১৯৮৬ সালে প্রথম এশিয়া কাপ খেলতে শ্রীলঙ্কায় যাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়ে আমাদের বোর্ড বেশ চিন্তাতেই পড়ে গিয়েছিল। আর্থিক সচ্ছলতা সে সময় কোনো বোর্ডেরই তেমন ছিল না, আমাদের বোর্ড তো বলা যায় দরিদ্রই ছিল। অবশ্য সংগঠকেরা বেশ দক্ষ ছিলেন। আমাদের প্রস্তুতির জন্য ওমর কোরেশি একাদশ আনা হয় পাকিস্তান থেকে। তিন দিনের ম্যাচ খেলেছিলাম। ভিন্ন সংস্করণের হলেও বিশ্বতারকাদের সঙ্গে একটা পরিচিতির সুযোগ করে দেয় সেটি। সেই একাদশের হয়ে ইমরান খান, ওয়াসিম আকরাম, মহসিন খান, জাকির খান, আবদুল কাদিররা এসেছিলেন।
এশিয়া কাপটা একটা উৎসবমুখর পরিবেশেই করার চেষ্টা ছিল। কিন্তু তখনো রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব তো ছিলই। সেবার যেমন শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ঝামেলার কারণে ভারত আসেনি। শ্রীলঙ্কা অবশ্য আমাদের বড় আন্তর্জাতিক দলের মতোই সম্মান দিয়েছে সেই সময়ও। একটা ঘটনা বলি। নারকেল তেলে রান্নার কারণে খাবার নিয়ে সমস্যায় পড়েছিলাম। পরে ব্যানানা লিভ নামের একটি রেস্তোরাঁ আশীর্বাদ হয়ে আসে। সেখানে খাওয়া শেষ করে বের হতে গিয়ে দেখি, অনেকেই অটোগ্রাফের জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। আমাদের তখন অটোগ্রাফ দেওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল শুধু দেশে আবাহনী-মোহামেডানের খেলোয়াড় হিসেবে। জাতীয় দলের ক্রিকেটার হিসেবে, তা–ও আবার দেশের বাইরে এমন অভিজ্ঞতা ছিল না সেভাবে।
পাকিস্তানের সঙ্গে প্রথম ম্যাচটি ছিল মোরাতুয়াতে। লাল বলের খেলা। বেশ রোমাঞ্চিত ছিলাম ব্যক্তিগতভাবে। এক ভদ্রলোককে দেখেছিলাম ছবি তুলতে। ইমরান খানের সঙ্গে টসের ছবিও তিনি তুলেছিলেন। পরে জানলাম, তিনি টুর্নামেন্ট কমিটির কেউ নন। পরে আমাদের কাছে এসে ছবিগুলো বিক্রি করেছিলেন।
টসের আগে ইমরান এসে বললেন, ‘গাজী, ইটস আ লং ওয়াক আপ টু দ্য পিচ, হোয়াই নট উই ডু ইট হিয়ার?’ তখনো বাউন্ডারি সীমানা অতিক্রম করিনি। আমি সাদা পোশাকে, হাতে একটা কাপড়ের স্মারকে শাপলাখচিত মনোগ্রাম, যেটি অদল–বদল করব। ইমরানের এমন কথার পর আমি একটু হকচকিত হয়ে গেছিলাম। তখন টসের সময় ম্যাচ অফিশিয়ালও কেউ থাকতেন না। কেউ থাকলেও হয়তো ইমরানের অমন প্রস্তাব না করতে পারতেন না, বিশ্ব ক্রিকেটে তাঁর অবস্থানই অমন ছিল। আমিও ইমরানের প্রস্তাবে রাজি হই, সেখানে আর কোনো বাক্যবিনিময়ও হয়নি। তাঁকে খুবই ভদ্রলোকই মনে হয়েছে, আমাদের খাটো করে কোনো কথাও বলেননি।
সকালের কন্ডিশন কাজে লাগাতে পেশাদার দল হিসেবে ফিল্ডিংই নিয়েছিল পাকিস্তান। আমরা তেমন লড়াই করতে পারিনি, তবে সেই ম্যাচে পার্ট টাইম বোলার হিসেবে জাভেদ মিঁয়াদাদের উইকেট পাওয়ার স্মৃতিটা মনে আছে।
