ছয় মেরে সেঞ্চুরি তোলার সঙ্গে ভারতের জয়ও নিশ্চিত করেন বিরাট কোহলি
ছয় মেরে সেঞ্চুরি তোলার সঙ্গে ভারতের জয়ও নিশ্চিত করেন বিরাট কোহলি

হারের সঙ্গে কোহলির সেঞ্চুরিও দেখল বাংলাদেশ

পুনের গ্যালারি যেন নীল সমুদ্র। অনেক খুঁজলে দু'একজন ধোনি, নইলে বলতে গেলে বাকি সবাই হয় 'বিরাট', নয় তো 'রোহিত'। মানে বিরাট কোহলি আর রোহিত শর্মার জার্সি গায়ে ভারতীয় দর্শককূল। সংখ্যায় বিরাট বেশি, না রোহিত--সেটি বোঝার উপায় নেই। এ নিয়ে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাও ছিল বলে মনে হয় না।

মাঠে অবশ্য 'বিরাট'-ই জিতলেন। ছক্কা মেরে নিজের সেঞ্চুরি আর দলের জয় নিশ্চিত করে বিরাট কোহলি দুহাত উপরে তুলে ধরতেই ফেটে পড়ল গ্যালারি। ফুটতে শুরু করল বাজি। ভারত হেরে গেলেও তা ফুটত কি না, এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই। তবে আজকের ম্যাচ শেষে এটিকে মনে হলো ভারতের সেমিফাইনাল প্রায় নিশ্চিত করে ফেলার উদযাপন। নিউজিল্যান্ডের মতো ভারতও এখন চারে-চার। এই দুই দল তাই সেমিফাইনালে উঠে গেছে ধরে নিয়েই বাকি সব হিসাবনিকাশ করা ভালো।

চার ম্যাচে একটি মাত্র জয় পাওয়া বাংলাদেশের কি আদৌ কোনো সম্ভাবনা আছে? কাগজে-কলমে তো আছেই। তবে সেজন্য বাকি পাঁচ ম্যাচের অন্তত চারটি জিততে হবে। আশা করলে তাই নিজ দায়িত্বে করুন।

কারণ কী, জানেন? বাংলাদেশ দলের অবস্থা অনেকটা ছিদ্রভরা টিনের চালের মতো। একটা ছিদ্রপথ দিয়ে বৃষ্টির ধারা থামাতে গেলে আরেকটা দিয়ে তা পড়তে থাকে। বিশ্বকাপে প্রথম তিন ম্যাচে সবচেয়ে বড়, বলতে গেলে একমাত্র সমস্যা হিসেবে যা চিহ্নিত হয়েছিল, তা হলো 'শুরু'। শুরুটা ভালো হচ্ছে না।

শুরু বলতে ব্যাটিং-বোলিং দুটিরই শুরু। তবে নামতে না নামতেই উদ্বোধনী জুটি ভেঙে যাচ্ছিল বলে ভালো শুরুর প্রার্থনাটা মূলত ব্যাটিংকেন্দ্রিকই ছিল। সেই শুরুটা এমনই ভালো হলো যে, সপ্তম বিশ্বকাপে এসে ভেঙে গেল ২৪ বছর আগে প্রথম বিশ্বকাপে গড়া উদ্বোধনী জুটির রেকর্ড। ব্যাটিং-স্বর্গ উইকেটে ১৪.৩ ওভারেই বাংলাদেশ কোনো উইকেট না হারিয়ে ৯৩। তিন শ তো হচ্ছেই, হয়তো আরও অনেক বেশিও।

শেষ পর্যন্ত যা হয়েছে, ম্যাচ আসলে সেখানেই শেষ। ভারতের এই প্রবল পরাক্রমশালী ব্যাটিং লাইন আপের জন্য ২৫৬ কোনো রান নাকি! তার ওপর আবার উইকেট এমন, সম্ভব হলে যেটিকে ব্যাটসম্যানরা ভেন্যু থেকে ভেন্যুতে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন।

ওপেনিংয়ে ভালো রান এলেও মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানরা থিতু হতে পারেননি

এই ম্যাচের পর নতুন সমস্যা হিসেবে অবশ্যই বলা হবে মিডল অর্ডার ব্যাটিংয়ের কথা। ওপেনারদের গড়ে দেওয়া অমন দারুণ একটা ভিত্তি গড়ে দেওয়ার পরও যাঁরা সব গুবলেট পাকিয়ে ফেললেন। পেসারদের মোটামুটি সামলে নেওয়ার পর হাবুডুবু নাকি স্পিনে! বল এমন কোনো টার্ন করেনি। তারপরও ভারতের দুই রকম দুই বাঁহাতি স্পিনারের বলে এমন হাসফাঁস যে, রানের চাকা যেন কাদায় আটকে গেল। এমন অবস্থায় উইকেট পড়তে বাধ্য। টপাটপ তা পড়তেও থাকল।

কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহেও কিছুটা 'কৃতিত্ব' পাবেন। ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে-চলবে বলে ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন এই ম্যাচের আগে। তা হচ্ছে মূলত মেহেদী হাসান মিরাজকে নিয়েই। তাঁকে নিয়ে যা করছেন হাথুরুসিংহে, সেটির ব্যাখ্যা শুধু তিনিই দিতে পারবেন। নিয়মিত উপরের দিকে ব্যাটিং করছেন, মিরাজকে এখন তাই মেকশিফট ব্যাটসম্যান বলার উপায় নেই। বরং পুরোদস্তুর মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান। সেটাই যদি হয়, তাহলে প্রশ্নটা জাগেই। মিরাজ কি তাওহিদ হৃদয় বা মুশফিকুর রহিমের চেয়েও ভালো?

চতুর্থ ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হওয়ার আগে ৮২ বলে ৬৬ রান করেন লিটন দাস

ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে মিরাজকে চারে পাঠিয়ে কেন মুশফিক আর মাহমুদউল্লাহর নামাটা আরও পিছিয়ে দিতে হবে! আগের ম্যাচে ৮ নম্বরে নেমে দলের রানটাকে ভদ্রস্থ করেছিলেন মাহমুদউল্লাহ। এদিন সাতে নেমে তাঁর ৪৬ রানেই আড়াই শ পার হলো বাংলাদেশ। আউট হয়েছেন শেষ ওভারে। কে জানে, আরও বেশি বল পেলে হয়তো আরও বেশি রান করলেও করতে পারতেন।

সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা ম্যাচ শুরু হওয়ার আগেই। টস হওয়ার মিনিট বিশেক বাকি থাকতেও সাকিবকে মাঠে নক করতে দেখা গেল। এই ম্যাচে খেলবেন কি খেলবেন না—এই সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা ছিল ম্যাচের আগে মাঠে এসে। নক করছেন মানে তো খেলছেনই। গত দুদিনই সাকিব খেলতে পারবেন কি পারবেন না নিয়ে এমন দোলাচল। শেষ পর্যন্ত না খেলানোর সিদ্ধান্ত মূলত পরের ম্যাচগুলোর কথা ভেবেই। এই ম্যাচে হয়তো খেলে ফেলতে পারতেন। কিন্তু একটু এদিক-ওদিক হলে অনেক দিনের জন্য বাইরে চলে যাওয়ার ঝুঁকিও থাকত। অপ্রত্যাশিতভাবে বিশ্বকাপে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব তাই সহ-অধিনায়ক নাজমুল হোসেনের কাঁধে।

বুমরার ইয়র্কারে বোল্ড হওয়ার আগে ৩৬ বলে ৪৬ রান করেন মাহমুদউল্লাহ

অধিনায়কের প্রথম কাজটা ভালোভাবেই করলেন। টসে জিতলেন। জেতার পর প্রথমে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েও কোনো প্রশ্ন ওঠার অবকাশ নেই। তা ভারত যতই আগের তিন ম্যাচেই তাড়া করে হেসেখেলে জিতুক না কেন! দুবার তো তাড়া করতে হয়েছে ২০০ রানেরও কম। আর এখানে এমন ব্যাটিং উইকেট, বড় একটা স্কোর করে ভারতকে চাপে ফেলার পরিকল্পনাই বুদ্মিমানের কাজ।

বাংলাদেশের উদ্বোধনী জুটির সময় তো তা আরও বেশি করে মনে হয়েছে। প্রথম তিন ম্যাচে ব্যর্থ তানজিদ এই ম্যাচে টিকে গেছেন মূলত আর কোনো বিকল্প না থাকাতেই। সেই সুযোগটা কী দারুণভাবেই কাজে লাগালেন এই তরুণ! ষোল বছর আগের এক বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে এক বাঁহাতি ওপেনারের স্ট্রোক ঝলমলে ৫১ রানের ইনিংস বাংলাদেশের ক্রিকেট রূপকথার অংশ হয়ে আছে। আরেকটি বিশ্বকাপ, আবারও প্রতিপক্ষ ভারত, বাংলাদেশের আরেক বাঁহাতি ওপেনারের ব্যাট থেকেও ঠিক ৫১ রানেরই দুর্দান্ত এক ইনিংস। ঘটনাচক্রে যাদের নামেও মিল আছে।

২০০৭ বিশ্বকাপে পোর্ট অব স্পেনে তামিম ইকবালের ওই বীরত্ব বেশি মনে আছে বাংলাদেশ ম্যাচটা জিতেছিল বলে। তামিম ডাকনামের তানজিদ হাসানের ৫১ যেখানে শুধুই তাঁর ব্যক্তিগত একটা তৃপ্তি হয়ে থাকছে।