বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়কের মুখ দেখে শুরু দীর্ঘ এক দিন

কী কী অপছন্দ করি—এমন কোনো তালিকা করতে বললে ‘আর্লি মর্নিং ফ্লাইট’ অবশ্যই এর মধ্যে থাকবে। সকালের ফ্লাইট মানেই রাতের ঘুমের বারোটা বাজা। কিন্তু জীবন তো এমনই, না চাইলেও অপছন্দের অনেক কিছুই করতে হয়। গন্তব্য চেন্নাই, যেখানে সরাসরি যাওয়ার কোনো উপায় নেই। ধর্মশালা থেকে প্রথম ফ্লাইট ধরলেও দিল্লি হয়ে চেন্নাই পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে যায়। এত বড় এক দেশ ভারত। সেটির উত্তর মাথা থেকে দক্ষিণ মাথা কি সোজা কথা নাকি! দিল্লি থেকে চেন্নাই-ই তো প্রায় তিন ঘণ্টার মামলা।

প্রায়ান্ধকার ভোর-ভোর সময়ে হোটেল থেকে বেরোনোর সময় চোখ জ্বালা করছে, মাথা ঝিমঝিম। মাত্র দেড়-দুই ঘণ্টা ঘুমের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তো এমনই হওয়ার কথা। ধর্মশালার কাংরা বিমানবন্দরে ঢোকার সময় চোখেমুখে ফুটে ওঠা বিরক্তিটা নিজেই যেন দেখতে পাচ্ছি। ঢোকার পরই অবশ্য তা অনেকটাই উধাও। কেন হবে না বলুন, বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ককে দেখে দিন শুরু করার ভাগ্য কি প্রতিদিন হয়!

তথ্যনিষ্ঠ থাকতে হলে অবশ্যই স্বীকার করা উচিত যে এউইন মরগানের আগে আরও অনেককে দেখেছি। হোটেলের রিসেপশনের লোকজন, ট্যাক্সি ড্রাইভার, নিরাপত্তাকর্মী...। এঁদের সবাইকে উপেক্ষা করে আমি ভাবতে চাইলাম, সকালে উঠেই আমি এউইন মরগানকে দেখেছি। ধারাভাষ্যও দিচ্ছেন, তবে এই বিশ্বকাপে তাঁর আসল পরিচয় আইসিসির বিশেষ দূত। পরনে গোল গলার একটা গেঞ্জি আর শর্টস। পায়ে স্লিপার। সেই স্লিপার জোড়া নির্ঘাত দুই সাইজ বড়। এয়ারলাইনসের লোকজন, অন্য যাত্রীরা মরগানের সঙ্গে একের পর এক ছবি তুলে যাচ্ছেন। আমি পাশে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘আপনার স্লিপার তো সাইজে একটু ছোট মনে হচ্ছে।’ রসিকতাটা বুঝে মরগান বেশ শব্দ করেই হাসলেন।

ধর্মশালার কাংরা বিমানবন্দরে তোলা ছবি

বিমানবন্দরে প্রায় সব যাত্রীই ক্রিকেট-পর্যটক। আগের দিন বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড ম্যাচ দেখে কেউ দিল্লি যাচ্ছেন, কেউবা দিল্লি হয়ে অন্য কোনো দিকে। শুধুই দর্শক অবশ্য কমই পেলাম। খেলার সঙ্গে যাঁদের পেশা জড়িয়ে, তাঁদের সংখ্যাই বেশি। সাংবাদিক, টেলিভিশন ক্রু, আইসিসির কর্মকর্তা...। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক শেখ সোহেল একটা বার্গারে ব্রেকফাস্ট সারছেন। বার্গারে একটা কামড় দিয়ে বললেন, ‘পাপন ভাই পুনেতে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের আগেই এসে যাবেন।’

চেয়ারে বসে কি বোর্ডে ঝড় তুলেছেন জনাথন অ্যাগনিউ। ল্যাপটপ নামকরণের সার্থকতা প্রমাণ করে, সেটিকে কোলে নিয়ে নিজের কলাম লেখায় ব্যস্ত বিবিসির ধারাভাষ্যকার ও কলামিস্ট। সাংবাদিক পরিচয়েই এখন সবাই চেনে। তবে অন্য একটা পরিচয়ও আছে তাঁর।

