২০০৪ সালে ১১ ডিসেম্বর, ঢাকায় সেদিন সুনীল গাভাস্কারের সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলেছিলেন শচীন টেন্ডুলকার
২০০৪ সালে ১১ ডিসেম্বর, ঢাকায় সেদিন সুনীল গাভাস্কারের সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলেছিলেন শচীন টেন্ডুলকার

টেন্ডুলকারের ‘৫০’

যেদিন শচীনের কানে ‘১০০’–এর মন্ত্র পড়েছিলেন গাভাস্কার

ক্রীড়া সাংবাদিকতায় তখন আমি হাঁটি হাঁটি পা, বছর দেড়েকের ‘শিশু’। ২০০৪ সালের ১১ ডিসেম্বরের কথা। ঢাকায় হালকা শীতের সেদিনের পড়ন্ত বিকেলে ক্রীড়া সাংবাদিকতার ‘শিশুকালে’ই অসাধারণ এক মুহূর্ত এসেছিল আমার জীবনে। সুযোগ পেয়েছিলাম সংবাদ সম্মেলনে কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকারকে একটি প্রশ্ন করার।

সেই সময় ক্রিকেট হতো বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের সংবাদ সম্মেলনকক্ষে শচীন টেন্ডুলকার ঢুকতেই খানিক নীরবতা নেমে আসে। ঢাকা টেস্টের দ্বিতীয় দিন ছিল সেটি। নিজেদের প্রথম ইনিংসে টেস্ট ক্যারিয়ারের ৩৪তম সেঞ্চুরি করে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে এসেছিলেন টেন্ডুলকার। ভারতীয় ব্যাটসম্যানের জন্য সেটি ছিল বিশেষ এক মাইলফলকের দিন। ওই সেঞ্চুরিতেই যে টেস্ট ক্রিকেটে সুনীল গাভাস্কারের সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলেছিলেন ‘লিটল মাস্টার’।

টেন্ডুলকার সংবাদ সম্মেলনকক্ষে ঢুকতেই যেন অন্য রকম একটা আভা ছড়িয়ে পড়ল। সেই আভা দেখতে দেখতেই সাংবাদিকেরা টেবিলের ওপর ঠিক করে রাখছিলেন মিনি টেপ রেকর্ডার। সেটা শেষ হতেই শুরু হয় প্রশ্নোত্তর পর্ব। যাঁরা প্রশ্ন করতে চান, তাঁদের হাত তুলতে বলা হলো। আমি হাত তুললাম, সঙ্গে আরও কয়েকজন।

মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে যিনি কক্ষে ঘুরছিলেন, তাঁকে উদ্দেশ্য করে টেন্ডুলকার বললেন, ‘ওই যে ছোটখাটো একজন (দ্যাট লিটল ওয়ান) হাত তুলেছে, ওকে মাইক্রোফোন দিন।’

আমি যে প্রশ্ন করতে চাইছিলাম, তা হলো সেঞ্চুরি করে গাভাস্কারকে ছোঁয়ার পর চা–বিরতিতে মাঠ থেকে বেরিয়ে আসার সময় ধারাভাষ্যকক্ষ থেকে নিচে নেমে গিয়েছিলেন সুনীল গাভাস্কার। টেন্ডুলকার বেরিয়ে আসতেই তাঁকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। তাঁকে কিছু একটা বলেছিলেনও তখন। কী বলেছিলেন, সেটাই আমার জানার ইচ্ছা ছিল।

তবে আরও কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিক হাত তোলায় আমি আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম, আমার হয়তো আর প্রশ্ন করা হলো না! কিন্তু মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে যিনি কক্ষে ঘুরছিলেন, তাঁকে উদ্দেশ্য করে টেন্ডুলকার বললেন, ‘ওই যে ছোটখাটো একজন (দ্যাট লিটল ওয়ান) হাত তুলেছে, ওকে মাইক্রোফোন দিন।’

