বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে

হাথুরুসিংহেকে নিয়ে এখন কেন প্রশ্ন উঠবে

চন্ডিকা হাথুরুসিংহে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কোচ থাকবেন কি না—এই প্রশ্নটা এখন ওঠারই কথা নয়। পাকিস্তানে গিয়ে পাকিস্তানকে টেস্ট সিরিজে ধবলধোলাই করে মাত্রই দেশে ফিরেছে দল। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সেরা এই সাফল্যের পর তো আগামী ফেব্রুয়ারিতে মেয়াদ শেষ হওয়ার পর হাথুরুসিংহের সঙ্গে চুক্তি নবায়ন করা হবে কি না, এই আলোচনা হওয়ার কথা।

অথচ দুই সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে শুরু হতে যাওয়া বাংলাদেশের ভারত সফরে হাথুরুসিংহে থাকবেন কি থাকবেন না, এ নিয়েই নাকি ঘোর অনিশ্চয়তা। কারণ কী? কারণ জুলাইয়ের গণ–অভ্যুত্থানের পর নাটকীয়ভাবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি হয়ে যাওয়া ফারুক আহমেদের কোচ হাথুরুসিংহেকে নিয়ে প্রবল আপত্তি।

যে আপত্তির কথা বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে সামান্যতম আগ্রহ আছে, এমন কারোরই অজানা নয়। কারণ ২০১৬ সালে দুই স্তরের জগাখিচুড়ি নির্বাচনপদ্ধতির প্রতিবাদে প্রধান নির্বাচকের পদ থেকে পদত্যাগের পর ফারুক আহমেদ যত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, তার সবগুলোতেই কমন থেকেছে হাথুরুসিংহের প্রতি তাঁর বিরাগ। বোর্ড সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর যিনি জানিয়ে দিয়েছেন, হাথুরুসিংহেকে নিয়ে তিনি আগের অবস্থানেই আছেন।

নির্বাচকদের বলতে গেলে পুতুল বানিয়ে ফেলা নির্বাচনপদ্ধতির প্রতিবাদে ফারুক আহমেদের পদত্যাগ মানুষটাকে কিছুটা হলেও চিনিয়ে দেয়। আপত্তি তুলে কাজ না হওয়ার পর আপস করত রাজি হননি। প্রতিবাদে নিজেই সরে গেছেন। দুই স্তরের ওই নির্বাচনপদ্ধতি প্রবর্তনে হাথুরুসিংহেরও ভূমিকা থেকে থাকবে। কারণ এতে দল নির্বাচনে তাঁর সরাসরি ভূমিকা রাখার সুযোগ হয়েছিল। এটাকে হাথুরুসিংহের প্রতি ফারুকের বিরাগের একটা কারণ বলে অনুমান করা কঠিন কিছু নয়। হাথুরুসিংহের কোচিং পদ্ধতিও তাঁর অপছন্দ হতেই পারে। তবে সেটাই কি মেয়াদ শেষ হওয়ার ছয় মাস আগে হাথুরুসিংহেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট?

একজন কোচের চূড়ান্ত বিচার তো ‘বৃক্ষ তোমার নাম কী, ফলে পরিচয়’ প্রবাদটা দিয়ে। এখানে হাথুরুসিংহের ধারেকাছেও কেউ নেই। মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টে নিউজিল্যান্ডের জয় বাদ দিলে টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের বড় সব জয়ই হাথুরুসিংহের সময়ে।

বাংলাদেশের কোচ হিসেবে প্রথম মেয়াদে (২০১৪–২০১৭) হাথুরুসিংহে যেভাবে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন, তাতে আবারও তাঁকে ফিরিয়ে আনাটা অনেককেই বিস্মিত করেছিল। হাথুরুসিংহের ম্যান ম্যানেজমেন্ট নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। সিনিয়র ক্রিকেটারদের সঙ্গে তাঁর ঠোকাঠুকিও অজানা কোনো তথ্য নয়। এসব নিয়ে বড় বিতর্কও হয়েছে।

তবে বিতর্কিত সেসব সিদ্ধান্ত হাথুরুসিংহের ব্যক্তিগত পছন্দ–অপছন্দ থেকে নেওয়া নাকি বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভালোর কথা ভেবে—তা একটা প্রশ্ন বটে। ক্রিকেটারদের নিয়ে আবেগের প্রাবল্যে এই প্রশ্নটা নিয়ে বেশির ভাগ সময়ই কারও ভাবার সময় হয়নি।

ফারুক আহমেদ যদি মনে করেন, হাথুরুসিংহে কোচ থাকলে বাংলাদেশের ক্রিকেটের বড় ক্ষতি হয়ে যাবে, তাহলে তাঁর সেটি খুলে বলা উচিত।

