর্দান্ত। চোট থেকে ফেরা তাসকিনও। তানজিমও খারাপ করেননি।

ম্যাচসেরার পুরস্কারটা রিশাদেরই প্রাপ্য। তবে রিশাদকে না দিয়ে সেটি তাওহিদ হৃদয়কে দিলেও কি তা খুব একটা বিস্ময় হয়ে আসত? ২০ বলে ৪০ রানের ওই টি-টোয়েন্টি ক্ল্যাসিকটা না খেললেই তো বাংলাদেশ ম্যাচটা জেতে না। ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গার পরপর তিন বলে মারা হৃদয়ের ছক্কা তো বাংলাদেশের ইনিংসেরই হাইলাইট।

বাংলাদেশের জয়ে এত নায়কের ভিড়ে আরেকজন একটু আড়ালে চলে যেতে পারেন। তিন নম্বরে ব্যাটিং করেও যাঁকে নামতে হয়েছে প্রথম ওভারেই। সাদা বলের ক্রিকেটে সর্বশেষ ১৮টি ইনিংসে যাঁর কোনো হাফ সেঞ্চুরি নেই। এই বিশ্বকাপে আসার আগের কিছুদিন যাঁর টালমাটাল সময় কেটেছে।

সময়টা ভালো যাচ্ছিল না লিটনের

ওয়ানডে দল থেকে বাদ পড়েছেন, টি-টোয়েন্টি একাদশ থেকেও। লিটন কুমার দাস এদিনও হাফ সেঞ্চুরি করতে পারেননি। সেঞ্চুরি-হাফ সেঞ্চুরি ব্যাটিং সাফল্যের একটা নির্দেশক বটে, তবে কখনো কখনো ছোট্ট একটা ইনিংসও গভীর তাৎপর্যবহ হয়ে ওঠে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে লিটনের ৩৮ বলে ৩৬ রান এমনই একটা ইনিংস।

যেটির স্বীকৃতি ওই মেরুন জ্যাকেট। ম্যাচ শেষে যা পরিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁকে। এই মেরুন জ্যাকেট কী বা কেন, এটা আপনার জানাও থাকতে পারে। এই মেরুন জ্যাকেটের ধারণাটা বেরিয়েছে কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের মাথা থেকে। এই মেরুন জ্যাকেট ‘ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার’-এর স্বীকৃতি। বাংলাদেশের প্রতিটি ম্যাচের পর দলের একজন ক্রিকেটার যে স্বীকৃতি পান। সেটি জিতলে যেমন, তেমনি হেরে গেলেও। এই ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার নির্বাচনের কাজটা করেন বাংলাদেশের কোচিং স্টাফ। সবচেয়ে বেশি রান বা বেশি উইকেট পেলেই যে তা পাওয়া যাবে, এমন নয়। বিবেচনায় নেওয়া হয় ম্যাচে প্রভাব। একাদশে নেই, এমন কোনো খেলোয়াড়ও কখনো তা পেয়ে যেতে পারেন।

মেরুন জ্যাকেটজয়ী ক্রিকেটারের একটা বাড়তি দায়িত্বও থাকে। দলকে চাঙা করে তোলার দায়িত্ব, উদ্দীপ্ত করার দায়িত্ব। এই মেরুন জ্যাকেট ধারণাটার জন্মই তো এই উদ্দেশ্যে। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের চাপে ম্রিয়মাণ হয়ে থাকতে দেখেই কোচ হাথুরুসিংহের মনে হয়েছিল, এমন কিছু করলে কেমন হয়! ধারণাটা অবশ্য পেয়েছিলেন একটা ব্যান্ড দল থেকে। কয়েক মাস আগে বিসিবি থেকে দেওয়া একটা ভিডিওতে এই মেরুন জ্যাকেটের ধারণাটা কোত্থেকে এল, তা ব্যাখ্যা করেছিলেন সে সময় দলের ম্যানেজার নাফীস ইকবাল ও কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে।

ওই ভিডিওতে নাফীস বলেছিলেন, ‘এই মেরুন জ্যাকেটের কনসেপ্ট এসেছে একটা গান থেকে, যেখানে মেরুন জ্যাকেট পরে একজনকে পুরো ব্যান্ডকে উৎসাহিত করতে দেখা যায়। ট্রায়ালের সময় পুরো ব্যান্ড খুব নার্ভাস থাকে। তখন হঠাৎ করে একজন এসে পুরো গান এত সুন্দর করে গায়, সবাইকে খুব এক্সাইটেড করে ফেলে।’
ওই ব্যান্ড দলের সঙ্গে হাথুরুসিংহে বাংলাদেশ দলের মিল খুঁজে পেয়েছিলেন, ‘কিয়ারার ওই গানের ভিডিও দেখে মনে হচ্ছিল, আমাদের দলটাও তো এমন, সবাই খুব টেনশনে থাকে। সেই গানে একজন চেয়ারের ওপর উঠে গান ধরে, তাতে সবাই উজ্জীবিত হয়ে নির্ভারভাবে গান গাইতে থাকে। মেরুন জ্যাকেট পরা মানুষটা পুরো রুমের আবহ বদলে দেয়।’

গত বছর ভারতে ওয়ানডে বিশ্বকাপের সময় থেকে এই মেরুন জ্যাকেট পরিয়ে দেওয়ার রীতিটা চালু হয়েছে বাংলাদেশ ড্রেসিংরুমে, যা প্রথম পরেছিলেন মেহেদী হাসান মিরাজ। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ম্যাচে লিটনকে বেছে নেওয়ার কারণ হিসেবে বাংলাদেশ দলের এক সদস্য বলছিলেন, ‘ওই সময়ে লিটন ওই ইনিংসটা খেলে পরিস্থিতি অনেক সহজ করে দেন। এই ম্যাচের আগে সবাই এমন চাপে ছিল, তা বলার মতো না। শুরুতেই ২ উইকেট পড়ে যাওয়ায় সেই চাপ আরও বেড়ে যায়। লিটনের কারণে সেই চাপ চলে যায়। লিটনের ব্যাটিংয়ের মধ্যেই তো একটা শান্তির ব্যাপার আছে।’
তা তো আছেই। লিটনের ব্যাটিং মানে চোখের আরাম, মনের শান্তি। এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমে শান্তি ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটা যত বেশি করতে পারেন, ততই ভালো।