শ্রীলঙ্কা তখন উঠতি দল। তবে অরবিন্দ ডি সিলভা, রোশান মহানামা, অর্জুনা রানাতুঙ্গারা উঠে আসছেন। আমরা একদিন অনুশীলন করছি, হঠাৎ দেখি শ্রীলঙ্কা দল। সেদিন পাকিস্তানের সঙ্গে ম্যাচ ছিল তাদের। ওই ম্যাচে আগেভাগে হেরে যাওয়ার পর সরাসরি অনুশীলনে চলে এসেছে। মহানামা শর্ট বল ছেড়ে দেওয়ার অনুশীলন করছেন, নেটে এক লেগ স্পিনারের ওপর চড়াও হচ্ছিলেন ডি সিলভা—হয়তো কাদিরকে মাথায় রেখে। তখনো আমাদের ক্লাব ক্রিকেটে একটা ম্যাচের পরদিন বিশ্রাম থাকে, আর ওরা আন্তর্জাতিক ম্যাচ হেরেই অনুশীলনে চলে এসেছে।
সেবারই শ্রীলঙ্কার ভালো ক্রিকেট অবকাঠামো, স্কুল ক্রিকেটের শক্ত ভিতটা টের পেয়েছিলাম। আমরা ফাইনাল দেখতে থেকে গিয়েছিলাম। ফাইনালে শ্রীলঙ্কা ঘুরে দাঁড়িয়ে শিরোপা জিতল। একটা আন্ডারডগ দল মানসিক শক্তি দিয়ে কী অর্জন করতে পারে, দেখলাম। জয়ের মানসিকতাটাই আসলে বড়। কিন্তু আমরা সে সময় আসলে বড় দলকে হারানোর কথা ভাবতেই পারতাম না।
১৯৮৮ সালে যখন আমাদের এখানে এশিয়া কাপ হলো, সেবার ভারত-পাকিস্তান দুই দলই এসেছিল। তখনো আমাদের ক্রিকেট আবর্তিত আইসিসি ট্রফি ঘিরে। এশিয়া কাপে ব্যক্তিগত অর্জন কিছু থাকলেও দলকে জেতাতে যথেষ্ট ছিল না। পরে ১৯৯৭ সালে ম্যানেজার থাকা অবস্থায় এশিয়া কাপ কাছ থেকে দেখেছি। তখনো অন্য দলগুলোর সঙ্গে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য ছিল আমাদের।
এশিয়া কাপ টুর্নামেন্টটা একসময় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হারিয়ে ফেলে, পরবর্তী সময়ে ঠিক সেভাবে গুরুত্বও পায়নি। এখন বাংলাদেশের উত্থান, জয়ের সামর্থ্য, সঙ্গে আফগানিস্তানের আগমন এশিয়া কাপকে কিছুটা ইন্টারেস্টিং করে তুলেছে। এর কৃতিত্ব বাংলাদেশকে দিতে হবে। এশিয়া কাপের নতুন একটা টেম্পো তৈরি করা, ভারত-পাকিস্তানের মতো দলগুলোর জন্য উদ্বেগের কারণ তৈরি করেছে বাংলাদেশ। এখন তো এশিয়ার অনেক খেলোয়াড় বাংলাদেশে আসেন বিপিএলের মতো টুর্নামেন্ট খেলতে। ফলে তাঁরা পরিচিতই। এখন আর এশিয়া কাপ বাংলাদেশের জন্য তেমন অচেনা মঞ্চ নয়।
এখনো এশিয়ায় সবচেয়ে ভারতই সব দিক দিয়ে এগিয়ে। মধ্যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আয়োজন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় পাকিস্তান কিছুটা পিছিয়ে গেছে। তবে ভারতের পরই তারা থাকবে। শ্রীলঙ্কা একটা পালাবদলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান এখন শক্তিমত্তায় কাছাকাছি। এবার গ্রুপ পর্বে তিন দল একসঙ্গে। যদিও ওয়ানডেতে আমরা বেশ ভালো। লড়াইটা বেশ আকর্ষণীয় হবে। এখন এশিয়া কাপ অনেক চ্যালেঞ্জিং। সব দলই এগিয়ে গেছে, নেপালের মতো দেশও উঠে আসছে।