তাসকিন আহমেদ একটার পর একটা আগুনের গোলা ছুড়ছেন। স্পিড মিটারে দেখাচ্ছে ঘণ্টায় ১৪৪ কিলোমিটার, একটা ১৪৬-ও দেখাল। ১৪০, ১৪১, ১৪২ গতিতেই করছিলেন বলগুলো।
কিন্তু সব বলই হার্দিক পান্ডিয়া খেলছিলেন মিডিয়াম পেসের মতো। পয়েন্টে একবার ব্যাট আলতো করে ছুঁইয়ে মারলেন চার। আবার একটা খেললেন আপার কাট। বলটা কোনদিকে গেল তা একবার পেছনে ফিরে তাকিয়েও দেখলেন না।
চুইংগাম চিবোতে চিবোতে তাকিয়ে রইলেন দুই হাতে মুখ লুকিয়ে ফেলা তাসকিনের দিকে। গোয়ালিয়রের শ্রীমন্ত মাধবরাও সিন্ধিয়া ক্রিকেট স্টেডিয়ামে কিছুক্ষণের জন্য বিস্ময়ের ঢেউ খেলে গেল। কী উদ্ধত, কী দাপুটে!
গতকাল রাতে পান্ডিয়ার ওই শটটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের রিল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। সবাই বলছেন, কী আক্রমণাত্মক ব্যাটিং! পান্ডিয়ার ওই শটটির খুনে মেজাজটাই সবার চোখে পড়ছে বেশি। ওই শটের পেছনে ক্ষুরধার ক্রিকেট–মস্তিষ্কটা কজনের চোখে পড়েছে?
তাসকিনের ইনিংসের ১২তম ওভারের প্রথম দুটি বল ছিল ইয়র্কার, প্রথমটি পান্ডিয়া কোনো রকমে ব্যাট ছুঁইয়ে নন স্ট্রাইকে গিয়েছিলেন। পরের ইয়র্কার থেকে নীতিশ রেড্ডি এক রান নিলে আবারও স্ট্রাইকে আসেন পান্ডিয়া। টানা দুটি গতিময় ইয়র্কারের পর তাসকিন যে আবারও একই লেংথে বল করবেন না, তা আগে থেকেই অনুমান করেছিলেন পান্ডিয়া। ওই মুহূর্তে পান্ডিয়া ভাবছিলেন একজন পেসারের মতো করে। শরীরের সবটা ভর পেছনে রেখে তিনি বাউন্সার কিংবা লেংথ বলের অপেক্ষায় ছিলেন। সেখান থেকে তিনি শুধু ব্যাটটা ছুঁইয়েছেন।
ওই একটা বলে পান্ডিয়া দেখিয়েছেন ‘স্মার্ট ক্রিকেট’ কী জিনিস। তার আগে ছোট ইনিংসে ক্রিকেটের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন সূর্যকুমার যাদব। তাসকিনরা জোরে বল করে গেছেন, তিনি গতি ব্যবহার করে তিনবার বল উড়িয়েছেন ছক্কার জন্য, চার মেরেছেন দুটি। সেগুলোতেও ছিল বোলারের গতি ব্যবহারের চেষ্টা। মার খাওয়ার পরও বাংলাদেশের বোলারদের পরিকল্পনা বদলায়নি। তাসকিন-মোস্তাফিজরা জোরে বল করে গেছেন, সূর্যকুমারও তাঁর ট্রেডমার্ক শট খেলে গেছেন।
একটা পর্যায়ে তো সূর্যকে ফাইন লেগ ছাড়াই বল করছিলেন তাসকিন! পরে মোস্তাফিজ অবশ্য ফাইন লেগ রেখে বল করেছেন, ঠিক ওই জায়গায়ই ফ্লিক করতে গিয়ে আউটও হয়েছেন সূর্যকুমার। ততক্ষণে অবশ্য ১৪ বলে ২৯ রান হয়ে গেছে ভারত অধিনায়কের। সঞ্জু স্যামসনও ২৯ রান করেছেন। তাঁকেও আউট করার আগ পর্যন্ত মিড উইকেটে ফিল্ডার ছাড়াই বল করে গেছে বাংলাদেশ।
অথচ ওই জায়গাটাই সবচেয়ে বেশি দুর্বলতা ভারতের এই উইকেটকিপার–ব্যাটসম্যানের। আর ২০১৫ সালের সেই স্মরণীয় সিরিজের পর থেকে ভারতের ব্যাটসম্যানরা মোস্তাফিজকে খেলেন বাঁহাতি স্পিনারের মতো করে। এতে তাঁরা সফলও। ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে ২০১৬ থেকে এখন পর্যন্ত ভারতের বিপক্ষে ২০ ম্যাচে মোস্তাফিজের শিকার মাত্র ১৭ উইকেট।
তবে গতকালের ম্যাচে বোলারদেরই এমন কী করার ছিল? স্কোরবোর্ডে তো রান মাত্র ১২৭। ভারতের বিপক্ষে এ রান যে যথেষ্ট নয়, তা ১১.৫ ওভারে ৭ উইকেটের জয়েই বুঝিয়ে দিয়েছেন সূর্য-পান্ডিয়ারা।
কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরাও তো ভারতের মতো ‘স্মার্ট ব্যাটিং’ করতে পারতেন! তাঁদের মধ্যেও আক্রমণাত্মক মানসিকতা দেখা গেছে। উইকেট হারালেও মেরে খেলার চেষ্টা ছিল সবার মধ্যে। বিশাল হারের এ ম্যাচে যদি কোনো ইতিবাচকতা থেকে থাকে, তাহলে সেটা ওই মেরে খেলার চেষ্টা। কিন্তু আক্রমণটাও তো কৌশলী হতে হবে। কাল ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে এসে অধিনায়ক নাজমুল হোসেনও এ কথাটা বলেছেন।
নাজমুল যেটা সংবাদ সম্মেলনে বললেন, সেই কথোপকথনটা কি লিটনের সঙ্গে হয়েছে নাজমুলের? আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রায় ৯ বছর কাটিয়ে দেওয়া লিটন কাল অর্শদীপের সুইংহীন অ্যাঙ্গেলে বেরিয়ে যাওয়া একটা বল লেগের দিকে টানতে গেলেন।
অথচ তিনি আগের বলেই অফের দিকে খেলে বাউন্ডারি খুঁজে নেন। তখন থার্ড ম্যান ছিল ৩০ গজে। লিটনের ওই শটটার পর থার্ড ম্যান পেছনে নিয়ে স্কয়ার লেগ ওপরে আনেন সূর্যকুমার। আর লিটন ওই লেগের ফাঁকা জায়গায় বল টানতে গিয়ে ক্যাচ তুললেন কাভারে। ভাবনা ঠিক থাকলেও প্রয়োগটা ঠিকঠাক হয়নি, তা লিটনও নিশ্চয়ই মানবেন।
তাওহিদ হৃদয় টানা ৭টি ডট বল খেলে অষ্টম বলে আর চাপ না নিতে পেরে উড়িয়ে মারতে গিয়ে ক্যাচ আউট হয়েছেন। দুজনই বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ের ভরসার নাম। কাল দুজনই হতাশ করেছেন। দুই দলের ব্যাটিং পার্থক্যটাও আরও একবার চাক্ষুষ হলো।
ভারতের খেলোয়াড়রা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছিলেন আইপিএলের মতো করে। আর বাংলাদেশ? বিপিএল নিশ্চয়ই আইপিএলের কাতারে নয়। কিন্তু আইপিএলের মাত্র চার বছর পর শুরু হওয়া এই টুর্নামেন্টটি কি এতটাও পিছিয়ে থাকার কথা ছিল?
প্রশ্নগুলো কাল করা হয়েছিল বাংলাদেশ দলের অধিনায়ককে। ক্রীড়া বিষয়ক টেলিভিশন চ্যানেল টি স্পোর্টসকে দেওয়া উত্তরে তিনি বাস্তবতাটাই মেনে নিলেন, ‘আইপিএল-বিপিএলের অনেক পার্থক্য আছে। এটা সত্য কথা। অস্বীকার করার কিছু নেই। এটা মাঠে দেখা যায়, মাঠের বাইরেও। আইপিএলের সঙ্গে বিপিএলের তুলনা কখনোই হবে না।’
তাহলে করণীয় কী? নাজমুল বললেন, ‘মাঠে ও মাঠের বাইরে আমরা কীভাবে আরও ভালো করতে পারি, এই জিনিসগুলো নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। বিপিএল কীভাবে আরও ভালো হবে, কীভাবে সেখান থেকে আরও নতুন খেলোয়াড় উঠে আসে সেগুলো খেয়াল রাখতে হবে। আমরা নিজেরা কীভাবে নিজেদের স্কিল আরও উন্নত করতে পারি, এই জিনিসগুলো নিয়ে কাজ করার বাকি আছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, আমরা এর থেকে ভালো দল।’
এই বিশ্বাসটা নিয়েই আজ দিল্লি যাবে বাংলাদেশ দল। সেখানে ৯ অক্টোবর সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচ খেলবেন নাজমুলরা। ৫ বছর আগের ভারত সফরে এই দিল্লিতেই ভারতকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। সেই সুখস্মৃতি নিশ্চয়ই বাংলাদেশ দলের সঙ্গে থাকবে। কিন্তু এই ভারতকে হারাতে হলে প্রথম ম্যাচের চেয়ে বাংলাদেশকে মাথার খেলায় কতটা ভালো করতে হবে, সেটা ভুলে গেলে চলবে না!