১৯৩২–৩৩ বডিলাইন সিরিজের পর অ্যাশেজের উত্তাপ সম্ভবত এতটা ছড়ায়নি, যতটা এবার ছড়াচ্ছে।
লর্ডস টেস্টে ব্যাটসম্যানদের শরীর তাক করে বাউন্সারের পর বাউন্সার মারা হয়েছে। বিতর্ক হয়েছে মিচেল স্টার্কের ক্যাচকে বৈধতা না দেওয়া নিয়ে। তবে রোমাঞ্চকর শেষ দিনে জনি বেয়ারস্টোর আউট নিয়ে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে, সেটা যেন থামার নয়।
অনেকে ইংল্যান্ডের পক্ষ নিয়ে বেয়ারস্টোর আউকে ক্রিকেটীয় চেতনার পরিপন্থী বলছেন, অনেকে আবার অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে সাফাই গেয়ে বেয়ারস্টোর অসতর্কতাকে দুষছেন। দুই দলের কোচ, অধিনায়ক ও ক্রিকেটের আইন প্রণয়নকারী সংস্থার মেরিলেবোন ক্রিকেট ক্লাবের (এমসিসি) সদস্যরা এ ঘটনার সঙ্গে নিজেদের জড়িয়েছেন। ডেভিড ওয়ার্নার ও উসমান খাজার সঙ্গে ঝামেলার জেরে এমসিসির তিন সদস্য নিষিদ্ধও হয়েছেন। জল এত দূর গড়ানোয় ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা চুপ থাকতে পারেননি। এমনকি দেশ দুটির প্রধানমন্ত্রীও বাগ্যুদ্ধে জড়িয়েছেন।
বিতর্কের রেশ থাকতেই এবার বেয়ারস্টোর আউট নিয়ে নিজের অভিমত জানালেন সাবেক আম্পায়ার সাইমন টফেল। রেকর্ড পাঁচবারের আইসিসি বর্ষসেরা আম্পায়ারের স্বীকৃতি পাওয়া টফেলের মতে, বেয়ারস্টোকে আউট দেওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল।
বেয়ারস্টোর আউট নিয়ে একে একে সবাই যেহেতু মুখ খুলেছেন, ওই আউটটি তাই আরেকবার মনে করিয়ে দেওয়া যাক। অস্ট্রেলিয়ার দেওয়া ৩৭১ রান তাড়া করতে নামা ইংল্যান্ড ৫ উইকেটে ১৯৩ রান তুলে ফেলার পর ওই ঘটনার সূত্রপাত।
ক্যামেরন গ্রিন ওভারের শেষ বলটা বাউন্সার মেরেছিলেন। সেটা ‘ডাক’ করে সঙ্গে সঙ্গে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন বেয়ারস্টো। ওভারের শেষ বল হওয়ায় ইংলিশ উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান ভেবেছিলেন বলটা ‘ডেড’ হয়ে গেছে।
তবে বেয়ারস্টোকে ক্রিজ ছেড়ে বেরোতে দেখেই ‘আন্ডারআর্ম’ থ্রোতে স্টাম্প ভাঙেন অস্ট্রেলিয়ার উইকেটকিপার অ্যালেক্স ক্যারি। অস্ট্রেলিয়ানরা আউটের আবেদন জানালে মাঠের দুই আম্পায়ার এহসান রাজা ও ক্রিস গ্যাফানি তৃতীয় আম্পায়ার মারাইস এরাসমাসের সহায়তা চান। এরাসমাস বেশ কিছুটা সময় নিয়ে টিভি রিপ্লে দেখার পর বেয়ারস্টোরকে আউট দিলে শুরু হয় বিতর্ক।
ম্যাচটা ইংল্যান্ড ৪৩ রানে হেরে অ্যাশেজে ২–০ ব্যবধানে পিছিয়ে পড়ায় বিতর্কের মাত্রা আরও বাড়ে। ম্যাচ শেষেই ইংলিশ অধিনায়ক বেন স্টোকস বলেন, ‘আমি কি ওইভাবে (অস্ট্রেলিয়ানদের মতো) ম্যাচ জিততে চাইতাম? আমার উত্তর হচ্ছে “না”।’
