বাংলাদেশের ক্রিকেটে আলোচনার স্রোত কখনো একমুখী হয় না। মাঠে বাংলাদেশ দল ভালো কিংবা খারাপ যে রকমই খেলুক, এর বাইরে আলোচনায় থাকে আরও অনেক কিছুই। তাতে খেলাটাই অনেক সময় হয়ে যায় গৌণ।
এই যেমন এখন। পাকিস্তানের মাটিতে পাকিস্তানকে টেস্ট সিরিজে ২-০-তে ধবলধোলাই করে গতকাল রাতে দেশে ফিরেছে বাংলাদেশ দল। অথচ বিজয়ীদের বরণ করে নেওয়ার উদ্যাপনের সমান্তরালেই চলছে অন্য দুটি আলোচনাও। আলোচনা না বলে অবশ্য বিতর্ক বলাই ভালো। ‘হত্যা মামলা’য় আসামি হওয়া সাকিব আল হাসানের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়ে কি ঠিক কাজ করলেন অধিনায়ক নাজমুল হোসেন? চন্ডিকা হাথুরুসিংহেই কি কোচ থাকছেন বাংলাদেশ দলের?
হাথুরুসিংহেকে নিয়ে আলোচনাটা তো আগে থেকেই। বোর্ড সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পরই ফারুক আহমেদ বলেছেন, ব্যক্তিগতভাবে তিনি শ্রীলঙ্কান এই কোচের ব্যাপারে আগের অবস্থানেই আছেন। তার মানে হাথুরুসিংহের ব্যালটে ফারুকের ‘না’ ভোট।
খেলোয়াড়দের চাওয়া ভারত সফরে হাথুরুসিংহে কোচ থাকলে তাঁকে যেন চ্যাম্পিয়নস ট্রফি পর্যন্ত রাখা হয়। কারণ, ক্রিকেটাররা মনে করেন, নতুন কেউ এসে অত অল্প সময়ের মধ্যে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির মতো বড় টুর্নামেন্টের জন্য গুছিয়ে উঠতে পারবেন না।
কিন্তু পাকিস্তান সিরিজের অভাবিত সাফল্যের পর, যে সাফল্যের প্রেক্ষাপটে ছিল হাথুরুসিংহেরই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, এখন কি আর উপায় আছে তাঁকে চুক্তি শেষের আগেই বিদায় দেওয়ার! তবে সে সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়েও দেওয়া যাচ্ছে না। পূর্বনির্ধারিত সূচি অনুযায়ী আজ রাত সাড়ে ১১টার ফ্লাইটে ছুটি কাটাতে অস্ট্রেলিয়ায় যাচ্ছেন হাথুরুসিংহে। ঢাকায় ফেরার কথা ১২ সেপ্টেম্বর। এর আগে তাঁর সাজানো পরিকল্পনাতেই হবে দুই টেস্ট ও তিন টি-টোয়েন্টির প্রস্তুতি। বাংলাদেশ দল ভারতে যাবে ১৫ সেপ্টেম্বর। হাথুরুসিংহে আত্মবিশ্বাসী, তিনি ফিরবেন এবং দল নিয়ে ভারতে যাবেন।
পাকিস্তান থেকে ফেরা দলে খোঁজ নিয়ে যতটুকু জানা গেছে, এই সিরিজে হাথুরুসিংহের সার্বিক ভূমিকায় খুবই সন্তুষ্ট খেলোয়াড়েরাও। সিরিজ জয়ে সেটির ইতিবাচক ভূমিকাও দেখেন তাঁরা। অধিনায়ক নাজমুল হোসেন তো গতকাল রাতে বিমানবন্দরেই বলেছেন, ‘এটা বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে সেরা অর্জনগুলোর একটি। এটা শুধু আমার একার কথা নয়, দলের সবাই তা বিশ্বাস করে।’ তাঁর কথায় এসেছে সিরিজ-পূর্ব প্রস্তুতির প্রসঙ্গও, ‘আমরা যেভাবে প্রস্তুতি নিয়েছি, সফরে যাওয়ার আগে এবং সেখানে যাওয়ার পর...দলের প্রত্যেকের মানসিকতা, দক্ষতা ও সামর্থ্য নিয়ে চিন্তাভাবনা—সব মিলিয়ে খুব ভালো প্রস্তুতি ছিল। প্রত্যেকের মধ্যে ইচ্ছা ছিল যেন আমরা জিততে পারি।’
তো এমন বিশেষ এক সিরিজের পর কোচের ভবিষ্যৎ নিয়ে দল কী ভাবছে? এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার একান্তই বিসিবির বলে নিজেদের ভাবনাটা প্রকাশ্যে জানাতে চাননি খেলোয়াড়েরা। তবে যে বার্তাটা তাঁরা বোর্ডকে দিতে চেয়েছেন, তার সারমর্ম করলে দাঁড়াচ্ছে—ভারত সফরে হাথুরুসিংহে কোচ থাকলে তাঁকে যেন চ্যাম্পিয়নস ট্রফি পর্যন্ত রাখা হয়। কারণ, ক্রিকেটাররা মনে করেন, নতুন কেউ এসে অত অল্প সময়ের মধ্যে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির মতো বড় টুর্নামেন্টের জন্য গুছিয়ে উঠতে পারবেন না।
