শুরুটা ভালো করলেই নাকি অর্ধেক কাজ হয়ে যায়! তাহলে তো বাংলাদেশের কাজ আর অর্ধেকই বাকি। ভালোর তো আর কোনো শেষ নেই। তারপরও বলাই যায়, বিশ্বকাপে বাংলাদেশের শুরুটা এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারত! আফগানিস্তানের বিপক্ষে দারুণ এক জয়ে শুরু বিশ্বকাপে বাংলাদেশ যদি স্বপ্ন দেখে, কার তাতে কি!
এর আগে অবশ্য একটা প্রশ্নের উত্তর জেনে নেওয়া খুব জরুরি—সেই স্বপ্নটা আসলে কী? দেশ ছাড়ার আগে চন্ডিকা হাথুরুসিংহে স্বপ্নটপ্নের ভাবালুতা ছেড়ে জেগে উঠে বাস্তবতায় ফিরতে বলেছিলেন সবাইকে। যার মানে, বিশ্বকাপে বড় কিছুর আশা করলে তা নিজ দায়িত্বে করবেন। বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচের আগে সেই হাথুরুসিংহেই প্রকারান্তরে আবার স্বপ্ন দেখতে বলছেন। মানে তিনি যে দেখছেন, তা আনুষ্ঠানিকভাবে সবাইকে জানিয়েছেন আরকি!
সেই স্বপ্নের নাম সেমিফাইনাল। শুরুটা ভালো করলেই যা পূরণের পথ অর্ধেক পেরোনো হয় না। প্রথম ম্যাচে পরাজয়ের পর বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড আতঙ্কিত না হতে নিজেরাই নিজেদের বলছে, বাকি আট ম্যাচের ৬টা জিতলেই তো হয়। রাউন্ড রবিন লিগের বিশ্বকাপে ম্যাজিক সংখ্যা ওই ‘৬’। ছয় জয় মানে সেমিফাইনাল নিশ্চিত। পাঁচ জয়েও ভালোই সম্ভাবনা থাকে। গ্রহ-নক্ষত্র সব লাইনে থাকলে চার জয়েও কাজ হয়ে যেতে পারে, ১৯৯২ বিশ্বকাপে যেমন হয়েছিল ইমরান খানের পাকিস্তানের।
পাঁচ-ছয় দূরে থাক, বিশ্বকাপে বাংলাদেশ চার জয়ই কখনো পেয়েছে নাকি! এশিয়া কাপের সময় সাকিব আল হাসান বিশ্বকাপে তিনের বৃত্তে ঘুরপাক খাওয়ার কথা তো মনে করিয়েই দিয়েছেন। জয়হীন ২০০৩ বিশ্বকাপের পর টানা চারটি বিশ্বকাপের প্রতিটিতেই বাংলাদেশ ৩টি ম্যাচ জিতেছে। এবার সেই তিনের চক্কর থেকে বেরোতে না পারলে বিশ্বকাপে আর নতুন গল্প লেখা হবে না।
বাংলাদেশের কোনো ক্রিকেটারের কাছে এই প্রসঙ্গ তুললে তিনি নিশ্চিত বিরক্ত হবেন। অধিনায়ক সাকিব আল হাসান একটা কথা সবার মাথায় খুব ভালোভাবে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছেন বলেই মনে হচ্ছে। বেশি দূরে ভেবে মাথার বোঝা ভারী করে তোলার কোনো অর্থই হয় না। সামনে যে ম্যাচটা আছে, শুধু সেটি নিয়ে ভাবো। একটা শেষ হলে আরেকটা।
আফগানিস্তানের বিপক্ষে জয়ের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে মেহেদী হাসান মিরাজ আবারও যা মনে করিয়ে দিয়েছেন সবাইকে। বিশ্বকাপ ফুটবলকে অনুসরণ করে আইসিসি টুর্নামেন্টেও মিক্সড জোন চালু হয়েছে বেশ কিছুদিন। পার্থক্য বলতে, বিশ্বকাপ ফুটবলের মিক্সড জোনে যেখানে দলের সব খেলোয়াড়ের দেখা পাওয়া যায়, ক্রিকেটে তা নয়।
