হঠাৎই থেমে গেল ফয়সাল মুভার্স। ইসলামাবাদ টু লাহোর বিশাল মোটরওয়ে দিয়ে এতক্ষণ যে মসৃণ গতিতে ছুটছিল বাসটি, তাতে এই থেমে যাওয়া কৌতূহল জাগাতে বাধ্য।
চ্যাম্পিয়নস ট্রফির রাওয়ালপিন্ডি পর্ব শেষ হওয়ার পরদিন খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের আকোরা খট্টক শহরে আত্মঘাতী বোমা হামলায় ছয়জন নিহত হয়েছেন। ইসলামাবাদ থেকে আকোরা খট্টক সড়কপথে মাত্র দুই ঘণ্টা দূরে। পাকিস্তানের রাজধানীবাসীকে ভালোই নাড়া দিয়েছে ওই ঘটনা।
এর পরদিনই ইসলামাবাদ থেকে লাহোর যাওয়ার পথে আকস্মিক যাত্রাবিরতি মনে প্রশ্নের উদ্রেক করবেই, বিশেষ করে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি কাভার করতে পাকিস্তানে আসা বাংলাদেশি সাংবাদিকদের মতো যাঁরা এই সড়কের নিয়মিত যাত্রী নন, তাঁদের মনে। আবার কোনো অঘটন নয় তো!
বাসের অ্যাটেনডেন্টকে কারণ জিজ্ঞাসা করে কিছুটা স্বস্তি বোধ হলো। তাঁর উর্দু ও ইংরেজি মেশানো উত্তরে তাৎক্ষণিক ধরে নিলাম, কোনো একটা ভিআইপি মুভমেন্ট হবে সম্ভবত। তাঁর প্রটোকল রক্ষার্থেই এই বিরতি।
অনুমান কিংবা তাঁর কথার অনুবাদটা যে ভুল ছিল, তা বোঝা গেল প্রায় মিনিট তিরিশেক পর বাস আবার চলতে শুরু করলে। ততক্ষণে ফয়সাল মুভার্সের পেছনে আরও অনেক বাসের দীর্ঘ সারি। বিলাসবহুল বাস ফয়সাল মুভার্সের সামনে অবশ্য আর একটিই মাত্র বাস, আর তার সামনে ধীরগতিতে চলছে মোটরওয়ে পুলিশের একটি গাড়ি।
মহাসড়কের ডান দিক দিয়ে সাঁই সাঁই করে অন্য যানবাহন চলে যাচ্ছে, কিন্তু বাঁ দিকের লেন ধরে যাত্রীবাহী বাসের লম্বা বহরটাকে বেশ ধীরগতিতে চলতে হচ্ছে পুলিশের গাড়ি অনুসরণ করে। মোটরওয়ে পুলিশের গাড়ি কি তাহলে বাসগুলোকেই ‘ভিআইপি প্রটোকল’ দিচ্ছে! ব্যাপার অনেকটা সে রকমই, তবে ঠিক ‘ভিআইপি প্রটোকল’ নয়। আসলে দিচ্ছিল পাহারা।
২০২৩ সালের জুনের ঘটনা। ইসলামাবাদ-লাহোর মোটরওয়েতে মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ১৩ জন বাসযাত্রী। তাঁদের বহন করা বাসটির যান্ত্রিক ত্রুটির কারণেই ঘটেছিল দুর্ঘটনা। মহাসড়কের কাল্লার কাহার সল্ট রেঞ্জ এলাকায় ঘটা ওই দুর্ঘটনার পর যাত্রীদের নিরাপত্তার স্বার্থে পাকিস্তান মোটরওয়ে পুলিশ সিদ্ধান্ত নেয়, ইসলামাবাদ-লাহোর মোটরওয়ের ওই ১০ কিমি অংশে সব যাত্রীবাহী বাস পার হবে পুলিশি প্রহরায়।
মূলত বাসের গতি নিয়ন্ত্রণে রাখতেই এই ব্যবস্থা। এই মহাসড়কে চলা যানবাহনের ফিটনেসও এখন থাকতে হয় সর্বোচ্চ মানের। কোনো রকম ত্রুটি ধরা পড়লেই করা হয় বড় অঙ্কের জরিমানা।
ইসলামাবাদ-লাহোর মোটরওয়ের ওই ১০ কিমি মতো অংশের দুই পাশে উঁচু-নিচু শিলা পাহাড় (রক মাউন্টেইন)। ভৌগলিক বিন্যাসের কারণে এই শিলা পাহাড় কোথাও কোথাও হঠাৎই বাঁক নিয়েছে, আবার কোথাও পাশাপাশি দুটি পাহাড়ের উচ্চতায় আছে ব্যাপক উত্থান-পতন।
উঁচু-নিচু পাহাড়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কোথাও মহাসড়কও নেমে গেছে নিচের দিকে, পাহাড়ের ঢাল বাওয়ার মতো আবার উঠেছে ওপরে। অস্বাভাবিক এই পর্বতমালার ফাঁক গলে আসা বাতাস থাকে প্রচণ্ড এলোমেলো, প্রবাহিতও হয় অনেক জোরে। আর সেটাকেই মনে করা হয় এই অঞ্চলে দুর্ঘটনার বড় কারণ।
