বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দলে নেই তামিম ইকবাল
বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দলে নেই তামিম ইকবাল

উৎপল শুভ্রর লেখা

মিনহাজুল থেকে তামিম: বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দল মানেই বিতর্ক

বিশ্বকাপ কে জিতবে—এই প্রশ্নের উত্তর জানতে আরও প্রায় দুই মাসের অপেক্ষা। তবে একটা ক্ষেত্রে বিশ্বকাপের আগেই বাকি ৯ দলকে হারিয়ে বাংলাদেশ বিপুল ব্যবধানে জয়ী। সবার শেষে দল ঘোষণা করাই বাংলাদেশকে আলাদা করে দিতে যথেষ্ট ছিল। সেই দল ঘোষণার আগে যে রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা, সেটির কোনো তুলনা নেই। পরশু রাত থেকে নাটকীয় যে ঘটনাপ্রবাহ, আর কোনো বিশ্বকাপে আর কোনো দলই কি দেখেছে এমন কিছু? মনে হয় না।

এই কিছুদিন আগেও বিশ্বকাপে যাঁর বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেওয়া নিয়ে কোনো সংশয় ছিল না, সেই অধিনায়ক কিনা শেষ পর্যন্ত দলেই নেই! দৃশ্যমান কারণ চোট। এর আগেও যে আততায়ীর শিকার হয়ে অনেক বিখ্যাত খেলোয়াড় ছিটকে পড়েছেন বিশ্বকাপ থেকে। কিন্তু তামিম ইকবালের ঘটনা তো এত সরল নয়। হুট করে অবসর, পরদিনই আবার প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ফিরে আসা...সেই ফিরে আসার পর কে কল্পনা করেছিল, বিশ্বকাপে তিনি দর্শক হয়ে থাকবেন! সেটিও থাকবেন কি থাকবেন না—এ নিয়ে পুরো দেশ তোলপাড় হয়ে যাওয়ার পর। সবকিছু মিলিয়ে যেন সিনেমার এক চিত্রনাট্য।

তামিমকে নিয়ে এই নাটক বলুন বা বিতর্ক, পরশু রাত থেকে তা অনুসরণ করতে করতে মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশের জন্য এ আর নতুন কী! বিতর্ক ছাড়া কখনো বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দল হয়েছে নাকি!

ফিটনেস নিয়ে সংশয় থাকলে সেই খেলোয়াড়কে দলে না নেওয়াটাই স্বাভাবিক। এখানে তা স্বাভাবিক থাকছে না তিনি তামিম ইকবাল বলে। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ওপেনার হিসেবে তর্কাতীত তাঁর অবস্থান। সব ম্যাচ খেলা নিয়ে সংশয় থাকলেও বাংলাদেশ তামিমকে বিসর্জন দেওয়ার বিলাসিতা দেখাতে পারে কি না, এই প্রশ্ন তাই উঠবেই।

নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডের আগে অনুশীলনে তামিম ইকবাল

আরও বেশি উঠছে যাঁর হাতে আবার অধিনায়কত্বের ব্যাটন তুলে দিয়েছেন, সেই সাকিব আল হাসানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কারণে। এক সময়ের হরিহর আত্মা দুই বন্ধু অনেক দিনই মাঠের বাইরে একে অন্যের ছায়াও মাড়ান না। ‘আনফিট’ তামিমের ব্যাপারে সাকিবের আপত্তির কথা জানার পর থেকেই তাই একটা প্রশ্ন মনে জাগছে। তামিমের সঙ্গে সম্পর্কটা আগের মতো থাকলে সাকিব কি বলতেন, পাঁচ-ছয় ম্যাচের জন্য হলেও বিশ্বকাপে আমার তামিমকে লাগবেই লাগবে!

এই প্রশ্নের উত্তর আমরা শুধু অনুমানই করতে পারি। তামিমকে নিয়ে এই নাটক বলুন বা বিতর্ক, পরশু রাত থেকে তা অনুসরণ করতে করতে মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশের জন্য এ আর নতুন কী! বিতর্ক ছাড়া কখনো বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দল হয়েছে নাকি! বলতে গেলে প্রতিটি বিশ্বকাপের আগেই তো বড় হয়ে উঠেছে মাঠের বাইরের ঘটনা। কখনো দল নির্বাচন, কখনোবা অন্য কোনো কারণে। শুরুটা ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ থেকেই। যেটির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন বর্তমান প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন। দল ঘোষণার আগে অলিখিত ট্রায়াল ম্যাচে সেঞ্চুরি করার পরও মিনহাজুলকে বাদ দিয়েছিল এনায়েত হোসেন সিরাজের নেতৃত্বাধীন নির্বাচক কমিটি। অবশ্যই অক্রিকেটীয় কারণে।

বর্তমান প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন ১৯৯৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলে সুযোগ পেয়েছিলেন অনেক সমালোচনার পর

