ট্রাভিস হেড উল্টোমুখো হয়ে বলের পিছু ছুটছিলেন। টইটম্বুর গ্যালারির কি তখন দম বন্ধ হয়ে এসেছিল? ৩১ বলে ৪৭ রানে ছুটছিলেন রোহিত শর্মা, গতকাল সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া প্রতিশ্রুতিটুকু স্পষ্ট হয়ে কেবল ফুটতে শুরু করেছিল।
ভারত অধিনায়ক বলেছিলেন, টুর্নামেন্টজুড়ে যেভাবে খেলে এসেছেন, সেভাবেই খেলবেন। ৩ ছক্কা ও ৪ চারের ইনিংসে কথা রাখার ছাপ থাকলেও কপাল পক্ষে ছিল না। নইলে হেড যে ক্যাচটা নিয়েছেন, সেটি বেশির ভাগেরই ধরতে না পারার কথা। ক্যাচটা তালুবন্দী করার পর নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে নীরবতা ভর করেছিল। সেটুকু অনুচ্চারে আসলে শূন্যতা।
৩৬ বছর বয়সী রোহিতকে পরের বিশ্বকাপে না দেখার সম্ভাবনাই বেশি। ভারত যদি আজ ফাইনাল জেতেও এবং সেই উৎসবের মধ্যে হুট করে এই কথাটা কারও কারও মনে পড়তে পারে। তখনো কিন্তু অনুভূতিটা পাল্টাবে না। শচীন টেন্ডুলকার যাওয়ার পর বিরাট কোহলি নতুন দিনের গান শোনালেও টেন্ডুলকারের শূন্যতা তো চিরকালীন। মঞ্চ যেটাই হোক, রোহিতকে আর দেখা না গেলে ঠিক তেমনই কি লাগবে না!
মাসল-ক্রিকেটের এই যুগে ব্যাটিংয়ে চূড়ান্ত আভিজাত্যটুকু যে তাঁর কাছ থেকেই দেখা যায়। ওয়ানডের সেরা টুর্নামেন্টে আজ সেই আভিজাত্যের শেষটুকুই সম্ভবত দেখা গেল। তার আগে রোহিত যেসব চূড়া রেখে গেলেন, সেদিকে একবার তাকানো যায়।
বিশ্বকাপের এক আসরে এত দিন অধিনায়ক হিসেবে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড ছিল কেইন উইলিয়ামসনের। ২০১৯ বিশ্বকাপে ৯ ইনিংসে ৫৭৮ রান করেছিলেন উইলিয়ামসন। রোহিত আজ ৪৭ রানের ইনিংসে রেকর্ডটি টপকে যান। ব্যক্তিগত ২৬ রানে মিচেল স্টার্ককে লং অন দিয়ে ছক্কা মেরে পেছনে ফেলেন উইলিয়ামসনকে। ওই শটটিও যেন রোহিত-সুলভ, সে (৫ম) ওভারেই তিন বল আগে উইকেট পড়েছিল। হ্যাঁ, পাঞ্চের জবাবে কাউন্টার-পাঞ্চ, আর সেটি সবার সামনে দাঁড়িয়ে বুক চিতিয়ে করে যাচ্ছিলেন ভারতের অধিনায়ক। আউট হওয়ার পর অবশ্য একটি আক্ষেপ থাকতে পারে তাঁর। আর তিনটি রান করলেই বিশ্বকাপে অধিনায়ক হিসেবে ছয় শ রানের মাইলফলকের দেখা পেতেন।
১১ ইনিংসে ৫৪.২৭ গড়ে ১২৫.৯৪ স্ট্রাইক রেটে এই বিশ্বকাপে ৫৯৭ রান করলেন রোহিত। বিশ্বকাপে অধিনায়ক হিসেবে এক আসরে যা সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। তাঁর পেছনে পড়া নামগুলোতে একবার তাকাতে পারেন—রিকি পন্টিং, স্টিভ ওয়াহ, সৌরভ গাঙ্গুলী, গ্রায়েম স্মিথ, মার্টিন ক্রো, ভিভ রিচার্ডস! চার বছর পর যে বিশ্বকাপটা আসবে, তখন রোহিতকে না দেখলে কারও শূন্য শূন্য লাগবে না, সে কথা তাই বলা যায় না।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ছবি ভাসছে। ভারতের অনুশীলনে মাঠের এক কোণে রোহিতের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে বিজয়সূচক ‘ভি’ চিহ্ন দেখাচ্ছেন কৃঞ্চমাচারি শ্রীকান্ত। অর্থাৎ দল যেভাবে খেলছে, রোহিত যেভাবে খেলছেন এবং নেতৃত্ব দিচ্ছেন—এসব কিছুতেই শ্রীকান্ত সন্তুষ্ট তা ভেবেই নেওয়া যায়। ভারতের সাবেক এই ব্যাটসম্যান ২০১১ বিশ্বকাপের আগে বিসিসিআইয়ের প্রধান নির্বাচক ছিলেন। সেই বিশ্বকাপে ভারতের হয়ে রোহিতের খেলা হয়নি। তাই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদও পাননি।
গুঞ্জন আছে, শ্রীকান্তসহ অন্যান্য নির্বাচকেরা রোহিতকে দলে রাখলেও মহেন্দ্র সিং ধোনি পীযুষ চাওলাকে চেয়েছিলেন। ভারত সেবার বিশ্বকাপ জেতায় তা নিয়ে আর কথা হয়নি। কিন্তু রোহিতের যে বিশ্বকাপ নিয়ে মনে মনে তখন থেকেই একটা মিশন ছিল, সেটিও বোঝা যায় পরিসংখ্যানে তাকিয়ে।
২০১৫ বিশ্বকাপে ৪৭.১৪ গড়ে করেছিলেন ৩৩০ রান। সর্বশেষ বিশ্বকাপে তো আরও ভয়ংকর। ৮১.০০ গড়ে ৬৮৪ রান। আর এবার? বলতে পারেন গতবারের মতো এত রান পাননি। কিন্তু এই ৫৯৭ রানের প্রতিটিতে রোহিতের বিশ্বকাপ জয়ের মনোবাঞ্ছা লেখা। নইলে ব্যাটিং অ্যাপ্রোচে নিজেকে এভাবে পাল্টাতেন না।
এমনিতে ওপেনিংয়ে রোহিতের শুরুটা হয় একটু ধীরে। হাত খুলতে শুরু করেন একটু ধাতস্থ হয়ে। কিন্তু এবার বিশ্বকাপে পাওয়ারপ্লেতে তাঁর ব্যাটিং দেখুন—১৩৫ স্ট্রাইক রেটে ৪০১ রান। রোহিতের ওয়ানডে ক্যারিয়ার স্ট্রাইক রেট ৯১.৮১। কিন্তু পাওয়ারপ্লেতে সেটাই টেনে তুলেছেন তাঁর টি-টোয়েন্টি (১৩৯.২৪) স্ট্রাইক রেটের কাছাকাছি।
বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ছক্কার রেকর্ডও এবার ভেঙেছেন। বিশ্বকাপ জিততে রোহিত আসলে নিজেকেই এভাবে ভেঙেচুরে গড়ে এই টুর্নামেন্টে আজ সম্ভবত শেষটা দিয়ে গেলেন—হেড ক্যাচটা নেওয়ার পর গ্যালারিতে কারও কারও সম্ভবত এই কথাটা মনে পড়েছিল।
সে জন্যই নীরবতা।