‘মিউজিক্যাল চেয়ার’ খেলা নিশ্চয়ই দেখেছেন। ক্যাসেট প্লেয়ারে মিউজিক শুরু হওয়ামাত্র বৃত্তাকারে সাজানো চেয়ারের পাশে পাশে চরম টেনশন নিয়ে গুটি গুটি পায়ে দৌড়াতে থাকেন প্রতিযোগীরা। এই বুঝি মিউজিক বন্ধ হয়ে গেল! বন্ধ হওয়ামাত্র বসে যেতে হবে সবচেয়ে কাছের চেয়ারটাতে। যে খেলোয়াড় চেয়ারে বসতে পারবেন না, তিনি প্রতিযোগিতা থেকে ‘আউট’।
বাংলাদেশ দলের অধিনায়কত্বটাও কয়েক বছর ধরে ‘মিউজিক্যাল চেয়ার’ খেলার মতো হয়ে গেছে। পার্থক্য হলো, এই খেলায় ক্যাসেট প্লেয়ারের পাওয়ার অন-অফ করাটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিসিবির হাতে থাকে না। সেটি থাকে খেলোয়াড়দেরই (পড়ুন অধিনায়কদের) হাতে। তাঁরাই তাঁদের সুবিধামতো মিউজিক বন্ধ করে চেয়ারে বসে পড়েন, আবার মিউজিক চালিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে যান। অধিনায়কের খালি চেয়ারে তখন পারলে জোর করেই কাউকে বসিয়ে দিতে হয় বিসিবিকে।
গত দেড়-দুই বছরে এমন অনেকবারই হয়েছে যে অধিনায়কদের চোট, ছুটি কিংবা হুট করে খেলাই ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণায় সিরিজের ঠিক আগে এমনকি মাঝপথেও নতুন অধিনায়ক খুঁজে নিতে হয়েছে বিসিবিকে। এ রকম পরিস্থিতি হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণেই। আর তাতে লিটন দাস কখনো সহ-অধিনায়ক থেকে কিংবা কখনো হঠাৎ করেই পেয়ে গেছেন নেতৃত্ব। হঠাৎ ‘ভারপ্রাপ্ত’ হয়েছেন মেহেদী হাসান মিরাজ। আবার আস্থা রাখতে হয়েছে নাজমুল হোসেনের ওপরও।
অধিনায়কদের আয়োজিত এই ‘মিউজিক্যাল চেয়ার’ খেলার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় অবশ্য একটা সুবিধাও হয়েছে। পরিস্থিতির কারণে হলেও ভবিষ্যতের সম্ভাব্য অধিনায়কদের দেখে নিতে পারছে বিসিবি। লিটনের ব্যাপারে যেমন এভাবেই বিসিবি মোটামুটি একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছে যে অধিনায়কত্বের চাপে না ফেললেই হয়তো তিনি ব্যাটিংটা ভালো করবেন। খেলার মাঠে সবকিছুতেই জান-প্রাণ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া মিরাজ অবশ্য এখনো আছেন কোনো না কোনো সংস্করণের সম্ভাব্য অধিনায়কের তালিকায়।
তবে আপৎকালীন অধিনায়ক হিসেবে এখন পর্যন্ত যিনি সবচেয়ে বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছেন, তিনি নাজমুল হোসেন। সিলেটে খেলে আসা নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ টেস্টে অধিনায়ক নাজমুল দেখিয়ে দিয়েছেন, সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার কাজে তিনি কত অসাধারণ। নিজে পারফর্ম করেন, দলকে দিয়েও পারফর্ম করান। মাঠে বোলিং পরিবর্তন, ফিল্ডিং সাজানো এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সাহসী মানিসকতার পরিচয় তিনি দিয়েছেন টেস্ট অধিনায়কত্বের অভিষেকেই। তাঁর নেতৃত্বেই বাংলাদেশ পেয়েছে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৫০ রানের বড় জয়।
মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে কাল থেকে শুরু দ্বিতীয় টেস্টের আগে আজ সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে কথা বলেছেন অনেক কিছু নিয়েই। তার মধ্যে অধিনায়ক নাজমুলের প্রসঙ্গ বিশেষ দ্রষ্টব্য হয়ে থাকছে। কারণ, কোচের কাছ থেকে নেতা হিসেবে তিনি লেটার মার্ক তো পেয়েছেনই, পেয়ে গেছেন ভবিষ্যৎ অধিনায়কের সনদও।
নাজমুলকে প্রশংসায় ভাসিয়ে হাথুরুসিংহে বলেন, ‘অধিনায়কত্ব আর নেতৃত্ব দুটো ভিন্ন বিষয়। তার অধিনায়কত্ব ছিল অসাধারণ। ট্যাকটিক্যালি সে সঠিক ছিল। বেশির ভাগ সময়ই তার চিন্তা ছিল ম্যাচের পরিস্থিতি থেকে এগোনো। ফিল্ডিং সাজানোও ছিল দুর্দান্ত। কিছুটা গতানুগতিকতার বাইরে, কিন্তু দারুণ কার্যকর।’
এ তো গেল মাঠে করা অধিনায়কত্বের প্রশংসা। নাজমুলের দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার ধরন, মাঠের অধিনায়কত্ব যেটার একটা অংশমাত্র, কোচ সে ব্যাপারেও ‘অসাধারণ’ শব্টাই উচ্চারণ করেছেন। নিজে ভালো খেলে দলকে পথ দেখানোটা আলাদা করেই চোখে পড়েছে কোচের, ‘নিজের পারফরম্যান্স দিয়ে সে সামনে থেকে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছে। পারফরম্যান্স দিয়েই সে সবার সম্মান আদায় করে নিয়েছে এবং খেলার সেই মান অন্যদের কাছেও দাবি করতে পেরেছে।’
বাংলাদেশ দলের ভবিষ্যৎ অধিনায়ক খুঁজতে বিসিবি যে অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, হাথুরুসিংহের কথায় মনে হয়েছে, সেটারই আশা–জাগানিয়া সমাপ্তি ঘোষণা করতে যাচ্ছেন নাজমুল, ‘আমি মনে করি ওর সামনে দীর্ঘ ভবিষ্যৎ পড়ে আছে। তাকে (নাজমুল) অধিনায়ক করার সিদ্ধান্ত বোর্ডের। সময় এলে তারাই সিদ্ধান্তটা নেবে। তবে নিশ্চিতভাবেই সে এই পদের জন্য শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী।’
অধিনায়কত্বের ‘মিউজিক্যাল চেয়ার’ খেলাটা কি তাহলে অদূর ভবিষ্যতে লম্বা সময়ের জন্যই বন্ধ হতে চলেছে!