অতিরিক্ত গতি আর ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন এই অংশ পার হওয়ার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে পড়া হিমালয়ের পশ্চিমাংশের একেবারে দক্ষিণের অংশটাই সল্ট রেঞ্জ নামে পরিচিত। এমনিতে মারগালা হিলস আর সল্ট রেঞ্জের উঁচু প্রাচীর ইসলামাবাদকে গরম হাওয়া থেকে বাঁচালেও ওই সড়কে রাজধানী থেকে বের হওয়ার পথে সল্ট রেঞ্জ ছুঁয়ে আসা পাগলাটে বাতাসই হয়ে উঠতে পারে বড় বিপদের কারণ।
২০২৩ সালের দুর্ঘটনার আগেও মোটরওয়ের এই অংশে বাতাসের কারণে অনেক যানবাহন বিপদে পড়েছে। তবে ২০২৩ সালের দুর্ঘটনার পর থেকে মোটরওয়ে পুলিশ নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সব যাত্রীবাহী বাসকে সল্ট রেঞ্জ এলাকা পার করে দেয় পাহারা দিয়ে।
পুলিশের গাড়ির পেছনে নির্দিষ্টসংখ্যক বাস সারি বেঁধে খুবই অল্প গতিসীমায় পার হয় ওই ভয়ংকর এলাকা। যানজটমুক্ত বিশাল মহাসড়কেও বিপজ্জনক এই ১০ কিমি পথ যেতে লেগে যায় ৩০ থেকে ৩৫ মিনিট। ২০২৩ সালে এই ব্যবস্থা নেওয়ার পর থেকে মোটরওয়ের পুলিশের প্রত্যাশা অনুযায়ী ইসলামাবাদ-লাহোর মহাসড়কের সল্ট রেঞ্জ অংশে অন্তত অতিরিক্ত গতির কারণে কোনো দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি।
চ্যাম্পিয়নস ট্রফি উপলক্ষে পাঞ্জাব সরকারের বিশেষ নির্দেশনায় গত মাসে মাত্র ১৮ দিনের মধ্যে ২ টন লোহা দিয়ে বানানো হয়েছে ২৫ ফুট উচ্চতার ভাস্কর্য ‘রানিং ম্যান’।
সব জানার পর মোটরওয়ের আনন্দময় বাস ভ্রমণে হঠাৎ পড়া বিরতিটাকে আর বিরক্তিকর মনে হয়নি। যেমন বিরক্তিকর মনে হচ্ছে না লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের আশপাশের সশস্ত্র নিরাপত্তাব্যবস্থাকে। অবশ্য পাকিস্তানের মূল ক্রিকেট ভেন্যুতে, ফিরোজপুর রোডের যে স্টেডিয়ামে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের (পিসিবি) প্রধান কার্যালয়ও; সেখানে এমন নিরাপত্তা ব্যবস্থা নতুন কিছু নয়।
২০০৮ সালে বাংলাদেশ-পাকিস্তান পাঁচ ওয়ানডের সিরিজ কাভার করতে লাহোরে এসে কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা চোখে পড়েছে। পরের বছর তো গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের একেবারে কাছে লিবার্টি চকে শ্রীলঙ্কা দলের ওপর সন্ত্রাসীদের বন্দুক হামলার ঘটনাই ঘটল।
টিম হোটেল থেকে আসা শ্রীলঙ্কা দলের বাস লিবার্টি গেট দিয়ে গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে ঢোকার ঠিক আগে হয় ওই হামলা। এর পর থেকে এই স্টেডিয়ামে নিরাপত্তার কড়াকড়ি বেড়েছে আরও, যেটা দেখা হয়েছে ২০২৩ সালের এশিয়া কাপ কাভার করতে লাহোরে এসেও।
বহুজাতিক টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়নস ট্রফি উপলক্ষে এবার সেটি আরও বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। ৫ মার্চের দ্বিতীয় সেমিফাইনালসহ গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে টুর্নামেন্টের অন্তত চারটি ম্যাচ হচ্ছে। ভারত ফাইনালে না উঠলে হবে ফাইনালও। গাদ্দাফি স্টেডিয়াম তাই এই মুহূর্তে হয়ে উঠেছে পাকিস্তানের অন্যতম স্পর্শকাতর স্থান।
