সাকিব আল হাসান
সাকিব আল হাসান

এই সাকিবকে দেখে কি আপনার কষ্ট হয়

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিমটি বিভিন্নভাবে প্রায়ই দেখা যায়। একটি বয়স্ক শীর্ণকায় সিংহ বসে ঝিমোচ্ছে। আর ক্যাপশনে লেখা, সময় একদিন ফুরিয়ে আসবেই। সেই সময় অবশ্যই শিকারের। বনের সেরা শিকারি হয়েও বয়সের ভারে বাকিদের শিকারের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে সেই সিংহকে—ইঙ্গিতে এমনটা বোঝানো হয় সেই মিমে। সাকিব আল হাসানকে দেখে কি এখন কিছুটা তেমন লাগে?

সাকিব চ্যাম্পিয়ন ক্রিকেটার। বাজে সময় কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো তাঁর রক্তে। অতীতে বহুবার দেখা গেছে। হয়তো সামনে আরও দেখা যাবে। তাই বলে বয়সের স্রোতকে কি আর উল্টো দিকে ঘোরানো যায়? কারও পক্ষে তা সম্ভব? ভেতরে–ভেতরে আপনি যত চনমনে আর চাঙাই থাকার চেষ্টা করুন, বয়সের ছাপ কাজকর্ম থেকে শরীরী ভাষায় ছাপ ফেলবেই। এই চেন্নাই টেস্টেই যেমন সাকিবের ফিল্ডিং তাঁর মানের কাছে হেরে যাচ্ছে।

ভারতের প্রথম ইনিংসে স্কয়ার লেগ থেকে মিড উইকেটে দৌড়ে বলের নিচে পৌঁছাতে পারলেও আকাশ দীপের ক্যাচটি হাতে রাখতে পারেননি। ক্যাচটি কঠিন ছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু ৫ থেকে ১০ বছর আগের সাকিবের রিফ্লেক্সও তো আরও ভালো ছিল। সেই সাকিব থাকলে বলটি কি তাঁর হাত থেকে পড়ত?

উত্তর সবার জানা বলেই স্বীকার করে নিতে হচ্ছে ওটা আসলে বয়সের ছাপ। প্রমাণ আছে আরও। আজ ভারতের দ্বিতীয় ইনিংসে ৫৯তম ওভারে ৯৭ রানে নন–স্ট্রাইক প্রান্তে ছিলেন গিল। স্ট্রাইকে থাকা লোকেশ রাহুল মুমিনুল হকের বলে এক্সট্রা কাভারে ঠেলে দৌড় দেন। বল সাকিবের সোজাসুজি থাকায় গিল ও রাহুল দৌড়ের মাঝপথে একটু থেমেও গিয়েছিলেন। তাতে সময়ও পেয়েছেন সাকিব। কিন্তু কিপিং প্রান্তে দৌড়ানো গিলকে রান আউট করতে পারেননি। বল দ্রুত কুড়িয়ে উইকেটকিপারের হাতে দিতে যে দুটি আবশ্যক শর্ত, তার কিছুই যে পূরণ হয়নি। রিফ্লেক্স কমে যাওয়ায় বল কুড়িয়েছেন দেরিতে, থ্রোও ছিল উইকেটকিপার লিটনের আওতার বাইরে। বয়স্ক সিংহের দুর্বল থাবা থেকে শিকার যেভাবে বের হয়ে যায়, সাকিবকেও দেখেও কি তখন তেমন লাগে?

আকাশ দীপের ক্যাচটি নিতে পারেননি সাকিব

আবার এই বয়সই সাকিবকে রেকর্ডের দেখা পাইয়ে দিয়েছে আজ। চেন্নাই টেস্টে আজ তৃতীয় দিনে সাকিবের বয়স ৩৭ বছর ১৮১ দিন। বাংলাদেশের হয়ে সাকিব এখন সবচেয়ে বেশি বয়সে টেস্ট খেলা ক্রিকেটার। ব্যাপারটি আরও ভেঙে বলা প্রয়োজন।

চেন্নাই টেস্ট শুরুর আগে বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি বয়সে টেস্ট খেলতে নামা ক্রিকেটার ছিলেন মোহাম্মদ রফিক। ২০০৮ সালে চট্টগ্রামে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্টের প্রথম দিনে রফিকের বয়স ছিল ৩৭ বছর ১৭৭ দিন। চেন্নাই টেস্ট শুরুর আগপর্যন্ত রেকর্ডটি রফিকেরই ছিল। সাকিব চেন্নাই টেস্টে প্রথম দিনে মাঠে নেমেই রফিকের সেই রেকর্ডটি ভাঙেন, তখন তাঁর বয়স ৩৭ বছর ১৭৯ দিন। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেই টেস্টের (চার দিন খেলা হয়েছিল) শেষ দিনে রফিকের বয়স ছিল ৩৭ বছর ১৮০ দিন। অর্থাৎ টেস্ট ক্রিকেটে নিজের শেষ দিনে রফিকের বয়স ছিল এটি। সে হিসাবে রফিককে পেছনে ফেলে সাকিব বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বয়সী টেস্ট ক্রিকেটারের রেকর্ডটি গড়লেন আজ।

