এখন যেটি বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম, সেটির নাম ছিল তখন ঢাকা স্টেডিয়াম। সেখানে ম্যাচ শুরুর আগে বাংলাদেশের স্কোয়াড
এখন যেটি বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম, সেটির নাম ছিল তখন ঢাকা স্টেডিয়াম। সেখানে ম্যাচ শুরুর আগে বাংলাদেশের স্কোয়াড

উৎপল শুভ্রর লেখা

হ্যাপি বার্থডে, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল!

ক্রিকেট দলের কি জন্মদিন থাকে? তার ওপর তা যদি হয় কোনো দেশের জাতীয় ক্রিকেট দল! তা পালন করতে চাইলে তো করাই যায়। অন্য কোনো দেশের কথা জানি না, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তো দিনটি জানা, উপলক্ষটাও, শুধুই একটা ম্যাচ ছাড়িয়ে সেটির সুদূরপ্রসারী তাৎপর্যও।

৪৭ বছর আগে আজকের এই দিনে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল প্রথম কোনো ম্যাচ খেলতে নেমেছিল। ১৯৭৭ সালের ৭ জানুয়ারি বর্তমানে বঙ্গবন্ধুর নামাঙ্কিত তখনকার ঢাকা স্টেডিয়ামে শুরু তিন দিনের ম্যাচে এমসিসি নামেই বেশি পরিচিত মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাবের বিপক্ষে প্রথম খেলতে নেমেছিল বাংলাদেশ দল। এর আগে রাজশাহী ও চট্টগ্রামে দুটি দুই দিনের ম্যাচ খেলেছে এমসিসি, তবে তাতে স্বাগতিক দল হিসেবে খেলেছে উত্তরাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চল। ঢাকার ওই ম্যাচের পর যশোরে আরেকটি দুই দিনের ম্যাচে এমসিসির প্রতিপক্ষ ছিল দক্ষিণাঞ্চল দল। একটি দলের নাম বাংলাদেশ, এমন কোনো ক্রিকেট ম্যাচের শুরু তাই ১৯৭৭ সালের ৭ জানুয়ারি।

স্বাধীনতা লাভের পর প্রথম কিছুদিন বাংলাদেশের ক্রিকেটকে বড় এক প্রতিকূলতা অতিক্রম করে এগোতে হয়েছে সামনে। পায়ের নিচে একটু মাটি পাওয়ার পরই, ১৯৭৫-৭৬ ক্রিকেট মৌসুম শেষে আইসিসির কাছে সদস্যপদ চেয়ে বাংলাদেশ চিঠি দেয়। সেই চিঠির যে জবাব আসে, তার মূল কথা এ রকম, ‘আমরা তো বাংলাদেশের ক্রিকেট সম্পর্কে তেমন কিছুই জানি না। তাই তোমরা এমসিসিকে তোমাদের দেশে আমন্ত্রণ জানাও, ওরা খেলে এসে যে রিপোর্ট দেবে, তার ভিত্তিতেই আমরা সিদ্ধান্ত নেব।’

সমস্বরে আজ তাই বলতেই পারেন—হ্যাপি বার্থডে, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল! এই জন্মদিনে এমসিসির কাছে কৃতজ্ঞতাটা জানিয়ে দেওয়াও কর্তব্য। এমসিসির ওই সফরই তো খুলে দিয়েছিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রবেশদ্বার। আইসিসির সহযোগী সদস্য হতে বাংলাদেশ যে আবেদন করেছিল, সেটির নিয়ামক ছিল ওই সফর। একটা ক্লাব দলের সঙ্গে জাতীয় দলের ম্যাচ এমনিতে তেমন গুরুত্ব পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু বাংলাদেশের ঘটনাটা ছিল ব্যতিক্রমী। প্রথমত, এমসিসি সাধারণ কোনো ক্লাব নয়, প্রথাগত অর্থেও নয়। দ্বিতীয়ত, এমসিসি তখনো ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক এবং তাদের সার্টিফিকেটের ভিত্তিতেই বাংলাদেশ আইসিসির সদস্যপদ পেয়েছিল।

বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের প্রথম অধিনায়ক শামীম কবির

এমসিসির কাছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের তাই অনেক ঋণ। টেড ক্লার্কের নেতৃত্বাধীন সেই এমসিসি দলটি বাংলাদেশে এসেছিল ১৯৭৬ সালের শেষ দিকে। সেটিই প্রথম কোনো বিদেশি ক্রিকেট দলের বাংলাদেশে আসা। এই ঐতিহাসিক তাৎপর্যের বাইরেও এমসিসির সেই সফরের বাড়তি গুরুত্বের কথা তো বলা হয়েছে আগেই। বাংলাদেশের আইসিসি সদস্যপদ পাওয়া না–পাওয়ার ব্যাপারটি নির্ভর করছিল সেই সফরের ওপর। দলটির বাংলাদেশে আসাও মূলত সে কারণেই। স্বাধীনতা লাভের পর প্রথম কিছুদিন বাংলাদেশের ক্রিকেটকে বড় এক প্রতিকূলতা অতিক্রম করে এগোতে হয়েছে সামনে। পায়ের নিচে একটু মাটি পাওয়ার পরই, ১৯৭৫-৭৬ ক্রিকেট মৌসুম শেষে আইসিসির কাছে সদস্যপদ চেয়ে বাংলাদেশ চিঠি দেয়। সেই চিঠির যে জবাব আসে, তার মূল কথা এ রকম, ‘আমরা তো বাংলাদেশের ক্রিকেট সম্পর্কে তেমন কিছুই জানি না। তাই তোমরা এমসিসিকে তোমাদের দেশে আমন্ত্রণ জানাও, ওরা খেলে এসে যে রিপোর্ট দেবে, তার ভিত্তিতেই আমরা সিদ্ধান্ত নেব।’

