২০১৭ সালে চন্ডিকা হাথুরুসিংহে কোচ থাকার সময়ই টি–টোয়েন্টি থেকে অবসর নিতে হয় তাঁকে। সেই সিদ্ধান্তে কি হাথুরুসিংহের হাত ছিল? মাশরাফি বিন মুর্তজা রহস্য রেখে দেন। সে বছরই বিতর্কের জন্ম দিয়ে চলে যাওয়া শ্রীলঙ্কান এই কোচকে আবারও জাতীয় দলের দায়িত্বে ফেরানোর সিদ্ধান্ত তাঁর চোখে বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য ‘অমর্যাদার’। প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ দলের সাবেক অধিনায়ক কথা বলেছেন হাথুরুসিংহের ‘দ্বিতীয় ইনিংসের’ চ্যালেঞ্জ আর সম্ভাবনা নিয়েও—
আবারও বাংলাদেশ দলের কোচের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে চন্ডিকা হাথুরুসিংহেকে। তাঁকে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্তকে কীভাবে দেখছেন?
মাশরাফি বিন মুর্তজা: টেস্ট খেলুড়ে দেশ হিসেবে আমাদের মর্যাদার জায়গা থেকে অবশ্যই এটা ভালো উদাহরণ নয়। এর আগে জেমি সিডন্সকেও আনা হয়েছে। টেকনিক্যাল ও ট্যাকটিক্যাল দিক দিয়ে এ দুজন কোচই আমার দেখা অন্যতম সেরা। এদিক দিয়ে হয়তো বোর্ড হাথুরুসিংহেকে আনাটা ভালো মনে করেছে। আবার কোচ–সংকটও আছে। এখন ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট এত বেশি, কোচই খুঁজে পাওয়া যায় না। সেদিক দিয়ে বিসিবির সিদ্ধান্ত ঠিকই আছে।
আগেরবার চুক্তির মাঝপথে চাকরি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন হাথুরুসিংহে। বিসিবির অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও ফিরে আসেননি। সেই তাঁর কাছেই আবার ফিরে যাওয়া আসলে কী বার্তা দেয়?
মাশরাফি: সেটাই বলছি। যদি তিনি ভালোভাবে যেতেন, যেভাবে জেমি সিডন্স গিয়েছিলেন, তাহলে কোনো সমস্যা ছিল না। সিডন্স কিন্তু ওই সময় ব্যাটিং কোচ হিসেবে হলেও বাংলাদেশে থেকে যেতে চেয়েছিলেন। সে জন্যই সিডন্সের ফেরা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু হাথুরুসিংহে চুক্তির মাঝপথে চলে যান। আমাদের বোর্ড সভাপতির ফোনও তিনি ধরেননি। এসএমএসের রিপ্লাই দেননি। হুট করে চলে গেলেন। এখানে তো মানসম্মানের একটা বিষয়ও থাকে।
ও রকম ঘটনার পরও যখন হাথুরুসিংহে আবার প্রধান কোচ হয়ে আসছেন, তাঁর ওপর বিসিবির কতটা কর্তৃত্ব থাকবে বলে মনে হয়?
মাশরাফি: এটা নির্ভর করছে তাঁর সঙ্গে বিসিবি কীভাবে কথা বলেছে, চুক্তির শর্ত কী; এসবের ওপর। এসব তো আমরা জানি না। তাঁকে কি সেধে আনা হচ্ছে, জোর করে আনা হচ্ছে, নাকি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে—একেকটা কিন্তু একেক রকম। বিষয়টা নির্ভর করছে বিসিবি তাঁকে কীভাবে আনছে এবং তিনি কীভাবে সবকিছু সামলান, তার ওপর। তবে সবকিছুর পরও একটা বড় কিন্তু থেকে যায়। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, ড্রেসিংরুম তাঁকে কীভাবে নেবে?
এই প্রশ্ন কেন আসছে?
মাশরাফি: অন্য কে কী ভাবল, তাতে আসলে কিছুই যায়–আসে না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বাংলাদেশ দলের ড্রেসিংরুম তাঁর সঙ্গে কতটা সাবলীল থাকবে বা তিনি সেখানে কতটা সাবলীল থাকবেন। দু–চারজন নতুন খেলোয়াড় বাদ দিলে আগের খেলোয়াড়েরা তো বেশির ভাগই এখনো ড্রেসিংরুমে আছে। তাদের সঙ্গে কোচের আচরণ কেমন হবে, তিনি কি আগের সব ভুলে যাবেন, বা যদি আবারও আগের মতো আচরণ করেন, তখন খেলোয়াড়দের প্রতিক্রিয়া কী রকম হয়, এগুলোও দেখতে হবে।
তবে হাথুরুসিংহে যেহেতু একজন আন্তর্জাতিক কোচ, তিনি নিশ্চয়ই সব ভালোভাবে সামলে নেবেন। সেটা যত তাড়াতাড়ি করবেন ততই ভালো।
হাথুরুসিংহের আগের পর্বে ড্রেসিংরুমের পরিবেশ কেমন ছিল?