কাল সন্ধ্যায় স্টেডিয়াম এলাকায় পা দিয়ে নিরাপত্তার সেই ঝাঁঝ বেশ ভালোই টের পাওয়া গেছে। মূল সড়ক থেকে স্টেডিয়ামে ঢোকার সব পথেই পুলিশি পাহারা ও লোহার ব্যারিকেড। সেসবও কয়েক স্তরের। অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড সঙ্গে থাকলে অবশ্য এগুলো কোনো সমস্যা নয় এখানে। অন্ধকারের মধ্যে নীরব স্টেডিয়াম এলাকায়ও সন্ধ্যায় হাঁটার অনুমতি মিলে গেল দায়িত্বরত নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের কাছ থেকে।
আসল উদ্দেশ্য অবশ্য ছিল ফিরোজপুর রোডের গেট দিয়ে গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে ঢুকে আরেক পাশের লিবার্টি গেট দিয়ে বের হওয়া। এখানে আসার আগে জেনেছি, লিবার্টি গেটের ঠিক বাইরের সবুজ চত্বরে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি উপলক্ষে বসানো হয়েছে লোহার ভাস্কর্য ‘রানিং ম্যান।’
সন্ধ্যায় হাঁটার একটি উদ্দেশ্য সেটি দেখা, তবে উদ্দেশ্য আরেকটিও ছিল। শ্রীলঙ্কা দলের ওপর বন্দুক হামলার ১৬ বছর পূর্তিতে সেই লিবার্টি চকে একটু ঘুরে আসা, যেটি এখন আলো আর ঝরনার রঙে রঙিন।
লিবার্টি গেটের বাইরে লোহার ‘রানিং ম্যান’ দৌড়াচ্ছে একজন ক্রিকেটারের দৌড়ের আদলে। চ্যাম্পিয়নস ট্রফি উপলক্ষে পাঞ্জাব সরকারের বিশেষ নির্দেশনায় গত মাসে মাত্র ১৮ দিনের মধ্যে ২ টন লোহা দিয়ে বানানো হয়েছে ২৫ ফুট উচ্চতার এই ভাস্কর্য, যা দিয়ে মূলত ক্রিকেটের শক্তিকেই উপস্থাপন করার চেষ্টা হয়েছে।
‘রানিং ম্যানে’র অবস্থান লিবার্টি গেটের ঠিক বাইরে বলে ক্রিকেটের শক্তির এই প্রতীককে চাইলে ২০০৯ সালের মার্চে অদূরের লিবার্টি চকে হওয়া ক্রিকেটের ওপর হামলার প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে ধরে নেওয়া যায়, যার পরিণতিতে প্রায় ছয় বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দূরে সরে ছিল পাকিস্তান থেকে। কাল সন্ধ্যায় গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের অন্যান্য প্রবেশদ্বারের মতো লিবার্টি গেটেও দেখা গেল ব্যাপক নিরাপত্তা।
আজ থেকে ১৬ বছর আগে যে লিবার্টি গেটে আতঙ্কিত সময় পার করেছিল ক্রিকেট।
২০১৫ সালে ক্রিকেট আবার পাকিস্তানে ফিরলেও ২৯ বছর বিরতি দিয়ে আইসিসির কোনো ইভেন্ট এখানে হতে পারছে এবারই প্রথম।
সেটিও লাহোরে শ্রীলঙ্কা দলের ওপর হামলা ও পাকিস্তান থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নির্বাসিত হওয়ার ১৬ বছর পূর্তির সমাগত সময়ে। কাল সেই ৩ মার্চ, ২০০৯ সালের যে দিনে গুলিতে ঝাঁজরা হয়েছিল শ্রীলঙ্কা দলের বাস, আহত হয়েছিলেন ক্রিকেটার অজন্তা মেন্ডিস, থিলান সামারাবীরা, থারাঙ্গা পারাভিথারানাসহ আরও অনেকে। কেঁপে উঠেছিল পুরো ক্রিকেট বিশ্বই।
কী কাকতাল, ওই ঘটনার ১৬ বছর পর ঠিক ওই সময়েই পাকিস্তানে হচ্ছে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি! শ্রীলঙ্কা দল এবার টুর্নামেন্টটা না খেললেও কালকের দিনে তারাও নিশ্চয়ই মনে করবে লাহোরকে।