এসব নিয়ে তর্ক–বিতর্ক থাকতে পারে, তবে একজন কোচের চূড়ান্ত বিচার তো ‘বৃক্ষ তোমার নাম কী, ফলে পরিচয়’ প্রবাদটা দিয়ে। এখানে হাথুরুসিংহের ধারেকাছেও কেউ নেই। মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টে নিউজিল্যান্ডের জয় বাদ দিলে টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের বড় সব জয়ই হাথুরুসিংহের সময়ে। ওয়ানডেতে সেরা সাফল্যও।

২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল ও ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনাল খেলা এখনো এই দুটি বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের সেরা সাফল্য হয়ে আছে। ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপে ব্যর্থতার দায় হাথুরুসিংহেকে দিলে ওই দুটি সাফল্যের কিছু কৃতিত্বও তাঁকে দিতে হবে। এসবকে যদি সুদূর অতীত বলে মনে হয়, টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স খেয়াল করে দেখুন।

পাকিস্তানকে টেস্ট সিরিজে ধবলধোলাই করাকে মানতে হবে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা সাফল্য বলে

পাকিস্তানে ঐতিহাসিক সিরিজ জয়ের স্মৃতি তো টাটকাই। আরেকটু পিছিয়ে গেলে দেখা যাবে, সর্বশেষ আট টেস্টের পাঁচটিতেই বাংলাদেশের জয়। উন্নতির গ্রাফটা খুব স্পষ্ট। এ বছরই আরও তিনটি বড় টেস্ট সিরিজ। ভারত থেকে ফেরার পর অক্টোবরে দক্ষিণ আফ্রিকাকে আতিথ্য দেবে বাংলাদেশ, নভেম্বরে যাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজে। উন্নতির ধারাটা অব্যাহত রাখার জন্য স্বাভাবিক বুদ্ধি তো বলবে, এখন দলটাতে পরিবর্তন না আনাই ভালো।

ও হ্যাঁ, হাথুরুসিংহের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ খুব শোনা যায়। স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ। যদিও সেটির দায় যত না তাঁর, তার চেয়ে বেশি ক্রিকেট বোর্ডের। জুলাই–বিপ্লবের পর বিদায় নেওয়া বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসানের বিসিবিতে চেইন অব কমান্ড বলতে কিছু ছিল না। রাষ্ট্রব্যবস্থার মতো এখানেও সবকিছু ছিল এককেন্দ্রিক। জাতীয় দলের কোচের প্রাথমিক জবাবদিহি থাকার কথা ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের কাছে; কিন্তু হাথুরুসিংহে সবকিছু নিয়েই সরাসরি চলে যেতেন বোর্ড সভাপতির দরবারে। নাজমুল হাসান এটি খুব উপভোগ করতেন, এমন করতে উৎসাহিতও করতেন। হাথুরু তাহলে কেন অন্য কাউকে পাত্তা দেবেন? এটা এমন কোনো বড় সমস্যা নয়, নতুন বিসিবি সভাপতিও এমন কিছু না করলেই তো হয়।

ফারুক আহমেদ যদি মনে করেন, হাথুরুসিংহে কোচ থাকলে বাংলাদেশের ক্রিকেটের বড় ক্ষতি হয়ে যাবে, তাহলে তাঁর সেটি খুলে বলা উচিত। নইলে পাকিস্তানে এই সাফল্যের পর হাথুরুসিংহেকে বিদায় করে দিলে এই সিদ্ধান্তে ব্যক্তিগত রাগ–অনুরাগের ভূমিকা আছে কি না, এই প্রশ্ন উঠবেই।

বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদ

দলে ফিরতে উন্মুখ এক সাবেক অধিনায়কের চাওয়ার সঙ্গেও কেউ এটিকে মিলিয়ে নিতে পারেন। কারণ সাধারণ ক্রিকেট বুদ্ধি বলে, হাথুরুসিংহের সঙ্গে চুক্তি শেষ হতে যেহেতু আর মাস ছয়েকই বাকি, এই সময়ের মধ্যে নতুন কোচ খুঁজে তাঁর সঙ্গে চুক্তি নবায়ন না করলেই তো হয়। কোচ ছাঁটাইয়ের ব্যাপারে এমনিতেই বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশের একটা দুর্নাম আছে। হাথুরুসিংহের দুই পূর্বসূরি রাসেল ডমিঙ্গো ও স্টিভ রোডসকে কেন চলে যেতে হয়েছিল, এটি যেমন এখনো পরিষ্কার নয়। ডমিঙ্গো পদত্যাগ করেছিলেন সত্যি, তবে তা করেছিলেন বিসিবি তাঁকে রাখবে না বুঝতে পেরেই।

কোচ আসবে, কোচ যাবে—এটাই নিয়ম। তবে পাকিস্তানে এই সাফল্যের পর চন্ডিকা হাথুরুসিংহেকে বিদায় করে দিলে ক্রিকেট–বিশ্বের কাছেই তা হবে বড় চমক। পাকিস্তানে গিয়ে পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করে আসার চেয়েও বড়।