মাশরাফি: খারাপ কিছু থাকলেও সব ঠিক ছিলই বলতে হবে, কারণ তিনি রেজাল্ট পেয়েছেন। খেলোয়াড়দের শৃঙ্খলার মধ্যে রাখার ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন, এর দরকার ছিল। এ ছাড়া তাঁর একটা টেকটিক্যাল সিদ্ধান্ত ছিল, দল যাকে যেখানে প্রয়োজন মনে করবে তাঁকে সেখানে খেলতে হবে। বোলিংয়েও যাকে যেখানে প্রয়োজন তাকে সেখানে কাজে লাগাতে চাপ দেওয়া—এই সিদ্ধান্তগুলো তাঁর ভালো ছিল। এর ফলও পেয়েছি আমরা। আশা করি, এবারও তিনি সে রকম কিছু করতে পারবেন।
ক্রিকেটারদের একটা অভিযোগ ছিল যে আচার–আচরণে হাথুরুসিংহে খুব রূঢ়…
মাশরাফি: বাংলাদেশি সংস্কৃতিতে একটু রূঢ় হওয়া কিন্তু খারাপ নয়। আমরা যতই আন্তর্জাতিক দল হই, আমার মনে হয় বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে একটু রূঢ় হওয়ার দরকার আছে। আমাদের সংস্কৃতিটাই ও রকম, আমরা শক্তের ভক্ত নরমের যম। সেদিক দিয়ে কোচ একটু কঠিন হলে সেটাকে আমি খারাপ বলব না, বিশেষ করে শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে।
কেউ ভালো রান করছে বা দলে ভালো একজন বোলার আছে, শুধু এসব দিয়ে একটা দল দাঁড়ায় না। শচীন টেন্ডুলকারের মতো বড় খেলোয়াড় তো এখনো বাংলাদেশ দলে নেই। বুমরার মতো বোলার তৈরি হয়নি, বিরাট কোহলির মতোও কেউ নেই। তারপরও দলটাকে তো দাঁড় করাতে হবে। দল হিসেবে দাঁড়াতে হলে দলের পরিবেশও সে রকম হতে হয়। হাথুরুসিংহে যদি সে পরিবেশটা ফিরিয়ে আনতে পারেন, তাতে দলের জন্য ভালোই হবে।
হাথুরুসিংহের প্রথম পর্বে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। শ্রীলঙ্কায় শততম টেস্ট থেকে মাহমুদউল্লাহকে বাদ দেওয়া এবং এরপর ওয়ানডে সিরিজ থেকেও তাঁকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা, মুমিনুল হককে শুধু টেস্টে খেলোয়াড় বানিয়ে দেওয়া—এসব কি তাঁর একার সিদ্ধান্ত ছিল নাকি দলীয় সিদ্ধান্ত?
মাশরাফি: কার সিদ্ধান্ত ছিল, সেটা তো বলতে পারব না। তবে অধিনায়ক হিসেবে আমি বলেছিলাম, মাহমুদউল্লাহকে আমার দরকার। কারণ, দিন শেষে তো অধিনায়কই মাঠে খেলোয়াড়দের নিয়ে নামবে। এখানে অধিনায়ককেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হয়। আমিও তা–ই নিয়েছিলাম। তাতে আমারও ক্ষতি হয়ে থাকতে পারে। কারণ, সেই সিরিজেই কিন্তু আমাকে টি–টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে অবসর নিতে হয়েছিল (হাসি)।
আপনার টি–টোয়েন্টি ছাড়ার সিদ্ধান্তে হাথুরুসিংহের ভূমিকা থাকার কথাটা তাহলে ঠিক...
মাশরাফি: ভূমিকা ছিল না, তা আপনি কীভাবে বলবেন? আমার সঙ্গে তো এ নিয়ে আলোচনা হয়নি। বিসিবি থেকেও আমাকে কোনো আভাস দেয়নি। ওয়ানডে সিরিজের পর হুট করে টি–টোয়েন্টি সিরিজে…ওই কথায় আর না–ইবা গেলাম।
বিষয়টা হলো অধিনায়ককে তার ভূমিকা পালন করতেই হবে। কোচ যেটা চাইবেন, সেটাই সব সময় ঠিক হতে পারে না। অধিনায়ক যদি তার অবস্থানটা না নেয়, সে যদি ভাবে আমার জায়গা ঠিক থাকলেই সব ঠিক, তাহলে অন্য খেলোয়াড়েরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকবে। কোচ–অধিনায়কের সমন্বয় ভালো হলেই দল ভালো হয়।
বর্তমানে সাকিব টেস্ট এবং টি–টোয়েন্টির অধিনায়ক। তামিম আছেন ওয়ানডে দলের নেতৃত্বে। তাঁদের সঙ্গে হাথুরুসিংহের বোঝাপড়া কেমন হবে?