কিন্তু এমন রেকর্ডে কি কোনো ক্রিকেটারের খুশি হওয়ার কথা? সম্ভবত না। বেশি বয়সে খেলার রেকর্ড মানেই তো দিন ফুরিয়ে আসার প্রতিধ্বনি। সাকিব ভীষণ স্মার্ট ক্রিকেটার। মাথাটা বরাবরই তাঁর পরিষ্কার। ভক্ত কিংবা ক্রীড়া সংবাদকর্মীদের আগেই ব্যাপারটা যে তাঁর মাথায় খেলা করছে, তা যেমন এমনিতেই বলে দেওয়া যায়, তেমনি কিছু বিষয় দেখেও বোঝা যায়। যেমন? প্রথম প্রশ্ন, চেন্নাই টেস্টে সাকিবকে হাসতে দেখেছেন কতবার? একবারও কি?

মাথাটা যেন লেগের দিকে বেশি না সরে সে জন্য।
ব্যাটিংয়ের সময় সাকিবের হেলমেটের ফিতা কামড়ানো নিয়ে ধারাভাষ্যকক্ষে তামিম ইকবাল

ভ্রুকুটি ওঠার আগেই খোলাসা করা যাক। চেন্নাই টেস্টে বাংলাদেশ দলের বাকিদের শরীরী ভাষার সঙ্গে সাকিবের শরীরী ভাষার কোনো পার্থক্য দেখেন? বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপের ‘একাকী’ বাসিন্দা মনে হচ্ছে না তাঁকে? মুখে সেই সহজাত হাসিটা নেই। ক্যামেরা ধরলে নিচু মাথাটাই বেশি দেখাচ্ছে। দেখে মনে হয়, আপন ভুবনে কী যেন ভাবছেন! সেই ভাবনা কি বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে পথের শেষটা অন্তর্দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা?

ইকোনমি রেট বলছে ভারতের ইনিংসে বাংলাদেশের বোলারদের মধ্যে সাকিবই মার খেয়েছেন সবচেয়ে বেশি। প্রথম ইনিংসে ৮ ওভারে ৫০ রানে উইকেট পাননি। মেডেনও নেই। তা–ও টেস্টে! ইকোনমি ৬.২৫। দ্বিতীয় ইনিংসেও উইকেটশূন্য ১৩ ওভারে ৭৯ রান দিয়ে। ইকোনমি ৬.০৭।

সাকিবই ভালো বলতে পারবেন। কারণ, পরিসংখ্যান দিয়ে তাঁর মতো ক্রিকেটারের ভালো পারফরম্যান্স ও খারাপ পারফরম্যান্স বের করা যায় ঠিকই কিন্তু সামর্থ্য কি বোঝা সম্ভব? কিংবা তাঁর সামর্থ্যের শেষটা কোথায়, সেটাও কি বোঝা সম্ভব? এসব ব্যাপার মাথায় রেখেই কিছু বিষয় মনে করিয়ে দেওয়া যায়। চেন্নাইয়ে ভারতের প্রথম ইনিংসে সাকিব বোলিংয়ে এসেছেন ৫৩তম ওভারে। দ্বিতীয় ইনিংসে ১০ম ওভারে বোলিংয়ে এলেও সেই সাকিবকে দেখা যায়নি। দেখে মনে হয়েছে, স্রেফ বোলিং করতে হবে, তা–ই করছেন। ছিল না প্রতিটি ডেলিভারির পেছনে সেই ক্ষুরধার মস্তিষ্ক ও ম্যাচ রিড করার বয়ান। আজ তৃতীয় দিনেও তা–ই।

আরও পরিষ্কার করে বললে, আজ একটু বেশিই খাটো লেংথে বল করেছেন এবং সেটি ঠিক করতে আবার সামনেও ঝুলিয়ে (ফ্লাইট) দিয়ে বোলিং করেছেন। ইকোনমি রেটও বলছে ভারতের ইনিংসে বাংলাদেশের বোলারদের মধ্যে সাকিবই মার খেয়েছেন সবচেয়ে বেশি। প্রথম ইনিংসে ৮ ওভারে ৫০ রানে উইকেট পাননি। মেডেনও নেই। তা–ও টেস্টে! ইকোনমি ৬.২৫। দ্বিতীয় ইনিংসেও উইকেটশূন্য ১৩ ওভারে ৭৯ রান দিয়ে। ইকোনমি ৬.০৭। এতক্ষণে সাকিবের স্পিন ফিঙ্গারে সমস্যার কথা যাঁরা জেনে গেছেন, এসব পরিসংখ্যান দেখে নিশ্চয়ই তাঁদের মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেছে। আসলে এসব পরিসংখ্যান দেওয়া কিছু বিষয় সামনে তুলে আনতে।