তা নিয়ে পুরো দেশে তোলপাড়। শেষ পর্যন্ত মিনহাজুল দলে এসেছিলেন অভিনব এক পথে। বিকেএসপিতে ক্রিকেট বোর্ডের বিশেষ এক সভায় নির্বাচক কমিটি ভেঙে দিয়ে মিনহাজুলকে ঢোকানো হয়েছিল দলে। সেই সভায় বোর্ডের অনেক সদস্যই ছিলেন না, এমনকি বোর্ড সভাপতিও না! মিনহাজুল দলে ঢোকায় প্রথমে ঘোষিত দলের ওপেনার জাহাঙ্গীর আলম ১৬তম সদস্য হিসেবে পর্যটকের ভূমিকায় দলের সঙ্গে ইংল্যান্ড ঘুরে আসেন।

২০০৩ বিশ্বকাপের আগের গল্পটা ছিল আবার ভিন্ন। যেখানে নির্বাচকদের কোনো ভূমিকা ছিল না। বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে হোটেল পূর্বাণীতে সংবাদ সম্মেলন। যেটি শেষ হওয়ার পর অধিনায়ক খালেদ মাসুদ সাংবাদিকদের জানিয়ে দিলেন, বিশ্বকাপ শেষে তিনি অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেবেন। কানাডার বিপক্ষে হার দিয়ে শুরু আর কেনিয়ার কাছে হেরে শেষ দক্ষিণ আফ্রিকার সেই বিশ্বকাপ দুঃসহ এক ক্ষত হয়ে আছে বাংলাদেশের ক্রিকেটে। নিজেই সরে যাওয়ার ঘোষণা না দিলেও খালেদ মাসুদকে অধিনায়কত্ব হারাতেই হতো। সেই বিশ্বকাপ-ব্যর্থতা নিয়ে তদন্ত কমিটির সামনে বিব্রতকর কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতেই তো ব্যস্ত তখন তিনি।

২০০৭ বিশ্বকাপ দল থেকে খালেদ মাসুদের বাদ দিয়ে মুশফিকুর রহিমকে নেওয়া নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছিল। ছবিটি দল ঘোষণার পরদিন মাসুদের বাসায় তোলা

চার বছর পর ২০০৭ ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপের দল নিয়ে বিতর্কেরও মধ্যমণি খালেদ মাসুদ। তর্কাতীতভাবে তখনো দেশের ১ নম্বর উইকেটকিপার, কিন্তু ব্যাটিং–সামর্থ্যের বিবেচনায় মাসুদকে বাদ দিয়ে বিশ্বকাপ দলে মুশফিকুর রহিম। তা নিয়ে সারা দেশে ক্ষোভের ঝড়। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ছিল, ক্রিকেট বোর্ডের ১৪ জন পরিচালক বিসিবির প্যাডেই খালেদ মাসুদকে বাদ দেওয়ায় ফারুক আহমেদের নেতৃত্বাধীন নির্বাচক কমিটির তীব্র সমালোচনা করে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছিলেন। দেশে তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি সে সময়ের কৃষিসচিব আবদুল আজিজ। তিনিও সাংবাদিকদের বলেছিলেন, এই সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি নির্বাচকদের সঙ্গে কথা বলবেন, বোর্ডের সভাও ডাকতে পারেন।

২০১১ বিশ্বকাপের দল সুযোগ না পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা

বিতর্ক পিছু ছাড়েনি দেশের মাটিতে ২০১১ বিশ্বকাপেও। এর আগে কিছুদিন অধিনায়কত্ব নিয়ে সাকিব আর মাশরাফির মধ্যে মিউজিক্যাল চেয়ারের খেলা চলেছে। সাকিবকে বেশ আগেই বিশ্বকাপের অধিনায়ক ঘোষণা করে দেওয়ায় তা থেমেছে বটে, তবে তখন বিতর্কের নতুন বিষয়, চোট পাওয়া মাশরাফি দলে থাকবেন কি থাকবেন না। মাশরাফি এখনো মনে করেন, তিনি সেই বিশ্বকাপে খেলার মতো ফিট ছিলেন। বিসিবির একাডেমি ভবনে দল ঘোষণার পর পাশের একাডেমি মাঠে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় ভেঙে পড়েছিলেন কান্নায়। ওপরের চাতালে উৎসুক দর্শক-সমর্থকেরা তখন ‘মাশরাফি’ ‘মাশরাফি’ চিৎকারে সরগরম করে তুলছেন চারপাশ।

২০১৫ বিশ্বকাপ দলে বিতর্কের নাম ছিল রুবেল হোসেন। বিশ্বকাপ খেলতে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড যাওয়ার মাসখানেক আগেও যিনি জেলে ছিলেন। অভিযোগটা যে খুব প্রীতিকর ছিল না, তা তো না বললেও চলে। চার বছর আগে ২০১৯ বিশ্বকাপের আগে যা হয়েছিল, তা ঠিক বিতর্ক নয়।

২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে গেলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। নিজের যে খুব উৎসাহ ছিল তা নয়; বরং নির্বাচন করে সংসদ সদস্য হয়ে গেলে তাঁর বিশ্বকাপে খেলা হবে কি না, সেই শঙ্কায় কাতর মাশরাফিকে দেখার স্মৃতি এখনো পরিষ্কার মনে করতে পারি। কে জানে, বিশ্বকাপে গিয়ে নিজেকে হারিয়ে খোঁজায় সেটির ভূমিকা ছিল কি না।

এই তালিকায় এবার তামিমকে যোগ করে নিন। আর আমার সঙ্গে একমত হয়ে যান, বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দল মানেই বিতর্ক।