জনাথন অ্যাগনিউ

টেস্ট ক্রিকেটার। ১৯৮৪-৮৫ সালে ইংল্যান্ডের হয়ে ৩টি টেস্ট খেলেছেন। ৩টি ওয়ানডেও। ঘণ্টা দুয়েক পরেই যাঁর সঙ্গে শাটল বাসে পাশাপাশি বসে আমি দিল্লির ১ নম্বর টার্মিনাল থেকে ২ নম্বর টার্মিনালে যাব। সেই দূরত্ব এত বেশি যে তাঁর সঙ্গে দারুণ একটা আড্ডা জমে যাবে। বাংলাদেশ নিয়ে অনেক কথা হবে। কথা হবে শুরু না হতেই শেষ হয়ে যাওয়া তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ার নিয়ে। এই বিশ্বকাপ নিয়ে তো অবশ্যই। বার্মিংহাম আর লেস্টারের মাঝামাঝি ইংল্যান্ডের যে ছোট্ট শহরটায় থাকেন, সেখানে অনেক সিলেটির সঙ্গে তাঁর খাতির বলে একবার সিলেটে যাওয়ার খুব ইচ্ছা বলে জানাবেন। আমি তাঁকে বলব, এরপর বাংলাদেশে এসেই আমাকে ফোন দিতে। আমিই তাঁকে সিলেট নিয়ে যাব।

পরের কথা আগে হয়ে যাচ্ছে। স্পাইসজেটের বিমানে উঠেই চমকের কথাটা আগে বলে নেওয়া উচিত। আমাকে বরণ করতে কিনা দাঁড়িয়ে আছেন হার্দিক পান্ডিয়া! আজই না দিল্লিতে আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের ম্যাচ। হার্দিক পান্ডিয়া তাহলে ধর্মশালায় কী করছেন! নিজের আসনের দিকে এগোতেই দেখলাম, বিমানে হার্দিক পান্ডিয়া আসলে একজন নন, দুজন। তরুণী দুই কেবিন ক্রু পেছনে ইংরেজিতে হার্দিক ও ৩৩ লেখা ইউনিফর্ম পরে আছেন। ঘটনা কী? হার্দিক পান্ডিয়া কি স্পাইসজেট কিনে ফেলেছেন নাকি! আইপিএল খেলে যে টাকা পান, তাতে অসম্ভব কিছু নয়। প্রেরণা নামের কেবিন ক্রুকে জিজ্ঞেস করে অবশ্য জানলাম, ঘটনা আসলে তা নয়। হার্দিক পান্ডিয়া স্পাইসজেটের কী যেন একটা অন্য ব্যবসার পণ্যদূত। স্পাইসজেটের সব কেবিন ক্রুরা তা মনে করিয়ে দিতে এই বিশ্বকাপে ভারতের ম্যাচের দিন হার্দিক লেখা এই ইউনিফর্মটা পরছেন।

স্পাইসজেট বাজেট এয়ারলাইনস। বহরে বেশির ভাগই ড্যাশ-এইট উড়োজাহাজ। পাশের যাত্রীর সঙ্গে গা না লাগিয়ে যেটিতে বসাই মুশকিল। পানি ছাড়া আর কোনো কিছুই ফ্রি নয়। সকালে কিছু খাওয়া হয়নি। আমি তাই সাড়ে তিন শ রুপি দিয়ে বিস্বাদ একটা ঠান্ডা স্যান্ডউইচ খেতে বাধ্য হলাম। পাশের যাত্রীকে কনুইয়ের গুঁতো না দেওয়ার ব্যাপারে সচেতন থাকায় তা খেতে ভালোই সমস্যা হলো।

ধর্মশালা থেকে দিল্লি আসতেই এত গল্প! দিল্লি থেকে চেন্নাই তো আরও ইন্টারেস্টিং। চেন্নাইয়ে নামার পর যা হলো, তা-ও। এসব না হয় পরে কোনো এক সময় বলি, কী বলেন?