শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকা, নেদারল্যান্ডস ও নেপাল—এবারের টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে প্রথম পর্বে বাংলাদেশের গ্রুপসঙ্গী। ‘ডি’ গ্রুপে সেরা দুইয়ে থাকতে পারলেই মিলবে সুপার এইটের টিকিট। সেটি নিশ্চিত করতে হলে বাংলাদেশকে কী করতে হবে, চার প্রতিদ্বন্দ্বীর শক্তি–দুর্বলতা বিশ্লেষণ করে জানিয়েছেন ক্রিকেট–বিশ্লেষক ও কোচ নাজমূল আবেদীন।
বাংলাদেশ দলের গত দু-তিনটি বিশ্বকাপ খুব একটা ভালো যায়নি। সে তুলনায় এবার দলের গঠন, ভারসাম্য আর প্রস্তুতি—সব মিলিয়ে কিছু ইতিবাচক ব্যাপার রয়েছে। টপ অর্ডার নিয়ে কিছুটা শঙ্কা থাকলেও মাহমুদউল্লাহর ফিরে আসা, জাকের আলীর অন্তর্ভুক্তি, মোস্তাফিজুর রহমানের আত্মবিশ্বাসী বোলিং, সাকিব আল হাসানের উপস্থিতি—এ ছাড়া দলে টি-টোয়েন্টি উপযোগী বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় আছে।
প্রস্তুতির দিক দিয়ে ভাবলে, এর আগে দেখা গেছে—বিশ্বকাপের আগে দেশের মাটিতে বড় বড় দলকে ডেকে এনে কন্ডিশনের সুবিধা নিয়ে একধরনের মিথ্যা আত্মবিশ্বাস তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে। দিন শেষে কিন্তু তা কাজে লাগেনি। এবার সেটা করা হয়নি। জিম্বাবুয়ে আদর্শ প্রতিপক্ষ না হলেও সিরিজটি ‘ইভেন’ কন্ডিশনে খেলেছে বাংলাদেশ। সে কারণেও এবারের দলটি গত কয়েকবারের তুলনায় ভিন্ন একটা মানসিকতা নিয়ে গেছে।
দলটির হয়তো অনেক অর্জন নেই, সীমাবদ্ধতাও আছে। তবে সেসব জেনেই দলটা বিশ্বকাপে গেছে। সেটা দূর করার একটা প্রয়াস নিশ্চয়ই দেখতে পাব। অতি আত্মবিশ্বাসের চেয়ে এটি ভালো। আমার কাছে এটি ইতিবাচক দিক। এটা দলকে সতর্ক রাখবে।
দলটায় ভারসাম্য আছে। রিশাদ হোসেনের মধ্যে প্রথমবার একজন লেগ স্পিনারকে পেয়েছি। পেস বোলিং বিভাগটা সমৃদ্ধ। মোস্তাফিজ বেশ ভালো ছন্দে আছে। মিডল অর্ডার আগের তুলনায় বেশ শক্তিশালী। টপ অর্ডারের দুর্বলতা নিয়েই বাংলাদেশ বিশ্বকাপ এসেছে। তানজিদ হাসান ছাড়া বাকিরা ফর্মে ফেরার চেষ্টা করবে। যুক্তরাষ্ট্র সিরিজটা এ ক্ষেত্রে কতটা কাজে দিল, সেটিই দেখার বিষয়। টপ অর্ডারের দুর্বলতাটা কাটিয়ে উঠতে পারলে সব মিলিয়ে গড়পড়তার চেয়ে ভালো একটা দল বাংলাদেশ। গ্রুপের বাকি দলগুলোকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবে।
দেশের মাটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও সিরিজ শ্রীলঙ্কাই জিতেছিল। সেটি তাদের মানসিক দিক দিয়ে এগিয়ে রাখবে। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ বলে বাংলাদেশের ওপর বাড়তি একটা চাপও থাকবে। দলের পারফরম্যান্সের গ্রাফটা ঊর্ধ্বমুখী নয়। প্রথম ম্যাচটি তাই বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ ম্যাচের ফলটা ভালো না হলে শুরুতেই ছিটকে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। সেই চাপ নিয়েই খেলতে হবে।
যা করতে হবে
শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের শক্তির দিক দিয়ে তেমন একটা পার্থক্য নেই। বাংলাদেশের মিডল অর্ডারের সাম্প্রতিক উন্নতি বরং আশাজাগানিয়া। কিছু ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কার চেয়ে বাংলাদেশই এগিয়ে। তবে এ ম্যাচে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হবে ওই চাপ সামলানো। ম্যাচের ফলও নির্ভর করবে সেটির ওপরই। জিম্বাবুয়ে সিরিজে বাংলাদেশ দল সে অর্থে নিজেদের চাপের মুখে ফেলতে চায়নি। শেষ যে ম্যাচে চাপে পড়েছিল, সেটিতে হেরেছে। চাপের কারণে বাংলাদেশ দল নিজেই নিজেদের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াতে পারে। শ্রীলঙ্কার চেয়ে বড় প্রতিপক্ষ তাই ওই চাপ।
যাঁকে নিয়ে ভয়
ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গা
ব্যাটিংয়ে পাতুম নিশাঙ্কা বা বোলার মাতিশা পাতিরানা তো আছেনই। তবে বড় একটা হুমকি হবেন শ্রীলঙ্কার অধিনায়কই। বিপজ্জনক খেলোয়াড়, অভিজ্ঞতা আছে, ম্যাচজয়ী অনেক পারফরম্যান্স আছে। চাপের মুখে খেলার সামর্থ্য আছে। বাংলাদেশ খেলোয়াড়দের ভালোভাবে জানেন, বোলার হিসেবে ব্যাটসম্যানদের দুর্বলতাগুলো কাজে লাগাতে চাইবেন। বাংলাদেশের সঙ্গে নিষেধাজ্ঞার কারণে টি-টোয়েন্টি সিরিজের সব কটি ম্যাচ না খেললেও ওয়ানডেতে সফল ছিল। আরেকটা হুমকি আছে। পাতিরানার মতো বোলার এক প্রান্তে চাপ তৈরি করতে থাকলে দেখা যাচ্ছে ব্যাটসম্যানরা হাসারাঙ্গাকেই আক্রমণ করতে গিয়ে উইকেট দিয়ে আসছে। ব্যাটিংয়েও তাঁর যে সামর্থ্য, তাতে সব মিলিয়ে বড় হুমকিটা তিনিই হবেন।
প্রথম ম্যাচের ফলটা এ ম্যাচে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে। হয়তো এ ম্যাচের আগে বলা হবে, ‘এটা ভিন্ন ম্যাচ, নতুন দিন।’ কিন্তু আগের ম্যাচে নেতিবাচক কিছু হলে সেটির প্রভাব থেকেই যাবে এ ম্যাচে। এরপরও যেকোনো পরিস্থিতিতে যদি দল উজ্জীবিত থাকে, দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানোর মনোভাব থাকে, তাহলে তো কথাই নেই। কিন্তু অনেক ভালো খেলতে হবে।
যা করতে হবে
দক্ষিণ আফ্রিকা দলের অধিকাংশ খেলোয়াড়ই আইপিএল খেলেছেন। ফলে মানসিক দিক দিয়ে বড় মঞ্চে খেলার জন্য তাঁরা প্রস্তুত। বাংলাদেশকে সেই চ্যালেঞ্জটা নিতে হবে। এ ম্যাচে বোলিং আর ফিল্ডিং অনেক গুরুত্বপূর্ণ হবে। দক্ষিণ আফ্রিকান ব্যাটারদের অতি আক্রমণাত্মক মানসিকতাই তাদের ভরাডুবির কারণ হতে পারে। সেটিই কাজে লাগাতে হবে। তাঁদের সামলানোর জন্য সাজাতে হবে সঠিক পরিকল্পনা। ইতিবাচক ও সাহসী থাকতে হবে। বোলিং-ফিল্ডিংয়ে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে।
যাঁকে নিয়ে ভয়
হাইনরিখ ক্লাসেন
ক্লাসেন যেমন খেলছেন, তাতে যেকোনো দলের জন্যই তিনি বড় হুমকি। অনেক কম সময়ের মধ্যে একা খেলা ঘুরিয়ে দেওয়ার সামর্থ্য আছে। শুধু পেস নয়, স্পিনের বিপক্ষেও দারুণ। আইপিএলে দারুণ খেলেছেন, হায়দরাবাদের টপ অর্ডারের কারণে হয়তো সেভাবে লম্বা ইনিংস খেলতে হয়নি। এরপরও প্রথম ১১ ইনিংসে স্ট্রাইক রেট প্রায় ১৯০ ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকা দলে বেশ কয়েকজনই ম্যাচ ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো আছেন। এরপরও ক্লাসেন একটু আলাদা।