মাশরাফি: আমি যতটুকু বুঝি, তামিম ও সাকিবের সঙ্গে তাঁর কোনো সমন্বয়হীনতা তৈরি হওয়ার কথা নয়। তামিমের সঙ্গে হাথুরুসিংহের ভালো সম্পর্ক। সাকিবের সঙ্গে আগে–পরে কিছু ঘটনা থাকলেও সাকিব দিন শেষে বাংলাদেশের সেরা খেলোয়াড়। তাঁর সঙ্গেও হাথুরুসিংহের সমন্বয় না হওয়ার কোনো কারণ দেখি না। তা ছাড়া আগে কাজ করায় বাংলাদেশের সংস্কৃতিটাও এখন হাথুরুসিংহের জানা। আমার বিশ্বাস, তিনিও তাঁর জায়গা থেকে যতটুকু করার করবেন।
আগেরবার দল নির্বাচনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন হাথুরুসিংহে। এ নিয়ে অনেক বিতর্কও হয়েছে। এবারও কি তাঁর সেভাবেই থাকা উচিত বলে মনে করেন?
মাশরাফি: দল নির্বাচনের সঙ্গে কোচ–অধিনায়কের একটা সম্পৃক্ততা থাকেই। কিছু আলোচনা, কিছু সিদ্ধান্তে তাদের মতামত নিতে হয়। কিন্তু এটা যদি লিখিতভাবেই থাকে যে কোচ নির্বাচক প্যানেলে থাকবেন, যেটা আগেরবার ছিল, তখন কোচও নির্বাচক হয়ে যান। এতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভালো হয় না, আবার অনেক সময় ভালোও হয়।
হাথুরুসিংহের ভূমিকা এবার কী হবে, সেটা নির্ভর করছে পাপন ভাইয়ের (বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান) সঙ্গে তাঁর আলোচনার ওপর। তবে আমার মনে হয়, হাথুরুসিংহে এবার আরও বেশি শক্তিশালী হয়েই আসছেন।
সে রকম হলে কি বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য ভালো হবে?
মাশরাফি: এটা নির্ভর করছে বিসিবি কতটা লাগাম ধরতে পারে, তার ওপর। কিছু আলোচনা তো দলের মধ্যে আছে। পত্রপত্রিকায় সমালোচনা হয়। সেসব থামানোর জন্য হাথুরুসিংহেই সঠিক লোক। যদি হাথুরুসিংহে আগের মতোই থাকেন, তাহলে উপকার হতেও পারে। কারণ, তাঁর মধ্যে একটা ব্যাপার ছিল—দলের ঊর্ধ্বে কেউ নয়।
বাংলাদেশের কোচ হিসেবে দ্বিতীয় ইনিংসে হাথুরুসিংহের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী হবে?
মাশরাফি: আমাদের দল এখন ওয়ানডে ভালো খেলছে। সামনে আমাদের মূল লক্ষ্য ২০২৩ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপ। এ বিশ্বকাপ সামনে রেখে খেলোয়াড়দের মধ্য সমন্বয় তৈরি করাই হবে কোচের মূল কাজ এবং সেটা হাথুরুসিংহেরই ভালো পারার কথা।
কিন্তু আগেরবার বাংলাদেশের ক্রিকেটের সেরা দলটা ছিল তাঁর সঙ্গে। এখন তো অবস্থা সে রকম নয়…
মাশরাফি: আমি তা মনে করি না। এখনো দলে অনেক পারফরমার আছে। লিটন পারফর্ম করছে, তাসকিন–মিরাজ ভালো খেলছে। পেস বোলিংয়েও অপশন অনেক। আগে এত অপশন ছিল না। এখন আরও ভালো অবস্থা সব মিলিয়ে।
তামিম এখনো ভালো খেলছে, সাকিব ১ নম্বর অলরাউন্ডার, মুশফিক তো শুধু টি–টোয়েন্টি থেকে অবসর নিয়েছে। মাহমুদউল্লাহও ওয়ানডে খেলছে। সঙ্গে যোগ হচ্ছে অন্যরা। আগেরবারের চেয়ে এখন আরও ভালো দলই পাচ্ছেন হাথুরুসিংহে। এটাকে কীভাবে সমন্বয় করে তিনি সামনে এগোবেন, সেটাই বড় ব্যাপার।