আশিকুর রহমান
আশিকুর রহমান

বড় ভাই আশরাফুলকে ছাপিয়ে ছুটছেন এশিয়া কাপের সেরা আশিকুর

ট্রফি জয়ের পর ফরিদপুরের বাড়িতে ফেরার আগে ঢাকায় বিসিবির সংবর্ধনা ও সংবাদ সম্মেলন। বাড়ি ফিরেও দুদণ্ড বিশ্রামের উপায় নেই। ফরিদপুরের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ছোট করে আরও একবার সংবর্ধনা পান অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপজয়ী বাংলাদেশ দলের সদস্য আশিকুর রহমান। এখানেই ব্যস্ততার শেষ নয়। আগামী রোববার শুরু হতে যাওয়া ওয়ানডে সংস্করণের বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগ (বিসিএল) খেলতে আজ ঢাকায় ফিরতে হবে আশিকুরকে। বিসিএল শেষ হতে না হতেই শুরু হবে যুবাদের বিশ্বকাপ প্রস্তুতি।

১৭ ডিসেম্বর এশিয়া কাপ জেতার পর আশিকুর সেই অর্থে বিশ্রাম পাননি বললেই চলে। এতে অবশ্য তাঁর ক্লান্তি নেই। বরং প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করছেন ১৮ বছর বয়সী এই উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান। গতকাল মুঠোফোনের ওপাশ থেকে সেই রোমাঞ্চ টের পাওয়া যাচ্ছিল, ‘খুব ভালো লাগছে। সবাই অভিনন্দন জানাচ্ছে। মা–বাবা খুশি। ডিসি অফিসে অনানুষ্ঠানিকভাবেই শুভেচ্ছা জানিয়েছে। সংবর্ধনা দিল। সামনে হয়তো বড় করে অনুষ্ঠান করবে। আমার হাতে সময় না থাকায় তাঁরা পরে আরও কিছু করতে চাচ্ছে। সামনে বিসিএলের খেলা আছে।’

আশিকুরের বড় ভাই আশরাফুল আলম

বিসিএল মানেই ‘বড়দের খেলা’, যেখানে বয়সের গণ্ডি নেই। ১৯ জানুয়ারি থেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় হতে যাওয়া অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের আগে প্রথমবারের মতো সিনিয়র পর্যায়ে খেলার স্বাদ পেতে যাচ্ছেন আশিকুররা। ক্যারিয়ারের পরের অধ্যায়ে পা দেওয়ার আগে আশিকুর জানালেন দেশের হয়ে প্রথমবারের মতো এশিয়া কাপ জেতার অনুভূতি, ‘বড় অর্জন বলতেই হয়। আমরা চেষ্টা করেছি, পেয়েছিও। টুর্নামেন্টের আগে আমাদের পারফরম্যান্স “অন অ্যান্ড অফ” ছিল। আমরা ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই পারফর্ম করছিলাম, কিন্তু দল হিসেবে খেলা হচ্ছিল না। এশিয়া কাপে ঠিক সময়ে এসে সেটা করতে পেরেছি।’

বয়সভিত্তিক পর্যায়ে এশিয়ার সেরা হওয়ার পর আশিকুর এখন বিশ্বের সেরা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। ২০২০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের শিরোপা জিতেছিল বাংলাদেশ। এবার শ্রীলঙ্কায় হওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত সেটি হবে দক্ষিণ আফ্রিকাতেই। আশিকুররা পারবেন আকবর আলীদের গড়া ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করতে? উত্তরটা খুব বড় দিলেন না, তবে তাতেই ইঙ্গিত বড় স্বপ্নের, ‘চেষ্টা তো থাকবেই।’ পরে যোগ করলেন, ‘তবে ম্যাচ ধরে ধরে এগোতে চাই। এশিয়া কাপেও এভাবে খেলেছি। বিশ্বকাপেও সেটা করতে চাইব।’

আশিকুর ছিলেন অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক, টুর্নামেন্ট–সেরা খেলোয়াড়ও। ৫ ম্যাচে ৫ ইনিংসে ৩৭৮ রান করেছেন বাংলাদেশ দলের এই ওপেনার। ছিল ২টি করে শতক ও অর্ধশতক। এমন পারফরম্যান্সের রহস্যটা শুনুন আশিকুরের মুখেই, ‘এশিয়া কাপে যাওয়ার আগে ভারতে একটা সিরিজ খেলেছিলাম। সেখানে ভালো করছিলাম। কিছু স্টার্ট পেয়ে যাই। কিন্তু আশানুরূপ (বড়) হয়নি। একটা ১০০, একটা ৫০–এর পর বাকি ইনিংসগুলো বড় হয়নি। ২৭, ২৫, ১৫—এমন রান করে আউট হয়েছি। এগুলো যদি ৫০-এ নিতে পারতাম, সেই ৫০-কে যদি ১০০-তে নিতে পারতাম, তাহলে আরও ভালো হতো। এশিয়া কাপে সেটাই চেষ্টা করেছি, নিজের উইকেটের মূল্য দিয়েছি। উল্টাপাল্টা শট খেলে আউট হব না, এটাই চেষ্টা করেছি।’