ডাচদের সঙ্গে সাম্প্রতিক অতীতটা সুবিধার নয়। ওয়ানডে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ তাদের কাছে হেরেছে, তার আগে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে জিতলেও ব্যবধানটা বড় ছিল না। নেদারল্যান্ডস কিন্তু এ ম্যাচকে পাখির চোখ করবে। ফলে কোনোভাবেই ম্যাচটি বাংলাদেশের জন্য সহজ হবে না। অন্য ম্যাচের মতো এটিতেও চাপ থাকবে। তৃতীয় ম্যাচ বলে আগের ম্যাচের ফলের প্রভাবও থাকবে।
যা করতে হবে
এমন দলের বিপক্ষে সহজাত ক্রিকেটটা খেলতে পারলে বাংলাদেশ দলের এগিয়ে থাকার একটা সুযোগ থাকবে। তবে আগেও যেহেতু তারা বাংলাদেশকে হারিয়েছে, নেদারল্যান্ডসের একটা আত্মবিশ্বাসও থাকবে। তবে তাসকিন যদি বিশ্বকাপের শুরুতে না-ও থাকে, এ ম্যাচের আগে তিনি হয়তো ফিট হয়ে উঠবে। তখন বাংলাদেশের বাড়তি একটা পাওনা হবে সেটি।
যাঁকে নিয়ে ভয়
বাস ডি লিডি
ইতিবাচক, আক্রমণাত্মক। অতীতেও ম্যাচ বের করে নিয়ে যাওয়ার মতো পারফরম্যান্স আছে তাঁর। এমনিতে কাউন্টি ক্রিকেটে ব্যস্ত ছিলেন, জাতীয় দলের ডাকেই বিশ্বকাপে যাচ্ছেন। স্বাভাবিকভাবেই বাড়তি একটা তাড়নাও কাজ করবে তাঁর। ডারহামের হয়ে সাম্প্রতিক রেকর্ডও বেশ ভালো দেখেছি। সাধারণত ওপরের দিকে খেলেন, ইনিংস ধরে রাখার কাজটিই করে। তবে ব্যাটিংয়ে তাঁর উইকেটটা গুরুত্বপূর্ণ। আর বোলিংয়েও ক্রমাগত লাইন-লেংথ ধরে করে যেতে পারেন।
নেপালের মতো দল অনেক ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে আসবে। তারা যেভাবে উঠে এসেছে বিশ্বকাপে, তাতে একদিক থেকে হারানোর কিছু নেই। এই যাত্রাটা তাদের অনেক সাহসী আর পরিণত করে তুলেছে। সেটির প্রভাব নিশ্চয়ই মাঠে থাকবে। শেষ মুহূর্তে সন্দীপ লামিচানে দলে এলে সেটি নেপালকে আরও শক্তিশালী করে তুলবে।
যা করতে হবে
সহযোগী দেশ হওয়ায় নেপাল সাধারণত সহযোগী দেশগুলোর বিপক্ষেই খেলে। কিন্তু তাদের হালকাভাবে নেওয়ার কিছু নেই। সম্প্রতি ওয়েস্ট ইন্ডিজ ‘এ’ দলের সঙ্গে ৫ ম্যাচের সিরিজ খেলেছে, যাতে দুটি ম্যাচ জিতেছে। সেখানে যথেষ্ট ভালো ক্রিকেট খেলেছে তারা, পরিণতবোধের ছাপও ছিল। তাদের কিছু ব্যাটসম্যান আছে, যাঁরা বড় ইনিংস খেলতে পারেন, লম্বা শটের সামর্থ্য আছে। তাদের বিপক্ষে মোটামুটি একটা স্কোর গড়লেই যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া যাবে, ব্যাপারটি মোটেও তেমন নয়। নেপালকে হারাতে গেলে মানসিক দৃঢ়তার পরিচয় দিতে হবে। পাশাপাশি নিজেদের সেরা ক্রিকেটটিই খেলতে হবে।
যাঁকে নিয়ে ভয়
কুশল মাল্লা
টি-টোয়েন্টিতে একজনই ম্যাচ ঘুরিয়ে দিতে পারেন। নেপালের এমন কয়েকজন আছেন। অধিনায়ক রোহিত পৌড়েল ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে অসাধারণ খেলেছেন। তবে বাংলাদেশের জন্য বড় একটা হুমকি হতে পারেন কুশল মাল্লা। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ‘এ’ দলের সঙ্গে শুরুতে তেমন কিছু করতে না পারলেও শেষ ম্যাচে ১৮ বলে ৩৭ রানের ইনিংসে দলকে জিতিয়েছিলেন। বড় ছক্কা মারার সামর্থ্যও আছে এই তরুণের। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ১৬৭ স্ট্রাইক রেট, মাল্লার দিকে তাই নজর রাখতে হবে।