সময় বদলেছে। বদলেছে ক্রিকেটও। পরিবর্তন এসেছে খেলার ধরনে। এখন টেস্টেই জো রুটের মতো ব্যাটসম্যানের ‘গো টু শট’ হয়ে দাঁড়িয়েছে প্যাডল সুইপ, রিভার্স সুইপ। কিন্তু পরিবর্তনের এ হাওয়ায় পাকিস্তান দল বদলেছে কতটা? প্লেয়ার, কোচিং স্টাফ পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছে না, বলা হচ্ছে কৌশলের কথা? খুব একটা বোধ হয় না।
এখনো পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানরা দেখেশুনে ইনিংস বড় করে শেষের দিকে গিয়ে হাত খোলেন। প্রশ্নটা তাই অনেক দিনের এবং ওয়ানডে বিশ্বকাপের সময়ে প্রশ্নটা উঠছে আবারও। কেন এখনো সেই নব্বই দশকের ক্রিকেট খেলছে পাকিস্তান? মানে, ঝুঁকিমুক্তভাবে ইনিংস বড় করে শেষ দিকে দ্রুতগতিতে রান তোলার চেষ্টাটাই কেন করছেন পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানরা?
বলতে পারেন, পাকিস্তান দলটা এভাবে খেলেই তো ওয়ানডেতে আশ্চর্য রকম ধারাবাহিক! আইসিসি ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ে দ্বিতীয়। এমন একটা দলকে কেন হঠাৎ তাদের কৌশল বদলে ফেলার কথা বলতে হচ্ছে? কারণ সহজ, এবারের বিশ্বকাপটা হতে পারে রানবন্যার। কিছুদিন আগে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিসিসিআইয়ের প্রধান কিউরেটর আশিস ভৌমিক জানিয়েছিলেন, তাঁরা চান বিশ্বকাপের ১০ ভেন্যুতেই হোক রান উৎসব। দুই ইনিংসেই যেন ৩০০ রান হয়, সেই রেসিপিতেই বানানো হয়েছে বিশ্বকাপের উইকেট। আর দুটি প্রস্তুতি ম্যাচেও হয়তো পাকিস্তান সে আভাস পেয়েছে। প্রথম প্রস্তুতি ম্যাচে পাকিস্তান তো ৩৪৫ রান করেও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হেরেছে। পরেরটিতে অস্ট্রেলিয়ার করা ৩৫১ রান টপকাতে পারেনি পাকিস্তান।
কেন পাকিস্তান পুরোনো কৌশলেই ক্রিকেটটা খেলছে, সে প্রশ্নে ফেরা যাক। কারণটা লুকানো কি ক্রিকেটারদের সামর্থ্যে? এটা একটা বড় কারণ। বাবর আজম-মোহাম্মদ রিজওয়ানদের খেলার ধরনটাই এমন। নিয়মিত রান করলেও শুরুতে কিছুটা সময় নিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তাঁরা। পাকিস্তানের টপ অর্ডারে একমাত্র ফখর জামানই শুরু থেকে আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলতে পারেন। ওয়ানডেতে পাকিস্তানের ব্যাটিং অর্ডারের প্রথম চার ব্যাটসম্যানের মধ্যে একমাত্র ফখরের স্ট্রাইক রেট ৯০–এর বেশি (৯১.৯৬)। বাবরের স্ট্রাইক রেট ৮৯। রিজওয়ানের ৮৮।
স্ট্রাইক রেট খুব বেশি পার্থক্য মনে না হলেও তাঁদের মধ্যে ফখরই শুরু থেকে আক্রমণাত্মক খেলেন। তবে এই ফখরই আছেন চূড়ান্তে অফ ফর্মে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে গত এপ্রিলে ১৮০ রানের ইনিংস খেলার পরের ১০ ইনিংসে তাঁর সর্বোচ্চ ৩৩। তাই একাদশে আদৌ ফখর থাকবেন কি না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। শেষ ১০ ওভারে দ্রুত রান তোলার ক্ষমতা আছে ছয়ে-সাতে নামা সবারই। তবে তাঁরা কেউই শহীদ আফ্রিদি কিংবা আবদুল রাজ্জাকের মতো ভয়ানক নন।
অন্য টপ ফেবারিট দলগুলোর সঙ্গে পাকিস্তানের পার্থক্যটা ধরা পড়বে এ পরিসংখ্যানে। ফখরের স্ট্রাইক রেট প্রায় ৯২ বলেই যেখানে তাঁকে আগ্রাসী ক্রিকেটার বলা হচ্ছে, সেখানে ভারতের শুবমান গিলের স্ট্রাইক রেট ১০২.৮। ইংল্যান্ড ওপেনার বেয়ারস্টোর ১০৩.৯। এমনকি ইংল্যান্ড দলে যিনি অ্যাঙ্করিং করেন, সেই ডেভিড ম্যালানের স্ট্রাইক রেটও ৯৬। আর ভারতের অধিনায়ক রোহিত শর্মা তো ঘোষণা দিয়েই আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলছেন।
এ সমস্যার পরও পাকিস্তান কীভাবে ওয়ানডেতে শীর্ষ দলগুলোর একটি? কারণ, বোলারদের অবদান। বাবররা খুব বেশি বড় রান না তুলেও নিয়মিত জয় পেয়েছেন, এর বড় কারণ ছিল তাঁদের বোলাররা। শাহিন শাহ আফ্রিদি, নাসিম শাহ ও হারিস রউফরা শুরু থেকেই প্রতিপক্ষকে কাঁপন ধরিয়ে দিত। তখন ২৭০-২৮০ রানও প্রতিপক্ষের জন্য বড় লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াত। তবে বিশ্বকাপ থেকে নাসিম ছিটকে যাওয়ায় কিছুটা বিপাকেই পড়েছে পাকিস্তান। কারণ, নতুন বলে দুই দিকেই সুইং করাতে পারা এই বোলারই পাকিস্তানের মূল বোলার হয়ে উঠেছিল।
আর নতুন বলে যদি আফ্রিদি উইকেট নিতে পারেন, তাহলে চাপে পড়ে যায় বাবরের দল। নতুন বলে কী প্রতি ম্যাচেই উইকেট নেওয়া সম্ভব! পেসাররা না পারলে স্পিনাররা এসে উইকেট নেবেন, পাকিস্তানি স্পিনারদের কাছে সেই প্রত্যাশা করাটাও কঠিন। কারণ, শাদাব খান, মোহাম্মদ নেওয়াজ ও উসামা মীরদের নিয়ে গড়া স্পিন অ্যাটাক বিশ্বমানের নয়। আগের প্রজন্মের স্পিনার সাকলায়েন মোশতাক, সাঈদ আজমল ও শহীদ আফ্রিদির কাছে তাঁরা কিছুই নন। ৬৪ ওয়ানডেতে ৮৩ উইকেট নেওয়া শাদাব সর্বশেষ ৪ ম্যাচে নিয়েছেন মাত্র ২ উইকেট। নেওয়াজ, উসামারাও এ সংস্করণে ততটা অভিজ্ঞ কেউ নন।
পাকিস্তানের বিশ্বকাপ দলেই অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের অভাব। এ দলে একমাত্র বাবর আজমই শতাধিক ওয়ানডে খেলেছেন। তবে ১০ বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছেন, এমন কেউই নেই এ দলে।
দেয়ালে পিঠ ঠেকলে যেমন বাঘ হুংকার ছাড়ে, পাকিস্তানও নাকি তেমনই। সমর্থকেরা সম্ভবত সেই হুংকার শোনার অপেক্ষাতেই আছেন।