অনূর্ধ্ব–১৯ এশিয়া কাপে সবচেয়ে বেশি রান করেন আশিকুর

লম্বা সময় ব্যাটিংয়ের জন্য ফিটনেস ও মনোযোগের গুরুত্বটাও মনে করিয়ে দিলেন এই তরুণ, ‘ফিটনেস আর মনোযোগ—এই দুটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। নিজের ওপর সন্তুষ্ট হওয়া যাবে না। ৩০ করেছি, মানে আমি নিরাপদ—এ রকম না ভাবাটা ভালো। লম্বা সময় মনোযোগ ধরে রাখার ব্যাপার এটা। ব্যাটসম্যান হিসেবে যদি মনোযোগ হারিয়ে বসেন, তাহলে বোলারের একটা ভালো বলই আপনাকে আউট করবে। মনোযোগটা প্রথম থেকে শেষ বল পর্যন্ত একই থাকতে হবে।’

শুধু ব্যাটিংয়ে নয়, আশিকুরকে মনোযোগ ধরে রাখতে হয় উইকেটকিপিংয়েও। তিনি আবার মহেন্দ্র ধোনির বিরাট ভক্ত। ভারতীয় বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়কের সবকিছুই আশিকুরের পছন্দ, ‘ধোনিকে আমি ছোটবেলা থেকেই পছন্দ করি। ওনার অ্যাটিটিউড, কথাবার্তা—সবকিছুই। তাঁর অধিনায়কত্ব থেকে শুরু করে যা আছে, সবকিছুই খুব পছন্দ করি।’ আরেক ভারতীয় বিরাট কোহলিও আশিকুরের প্রিয় ক্রিকেটার, ‘ওনার ব্যাটিং আমি খুব পছন্দ করি।’ একজন ব্যাটসম্যান, আরেকজন উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান—আধুনিক ক্রিকেটের দুই কিংবদন্তির সমন্বয়ে উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান আশিকুর রহমান? প্রশ্নটা শুনে হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমি শুধু চেষ্টা করি।’

সেই চেষ্টার শুরুটা কীভাবে, সেটি তিনি বললেন এভাবে, ‘শুরুটা হয় ফরিদপুর জেলার অনূর্ধ্ব-১২ দল থেকে। ফরিদপুর জেলার কোচ মোখলেসুর রহমান স্যার আমাকে সেই টুর্নামেন্টে খেলতে বলেন। সেখানে সর্বোচ্চ রান করি। এর পর থেকে তিনি আমাকে নিয়মিত অনুশীলন করতে বলেন। ফরিদপুরের সব কটি বয়সভিত্তিক পর্যায়ের দলে আমি খেলে এসেছি।’

অনূর্ধ্ব–১৯ এশিয়া কাপে দুটি শতক পেয়েছেন আশিকুর

আশিকুরের ক্যারিয়ারে বড় ভাই আশরাফুল আলমের অবদানও কম নয়। তিনি নিজেও ক্রিকেটার। ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে বেশ পরিচিতই তিনি, খেলেন প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ লিগে। আগামী মৌসুমে খেলবেন প্রিমিয়ার লিগেও। একটা সময় বিসিবির বয়সভিত্তিক প্রক্রিয়ায়ও ছিলেন। কিন্তু পেশাদার ক্যারিয়ার এখন পর্যন্ত ক্লাব ক্রিকেটেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে আশরাফুলের। তবে নিজের যে স্বপ্নটা পূরণ হয়নি, ছোট ভাই পূর্ণ করছেন সেটি।

সেই আশরাফুলই কখনো আশিকুরের বোলিং মেশিন, কখনো কিউরেটর। ভাইয়ের কথা বলতে গিয়ে আশিকুর বললেন, ‘ফরিদপুরে অনুশীলনের সে রকম সুযোগ–সুবিধা তো নেই। ভাই আমার সব ব্যবস্থা করে দিতেন। যখন খেলা শুরু করি, তখন বড় ভাই জাতীয় দলের হয়ে অনূর্ধ্ব-১৭ পর্যায়ে খেলতেন। তারপর প্রথম বিভাগ, দ্বিতীয় বিভাগে। এদিকে আমি খেলা শুরু করতে থাকি। ভাইয়া আমাকে থ্রো মারত। যতক্ষণ লাগত—এক ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা, তিন ঘণ্টা। বল, উইকেট—এসবের ব্যবস্থা করে দিতেন।’
বড় ভাই আটকে গিয়েছিলেন অনূর্ধ্ব-১৭ পর্যায়ে। তবে আশিকুর ছুটছেন এখনো।