তার মানে খেলোয়াড়দের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে চাইলে বিসিবির সামনে খোলা থাকছে দুটি পথ। এক. চ্যাম্পিয়নস ট্রফি পর্যন্ত হাথুরুসিংহেকে রেখে দেওয়া। দুই. ভারত সফরের আগেই তাঁকে ‘ধন্যবাদ’ দিয়ে ‘বিদায়’ বলে দেওয়া। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষতির যে শঙ্কার কথা বলা হচ্ছিল, বাস্তবে সেটি নেই বলে জানিয়েছে বিসিবির একটি সূত্র। চুক্তি অনুযায়ী হাথুরুসিংহের যত দিন ছুটি প্রাপ্য ছিল, তিনি নাকি এরই মধ্যে তার চেয়ে তিন মাসের বেশি কাটিয়ে ফেলেছেন। কাজেই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে বিদায় দিলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে তিন মাসের বেতন দেওয়ার যে শর্ত চুক্তিতে আছে, সেটি আর প্রযোজ্য হবে না।
সব মিলিয়ে তাই প্রশ্নটা উঠছেই। ১২ সেপ্টেম্বর কি ফিরছেন হাথুরুসিংহে, নাকি তার আগেই পেয়ে যাবেন কোনো ই-মেইল! এখন পর্যন্ত কিন্তু দুটি পথই বিবেচনায় রাখছে বিসিবি। এখানে বিশেষ দ্রষ্টব্যের মতো বলে রাখা ভালো, অসাধারণ সাফল্য নিয়ে পাকিস্তান থেকে ঢাকায় ফিরে ২৪ ঘণ্টার মতো কাটিয়ে গেলেও হাথুরুসিংহের সঙ্গে সাক্ষাত হয়নি বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদের।
অন্য আলোচনাটি গতকাল বিমানবন্দরে সাকিবের পাশে থাকা নিয়ে নাজমুলের এক মন্তব্য ঘিরে, যেটি মূলত এসেছে একটি প্রশ্নের সূত্র ধরে। সাংবাদিকেরা তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, এ রকম সময়ে সাকিব আল হাসানের পাশে তাঁরা আছেন কি না। তো এমন প্রশ্নের উত্তরে একজন অধিনায়ক কী বলতে পারেন? নাজমুল যা বলেছেন, তা-ই তো! তিনি যদি বলতেন, ‘না, আমরা সাকিব ভাইয়ের পাশে নেই। তাঁর সমস্যা তিনিই বুঝুন’, সেটা কি ভালো শোনাত?
সেটি না বলে নাজমুল যা বলেছেন, তা নিয়ে তাই বিতর্ক চলতে পারে শুধুই বিতর্কের খাতিরে। প্রশ্নের উত্তরে নাজমুল বলেছেন, ‘সাকিব ভাইয়ের ব্যাপারটি ভিন্ন। তবে প্রত্যেক খেলোয়াড় সাকিব ভাইয়ের পাশে আছে। সবাই জানি, সাকিব ভাই খেলার জন্য কতটা নিবেদিত এবং খেলার জন্য কতটা পাগল। সব সময় দলের জন্য চিন্তাভাবনা করে থাকেন। যখন দেখা হবে (প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে), এটা নিয়ে যদি কথা ওঠে, তাহলে বলব, প্রত্যেক খেলোয়াড় সাকিব ভাইয়ের পাশে আছে।’
নাজমুলের এ কথা শুনে এ রকম মনে হওয়ার কোনো কারণ নেই যে তিনি আজ-কালের মধ্যেই যমুনায় গিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বসে সাকিবকে সব ঝামেলা থেকে উদ্ধার করার চেষ্টা করবেন। তিনি বলেছেন, সুযোগ হলে বলবেন এবং সেটি একটি প্রশ্নের প্রসঙ্গে, যে প্রশ্নে একজন অধিনায়কের তাঁর দলের একজন খেলোয়াড় প্রসঙ্গে এমন শোভন উত্তরই দেওয়ার কথা।
তা ছাড়া এটা নাজমুলও ভালো করেই জানেন যে একটি রাজনৈতিক মামলা কারও আবেগতাড়িত মন্তব্য বা অনুরোধে উঠে যাবে না। তবু এটি নিয়েই ফেসবুক সরগরম হয়ে উঠল। সাকিবের পাশে দাঁড়িয়ে নাজমুলও যেন ‘আসামি’ হয়ে গেলেন!