ছবিটি চেন্নাই টেস্টের। সাকিবের বাঁ হাতে স্পিন ফিঙ্গারে সমস্যা বলেই কি বলটি ডান হাতে ধরলেন

ঠিকমতো বোলিং করতে পারেননি আঙুলের সমস্যায় সেটি অবশ্যই সত্য। তবে এমন সব চোট নিয়েও আগে এতটা নাজুক সাকিবকে কখনো দেখা যায়নি। কোনো না কোনো পথ ঠিকই বের করে ফেলেছেন। এখন পারছেন না কি বয়সের ভারের কারণে? এই ভার যে মানুষের ধার কমিয়ে দেয়, সেটি তো সবারই জানা। মানুষ এই খামতি কমাতে বিকল্প পথে হাঁটে। সাকিবের যেমন চোখের সমস্যা এবং সেটির কারণে ব্যাটিংয়ের সময় মাথার অবস্থান ঠিক রাখতে হেলমেটের ফিতা কামড়ে ধরেন। ধারাভাষ্য কক্ষে তামিমই বলেছেন এ নিয়ে, ‘মাথাটা যেন লেগের দিকে বেশি না সরে সে জন্য।’ এসব শুনে চোখের সামনে কি একটি ছবি ভেসে ওঠে?

একবার ভাবুন তো, যে সাকিব এক সময় সেই ‘সিংহে’র মতো ছিলেন দলের সেরা শিকারি, সেই তাঁকেই এখন বোলিং ক্রিজে কম দেখা যায়, ঠিক যেভাবে তরুণ সিংহ–সিংহীরা শিকারে যাওয়ার সময় ‘বুড়ো’দের ফেলে যায়!

টগবগে কোনো তরুণ ৩৫ পেরিয়ে যখন বয়সের ভারটা টের পান, শরীরও কিছু কিছু বিষয়ে বিদ্রোহ করে বসে, শারীরিক কোনো আঘাতই যখন আগের মতো আর দ্রুত সারে না, তখন জোড়াতালি মেরে নিজের, পরিবারের কিংবা সমাজের প্রত্যাশা মেটাতে হয়। সাকিবও কি এখন সেই ঘানি টানছেন, বাংলাদেশের জন্য?

প্রশ্নটি তোলাই আসলে দুঃসাহসের ব্যাপার। কারণ, লোকটির নাম সাকিব আল হাসান। তাঁর ১৮ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পের অভাব নেই। সেই গল্প এখনই শেষ না হোক, সেটা সবারই প্রত্যাশা। কিন্তু বাস্তবতাও চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে, অস্তরাগ উঁকি দিচ্ছে।

রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্টে থেকে চেন্নাই পর্যন্ত প্রতিপক্ষের চার ইনিংস মিলিয়ে সাকিবের শিকার মাত্র ১ উইকেট। এই চার ইনিংসে সাকিব বোলিং করেছেন মোট ৬২ ওভার। একবার ভাবুন তো, যে সাকিব এক সময় সেই ‘সিংহে’র মতো ছিলেন দলের সেরা শিকারি, সেই তাঁকেই এখন বোলিং ক্রিজে কম দেখা যায়, ঠিক যেভাবে তরুণ সিংহ–সিংহীরা শিকারে যাওয়ার সময় ‘বুড়ো’দের ফেলে যায়!

ব্যাটসম্যান সাকিবকেও ছন্দে দেখা যাচ্ছে না সাম্প্রতিক সময়ে

সাকিবের বোলিং ক্যারিয়ারে এত বাজে সময় কি আর এসেছে—যখন উইকেট প্রায় না পাওয়ার পাশাপাশি দলের জন্য দীর্ঘ সময় বোলিংও করতে পারছেন না! আর ব্যাটিং? পরিসংখ্যানের কচকচানি বাদ দিন। ক্রিজে সাকিবকে ব্যাট হাতে শেষ কবে স্বচ্ছন্দ মনে হয়েছিল, সেটা এখন মনে করতে হয়। পছন্দের স্কয়ার কাটও এখন ইচ্ছেমতো খেলতে পারেন না, বানিয়ে নিয়ে খেলার প্রশ্ন তুলে রাখুন। রান বের করতে না পারলে থার্ডম্যান, গালি ব্যবহার করে ঠেলে ১ রান নেওয়া কিংবা স্পিনে আটকে গেলে বলটা সামনে–পেছনে কোথাও ফেলে দৌড় দেওয়া—এসব কি সাকিবের কাছ থেকে দেখা গেছে রাওয়ালপিন্ডি থেকে চেন্নাইয়ে? বরং চেন্নাইয়ে চাপে পড়ে রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে আউট হওয়াই সাকিবকে নিয়ে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সতেজ স্মৃতি।

সেই অস্তরাগের আগে ‘সূর্য’টা গাঢ় লাল আভা ছড়াবে কবে এখন তারই অপেক্ষা। কারণ, ডুবে যাওয়ার আগে সবুজ মাঠের দিগন্তে সূর্যের লাল আভা আমরা সবাই দেখেছি। সামনেও নিশ্চয়ই দেখা যাবে!