ঢাকায় বাংলাদেশের বিপক্ষে এই সেঞ্চুরিতেই গাভাস্কারকে ছুঁয়ে ফেলেন টেন্ডুলকার

টেন্ডুলকার আমাকে মাইক্রোফোন দিতে বলেছেন তাঁকে প্রশ্ন করার জন্য। আমার তো তখন বাকরুদ্ধ অবস্থা। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘দেখেছি, আপনি সেঞ্চুরি করার পর মাঠ থেকে বেরিয়ে আসার সময় সুনীল গাভাস্কার আপনাকে বুকে টেনে নিয়েছেন। একই সঙ্গে কিছু বলেছেনও উনি। কী বললেন?’ টেন্ডুলকারের উত্তর ছিল, ‘প্রথমে তিনি তাঁকে ছুঁয়ে ফেলার জন্য আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এরপর কানে কানে বলেছেন সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি করতে।’

প্রশ্নের পিঠে সাহস করে আরেকটি প্রশ্ন করে ফেললাম, ‘আপনি কি মনে করেন সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি করা সম্ভব?’ এবার টেন্ডুলকারের উত্তরটা ছিল এ রকম, ‘আমি আসলে কোনো রেকর্ড গড়ার জন্য খেলি না। আমি দলের জন্য খেলি, দলকে জেতাতে রান করি। সেটা করতে গিয়েই সেঞ্চুরি হয়ে যায়। কখনো কখনো রেকর্ডও হয়। কিন্তু রেকর্ড, মাইলফলক—এগুলো মাথায় নিয়ে ব্যাট করতে নামি না।’

২০০৪ সালের ১১ ডিসেম্বর টেন্ডুলকারের সেঞ্চুরি ছিল ৭১টি (টেস্টে ৩৪, ওয়ানডেতে ৩৭)। তখনো টেন্ডুলকার ভালো খেলছিলেন, ছিলেন ছন্দে। কিন্তু ১৯৮৯ সালে শুরু ক্যারিয়ারটা যে সে সময় মধ্যগগনে ছিল, তা বলা যাবে না।

আমি এ মাইলফলক নিয়ে কখনো ভাবিইনি। সংবাদমাধ্যমই আসলে এটা শুরু করেছে। রেস্তোরাঁ, রুম সার্ভিস; আমি যেখানেই যেতাম—সবাই ১০০তম সেঞ্চুরি নিয়ে কথা বলতে চাইত।
শচীন টেন্ডুলকার

ক্যারিয়ারের দেড় দশক পেরিয়ে গেছে তখন। অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন হয়তো তাঁর ক্যারিয়ার ভাটার টানে। আর ‘সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি’ তখনো ২৯ সেঞ্চুরি বাকি! ২০০৪ সালের পর কয়েকবার টেন্ডুলকারের ফর্ম নিয়ে তুমুল সমালোচনা হয়েছে। কয়েকবারই তাঁর ক্যারিয়ারের এপিটাফও লিখে ফেলেছিলেন অনেকে! একটা সময় তো কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম টেন্ডুলকারকে ‘এন্ডুলকার’ নামও দিয়ে দিয়েছিল!

সেই সময়েও কি সেদিনের সেই পড়ন্ত বিকেলে তাঁর কানে গাভাস্কারের পড়ে দেওয়া মন্ত্রটা মনে পড়েনি টেন্ডুলকারের? হয়তো পড়েছে, হয়তো নয়। যে ঢাকাতে গাভাস্কারকে ছুঁয়েছিলেন, সেই ঢাকাতেই টেন্ডুলকারের শততম সেঞ্চুরির অনন্য এক ইতিহাস। তাঁর ক্যারিয়ারের শততম সেঞ্চুরিটি করেছেন ২০১২ সালের ১৬ মার্চ, মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে। আমি তখন ক্রীড়া সাংবাদিকতায় শিশুকাল কাটিয়ে ফেলেছি। প্রেসবক্সে বসেই দেখেছি তাঁর ইতিহাস গড়ার সেই মুহূর্ত।

সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি, মিরপুরে টেন্ডুলকারের ইতিহাস গড়া সেই মুহূর্ত