বেয়ারস্টোকে আউট দেওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল কি না, সে ব্যাপারে অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় সম্প্রচারমাধ্যম এবিসির সিডনি মর্নিংস অনুষ্ঠানে এক আলোচনায় নিজের মত তুলে ধরেছেন ৫২ বছর বয়সী টফেল, ‘ওরা (ইংল্যান্ড) এটা পছন্দ করেনি। তবে টিভি আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। একটা বল বা ওভার তখনই ডেড বিবেচিত হবে, যখন দুই দলই মনে করবে সেটা আর খেলার মধ্যে নেই। পরিষ্কার বোঝা গেছে, ফিল্ডিং দল বলকে ডেড ভাবেনি।’
পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম লিংকডইনেও ওই আউট নিয়ে দীর্ঘ অভিমত তুলে ধরেছেন টফেল। লিখেছেন, আমার কাছে বারবার একটা প্রশ্ন আসছে। তাই আমার মনে হয়েছে এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে আলোচনা হওয়া উচিত। সবার কাছে আমার আটটি জিজ্ঞাসা আছে—
❑ আপনি কি কোনো আম্পায়ারকে বলতে দেখেছেন, উইকেটরক্ষক স্টাম্প থেকে বেশ পেছনে দাঁড়িয়ে থাকলে স্টাম্পিং করতে পারবে না?
❑ প্রথম ইনিংসে বেয়ারস্টো নিজেই যখন মারসানকে (লাবুশেনকে) একইভাবে স্টাম্পিং করার চেষ্টা করেছিল, তখন কেউ কি অভিযোগ করেছিল?
❑ নিজের আউট নিয়ে বেয়ারস্টো কি কিছু বলেছে? সে একদম চুপ ছিল। কেন?
❑ আমার অভিজ্ঞতা বলে, যখন কেউ ক্রিকেটের আইনের অধীনে কোনো আউট পছন্দ করে না, তখন নিজেদের যুক্তি দাঁড় করাতে ক্রিকেটীয় চেতনার কথা তোলে।
❑ ফিল্ডিং দল (অস্ট্রেলিয়া) ক্রিকেটীয় চেতনার কোন ধারা লঙ্ঘন করেছে?
❑ ফিল্ডিং দল কি অন্যায়ভাবে ব্যাটারের সামর্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে তাকে আউট করার চেষ্টা করেছিল? কেউ কি ব্যাটারকে ধাক্কা মেরেছিল, বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছিল অথবা ক্রিজে ঢুকতে বাধা দিয়েছিল?
❑ আইন অনুযায়ী ব্যাটার নিজের অবহেলার কারণে (আম্পায়ার ওভারের সমাপ্তি ঘোষণা করার আগেই ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে আসা) আউট হলে তাকে কি দায়মুক্তি দেওয়া যায়?
❑ আম্পায়ারদের সিদ্ধান্ত ও আইন অনুযায়ী স্টার্কের ক্যাচকে বৈধতা না দেওয়ার পর ইংল্যান্ড কি বেন ডাকেটকে চলে আসতে বলেছিল?
টফেল তাঁর লেখার শেষটা করেছেন এভাবে, ‘কিছু মানুষ এবং গোষ্ঠীর ভণ্ডামি ও ধারাবাহিকতার অভাব খেলাটির ভবিষ্যতের জন্য উদ্বেগজনক। হয়তো এখানে আমি উদ্ভট কথাবার্তা বলে ফেললাম। তবে ভালো খবর হলো আমরা সক্রিয়ভাবে টেস্ট ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িত, খেলাটার সেরা সংস্করণের সঙ্গেই।’