আর বাংলাদেশ দল তো এই বিশ্বকাপে মিডিয়া থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকার নীতি নিয়েছে, মিক্সড জোনটা বাধ্যতামূলক বলে না পারতে এদিন পাঠিয়েছে একজনকে। সেই একজন, শরীফুল ইসলামও ম্যাচ ধরে ধরে এগোনোর মন্ত্র আওড়ে গেলেন।
আফগানিস্তানকে একরকম উড়িয়ে দেওয়ার পরও উচ্ছ্বাস প্রকাশে পরিমিত থাকাটাকে বলতে পারেন বাংলাদেশ দলের মন্ত্র নম্বর দুই। জয়-পরাজয় যা-ই হোক, চলে যাওয়া ম্যাচটাকে দ্রুতই পেছনে ফেলে সামনের দিকে তাকাতে হবে। মিরাজ আর শরীফুলের কথাবার্তায় যেটির স্পষ্ট প্রতিফলন।
আরেকটা কারণও আছে। জয় দিয়ে বিশ্বকাপ শুরু করাটা তো একদমই নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশ দলে এটাই যাঁদের প্রথম বিশ্বকাপ, তাঁদের জন্য তো সবই প্রথম। বাকিদের কাছে বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচে জয় তো বলতে গেলে নিয়মই। পূর্ণেন্দু পত্রীর কবিতার মতো তাঁরা জানেন—
আরম্ভের সব কিছু প্রতিশ্রুতিময়
আরম্ভে সকল গাছই সুসাস্থ্য সবুজ।
২০০৩ বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই কানাডার কাছে পরাজয় বাংলাদেশের ক্রিকেটে দগদগে এক ক্ষত হয়ে আছে এখনো। এর পর থেকে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ সব সময়ই ‘প্রতিশ্রুতিময়’। ২০১৫ আর এবার না হয় আফগানিস্তান, প্রথম ম্যাচে বড় শিকারও আছে। ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারত, ২০১৯ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকা। মাঝখানে দেশের মাটিতে ২০১১ বিশ্বকাপটাই শুধু জয়ে শুরু হয়নি। সেই বিশ্বকাপের মাত্র তিনজনই আছেন এবারও। সাকিব, মুশফিক আর মাহমুদউল্লাহর সেই স্মৃতিতেও তো প্রলেপ পড়েছে পরের দুটি বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে জয়ে।
ভালো শুরুর মূল্য অবশ্যই আছে। তবে তা কোনো কিছুরই নিশ্চয়তা নয়। সেটি হলে তো এবারই দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্বকাপ-দুঃখরজনী ভোর দেখবে বলে ঘোষণা করে দেওয়া যেত। প্রথম ম্যাচেই বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ স্কোরের রেকর্ড গড়ে বাকি দলগুলোকে একটা বার্তা পাঠানোর তাৎপর্য তো আছেই। তবে শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকা তো মাত্র একটা ম্যাচই জিতেছে। অথবা নিউজিল্যান্ডের কথা ধরুন। উদ্বোধনী ম্যাচেই চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে মাটিতে নামিয়ে আনার পরও কি আর ঘোষণা করে দেওয়া যায়, নিউজিল্যান্ড এবারও সেমিফাইনালে খেলবেই খেলবে!
এক ম্যাচ-এক ম্যাচ ধরে এগোনোর যে নীতির কথা বললাম, সেটি একেবারেই নতুন কিছু নয়। যেকোনো খেলাতেই এটা নিয়ম। তবে নিয়ম জানা আর সেটি মেনে চলা এক কথা নয়। মাথাটা নির্ভার আর চিন্তাকে পরিষ্কার রাখতে ক্রিকেটে ‘পরের বল’ নীতিটাই যেমন। বাংলাদেশ দল তা প্র্যাকটিস করতে শুরু করেছে বলেই মনে হয়।