কিন্তু আফসোস একটাই, টেন্ডুলকারের শততম সেঞ্চুরির পরের সংবাদ সম্মেলনে থাকা হয়নি আমার। অফিসের অন্য ব্যস্ততার কারণে সেটি দেখতে হয়েছে টেলিভিশনে। টেন্ডুলকারের সেই সংবাদ সম্মেলন সরাসরি দেখিয়েছিল খেলা সম্প্রচারকারী প্রতিষ্ঠান। টিভিতে সেই সংবাদ সম্মেলন দেখতে দেখতেই মনে হচ্ছিল, এদিন টেন্ডুলকার–আভাটা যেন আরও উজ্জ্বল। সংবাদ সম্মেলন কক্ষটা যেন আরও আলোকিত! শেরেবাংলার সংবাদ সম্মেলনে ৮ বছর আগের সেই টেন্ডুলকারই ধরা দিলেন! ক্রিকেট ইতিহাসে এমন এক অমরাবতী রচনা করেও যিনি বরাবরের মতোই মহাবিনয়ী আর সাদাসিধে এক মানুষ!

টেন্ডুলকারের ইতিহাস গড়া ম্যাচটি জিততে পারেনি ভারত। এশিয়া কাপের ম্যাচটি বাংলাদেশের কাছে হেরেছে তারা ৫ উইকেটে। কিন্তু অমন ঐতিহাসিক ম্যাচে হার–জিত নিয়ে কেই–বা আর ভাববে। ম্যাচ শেষে মহাগুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ক্রিকেট ইতিহাসের নায়ক শচীন রমেশ টেন্ডুলকারের সংবাদ সম্মেলনটি। কে জানে, আবেগঘন সেই সংবাদ সম্মেলনে সেদিন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ২০০৪ সালের ১১ ডিসেম্বরের সংবাদ সম্মেলনটির কথা মনে পড়েছিল কি না টেন্ডুলকারের!

অনন্য কীর্তির দিনে বাংলাদেশের কাছে ভারত হারলেও সংবাদ সম্মেলনে টেন্ডুলকারের মুখে লেগে ছিল হাসি

১৬ মার্চ, ২০১২ সালের সংবাদ সম্মেলনে টেন্ডুলকার বলেছেন, ‘আমি এ মাইলফলক নিয়ে কখনো ভাবিইনি। সংবাদমাধ্যমই আসলে এটা শুরু করেছে। রেস্তোরাঁ, রুম সার্ভিস; আমি যেখানেই যেতাম—সবাই ১০০তম সেঞ্চুরি নিয়ে কথা বলতে চাইত। আমি যে এর আগে ৯৯টি সেঞ্চুরি করেছি, সেটা নিয়ে কেউ কোনো কথা বলত না। এ সেঞ্চুরি করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। বল ঠিকভাবে ব্যাটে আসছিল না। কিন্তু কীভাবে সেঞ্চুরি পেলাম, সেটা ব্যাপার নয়। আপনাকে মাথা নিচু করে দলের জন্য রান করে যেতে হবে।’

শত কোটি ভারতীয়দের কাছে টেন্ডুলকার ক্রিকেট–দেবতা। কিন্তু দিন শেষে তিনিও তো রক্তমাংসে গড়া এক মানুষ। তাই তো সংবাদ সম্মেলনের এক ফাঁকে আবেগ আর ধরে রাখতে পারেননি। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ফেললেন, ‘স্বপ্ন কখনো না কখনো সত্যি হয়ই। এই যে বিশ্বকাপের কথাই ধরুন না, একটি বিশ্বকাপ জয়ের জন্য আমি ২২ বছর অপেক্ষা করেছি!’

টিভিতে টেন্ডুলকারকে ১০০তম সেঞ্চুরি করতে দেখে আপ্লুত তাঁর কোচ রমাকান্ত আচরেকার

সেই সংবাদ সম্মেলন টিভিতে দেখতে দেখতে ভাবছিলাম—টেন্ডুলকারের কি ২০০৪ সালের ১১ ডিসেম্বরের সেই সংবাদ সম্মেলনটির কথা মনে আছে? তাঁর শততম সেঞ্চুরির পরের সংবাদ সম্মেলনে থাকতে পারলে হয়তো আমিই মনে করিয়ে দিতাম তা! এরপর কি বলতেন টেন্ডুলকার? ‘আমি আসলে রেকর্ডের জন্য খেলি না’, নাকি ‘স্বপ্ন কখনো না কখনো সত্যি হয়ই!’