এমসিসি দলকে বাংলাদেশে আনা ও এরই হাত ধরে আইসিসির সহযোগী সদস্যপদ পাওয়ায় বড় ভূমিকা ছিল প্রয়াত রাইসউদ্দিন আহমেদের। তিনি তখন সেই সময়ের বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের সাধারণ সম্পাদক।

এমসিসির রিপোর্ট অনুযায়ী এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা শুনে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তখন আইসিসি আর এমসিসি বলতে গেলে অভিন্ন এক প্রতিষ্ঠান। এমসিসির প্রেসিডেন্টই তখন আইসিসির প্রেসিডেন্ট, এমসিসির সেক্রেটারিই আইসিসির সেক্রেটারি। লর্ডসে এমসিসির অফিসের এক কোণে আইসিসির কার্যক্রম চলে। বাংলাদেশে এসে এমসিসি প্রথম ম্যাচটি খেলেছিল রাজশাহীতে। উত্তরাঞ্চলের বিপক্ষে দুই দিনের ম্যাচটি হয়েছিল দুই বছরের দুই দিনে। ১৯৭৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর শুরু হয়ে ১৯৭৭ সালের ১ জানুয়ারিতে শেষ। এরপর আরও তিনটি ম্যাচ খেলে এমসিসি দল সন্তুষ্ট হয়েই ফিরেছিল, নইলে ১৯৭৭ সালের ২৬ জুলাই বাংলাদেশ আইসিসির সদস্যপদ পেয়ে যায় কীভাবে?

স্থানীয় ক্রিকেটারদের জন্য ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ-এমসিসি তিন দিনের ম্যাচের টিকিট

এমসিসি দলকে বাংলাদেশে আনা ও এরই হাত ধরে আইসিসির সহযোগী সদস্যপদ পাওয়ায় বড় ভূমিকা ছিল প্রয়াত রাইসউদ্দিন আহমেদের। তিনি তখন সেই সময়ের বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের সাধারণ সম্পাদক। ওই সফর নিয়ে রাইসউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে অনেকবারই কথা হয়েছে। সেই সময়ের চ্যালেঞ্জটাও শুনেছি তাঁর মুখে, ‘তখন একটা ব্রিটিশ দলকে বাংলাদেশে আনা ছিল কঠিন এক চ্যালেঞ্জ। খেলা হয়েছে রাজশাহী, চট্টগ্রাম, যশোরে। ওসব জায়গায় ভালো হোটেল নেই, গরম পানির ব্যবস্থা নেই। এই সবকিছুর জরুরি সমাধান করতে হয়েছে। ঢাকা থেকে একটি বিশেষ ফ্লাইটে দুই দলকে রাজশাহী নিয়ে গিয়েছিলাম আমরা। রাজশাহী মানে ঈশ্বরদী, রাজশাহীতে তো তখন বিমানবন্দর নেই। সেখান থেকে তাদের ঢাকায় না এনে ঈশ্বরদী থেকেই বিশেষ ফ্লাইটে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল চট্টগ্রামে। যতভাবে সম্ভব, ওদের বোঝাতে চেয়েছি যে আমরা ক্রিকেট আয়োজনে সক্ষম ও আন্তরিক। বোধ হয় তা পেরেওছিলাম।’

এমসিসির সেই সফরের আসল মাহাত্ম্যটাও রোমাঞ্চিত করত রাইসউদ্দিনকে, ‘সেই প্রথম আমরা বাংলাদেশ নামে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেললাম। এর আগে ঢাকায় টেস্ট ম্যাচ হয়েছে। কিন্তু এমসিসির বিপক্ষেই তো প্রথম আমরা আলাদা সত্তা ও নতুন একটা ক্রিকেটিং নেশন হিসেবে উপস্থাপন করেছিলাম নিজেদের। এটা ভাবলে এখনো দারুণ একটা অনুভূতি হয়।’

আজ বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কেন জন্মদিন, সেটা তো বুঝতেই পারছেন। তা সেই ম্যাচে বাংলাদেশ দলে কারা খেলেছিলেন, সেই নামগুলো জানবেন না! লেখাটা না হয় এ দিয়েই শেষ হোক।

প্রথম ম্যাচের বাংলাদেশ একাদশ: শামীম কবির (অধিনায়ক), রকিবুল হাসান, শফিকুল হক হীরা, মাঈনুল হক মাঈনু, এ এস এম ফারুক, দৌলতুজ্জামান, সৈয়দ আশরাফুল হক, ইউসুফ রহমান বাবু, ওমর খালেদ রুমি, দীপু রায় চৌধুরী, নজরুল কাদের লিন্টু।