অন্যবারের বিশ্বকাপের তুলনায় এবার বেশ কিছু ইতিবাচক দিক আছে বাংলাদেশ দলে। এশিয়া কাপে তেমন একটা ভালো করতে না পারলেও ম্যাচজয়ী খেলোয়াড়ের সংখ্যা আগের তুলনায় বেশি। সেটি ব্যাটিংয়ে এবং বোলিংয়েও।
তাওহিদ হৃদয়ের অন্তর্ভুক্তির পর মিডল অর্ডারে শক্তিমত্তা বেড়েছে। মিডল অর্ডার থেকে মুশফিকুর রহিমের ছয়ে এসে খেলার ধরনে যে পরিবর্তন, সেটি দলকে আরও শক্তিশালী করেছে। পেস এবং স্পিন মিলিয়ে দলের বোলিং কম্বিনেশনে আগে কিছুটা দুর্বলতা ছিল, একটা অনিশ্চয়তা ছিল। এখন বেশ ধারাবাহিক হচ্ছে। পেসাররা তো অবশ্যই, স্পিনাররাও যথেষ্ট ভালো ভূমিকা রাখছে। এখন যদি ব্যাটসম্যানরা মোটামুটি একটা স্কোর গড়তে পারে, বোলারদের সেটা ডিফেন্ড করার সামর্থ্য আছে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে কম পুঁজি নিয়েও তারা লড়াই করেছে।
মোস্তাফিজুর রহমানের নতুন বলে কার্যকরী বোলিং করাটাও দলের জন্য ইতিবাচক। পাশাপাশি ফিল্ডিংয়েও কিছুটা উন্নতি চোখে পড়েছে। তরুণ খেলোয়াড়দের সংখ্যার কারণেই হয়তো সেটি হয়েছে। আগের তুলনায় ম্যাচ জয়ের সম্ভাবনা এ কারণে একটু বেশি।
বাংলাদেশের পক্ষে যেতে পারে কন্ডিশনও। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের পছন্দ হওয়ার কথা ভারতের কন্ডিশন। বড় স্কোর বাংলাদেশও গড়তে পারে, যেটি এ বিশ্বকাপে প্রত্যাশিত। এবার কিন্তু ৩০০ বা এর বেশি স্কোর গড়া জরুরি হবে এবং তার সামর্থ্য এই দলের আছে।
খেলোয়াড়দের মানসিকতার মধ্যে আক্রমণাত্মক একটা ধাঁচ আসাও আরেকটা শক্তিমত্তার জায়গা হতে পারে আমাদের। সবাই এখন ইতিবাচক ক্রিকেট খেলে। প্রতিপক্ষকে হয়তো সমীহ করে, তবে তারপরও ইতিবাচকই খেলে। এই দলে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপজয়ী দলের কয়েকজন তরুণ সদস্য আছে। তাদের ইতিবাচক মানসিকতার প্রভাব পুরো দলেই পড়েছে বলে মনে হয়।
আগে বাংলাদেশ যতই ভালো খেলুক না কেন, মানসিক দিক দিয়ে অন্য বড় দলগুলোর তুলনায় বেশ পিছিয়ে ছিল। তরুণেরা আসার পর তাতে একটা পরিবর্তন এসেছে। এখন ওরা ভাবতে পারেই যে তারা কারও চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। এটি বেশ বড় একটা পরিবর্তন।
এর সঙ্গে সাকিবের অধিনায়কত্ব বাড়তি প্রাপ্তি হবে। সাকিব নিজে আক্রমণাত্মক খেলোয়াড়, আক্রমণাত্মক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বেশ নির্ভয়ে, পিছুটান ছাড়াই এসব সিদ্ধান্ত নেয় সে। তার অভিজ্ঞতা, অধিনায়ক হিসেবে খেলোয়াড়দের ওপর নিয়ন্ত্রণ, খেলোয়াড়দের কাছে গ্রহণযোগ্যতা—সব মিলিয়ে তার পক্ষে এমন একটা দল গঠন করা সহজ, যেটির লক্ষ্য একই। খেলোয়াড়েরাও তার অধীনে খেলাটা উপভোগ করে।
ওয়ানডেতে সম্প্রতি সেভাবে ভালো না খেললেও বাংলাদেশ বেশ লম্বা একটা সময় ধরেই এ সংস্করণে ধারাবাহিকভাবে ভালো দল। সে আত্মবিশ্বাস নিশ্চয়ই হারিয়ে যায়নি। আমার তো মনে হয়, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম প্রস্তুতি ম্যাচটি জয়ের পর সে আত্মবিশ্বাস আরও বেড়েছে।
আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচটি জেতা জরুরি। তাহলে মানসিক দিক দিয়ে বেশ এগিয়ে যাবে দলটা, যা বিশ্বকাপে তাদের ভালো করতে সহায়তা করবে।
দুর্বলতার কথা যদি বলি, টপ অর্ডারে ফর্মহীনতা ছিল। লিটন দাস এবং অনভিজ্ঞ তানজিদ হাসান সেভাবে ভালো করতে পারেনি। যদিও প্রথম প্রস্তুতি ম্যাচটি দুজনেরই ভালো গেছে, দ্বিতীয় ম্যাচে তানজিদ ভালো করেছে। এরপরও কিছুটা অস্বস্তি থাকবে সেখানে। আরও দুই-একটি ম্যাচে যদি রান করে ধারাবাহিকতা দেখায়, তাহলে দলকে সেটি সাহস জোগাবে।
দলে তৃতীয় কোনো ওপেনার নেই, সে সুযোগ হয়তো ছিলও না। সম্প্রতি যাদেরকে দিয়ে চেষ্টা করা হয়েছে, তারা কেউই সেভাবে কিছু করতে পারেনি। প্রয়োজন পড়লে হয়তো মিরাজকে দিয়ে চেষ্টা করানো হবে। মিরাজ ভালো খেলছে, তবে একজন রেগুলার ওপেনার ও মেকশিফট ওপেনারের মধ্যে পার্থক্য থাকবেই। বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে মেকশিফট ওপেনার কতটুকু কী করবে, নিশ্চিত নই। আবার বড় শট খেলার সামর্থ্যে তুলনামূলক পিছিয়ে বাংলাদেশ, এটিও কিছুটা পিছিয়ে দেবে।
বেশির ভাগ দলেই হয়তো একজন লেগ স্পিনার থাকবে, যা বাংলাদেশের নেই। যে ধরনের উইকেটে খেলা হচ্ছে, সবগুলোতে স্পিনাররা সহায়তা পাবে, তা নয়। তবে আমরা জানি লেগ স্পিনার মানে উইকেট টেকিং বোলার। যেকোনো ধরনের উইকেটেই কার্যকরী লেগ স্পিনাররা। সে সুবিধাটা বাংলাদেশ পাবে না।
এবার বাংলাদেশের প্রস্তুতি ভালো হয়নি মোটেও। শেষ মুহূর্তে দল নির্বাচন, দল নির্বাচন ঘিরে অনিশ্চয়তা, এশিয়া কাপ বা নিউজিল্যান্ড সিরিজে আত্মবিশ্বাস হারানোর মতো পারফরম্যান্স দেখেছি। এগুলো থেকে বেরিয়ে আসাটা চ্যালেঞ্জ হবে স্বাভাবিকভাবেই।
মাহমুদউল্লাহকে দলে নেওয়া হলো, কিন্তু এর আগে ছয় মাস সেভাবে সুযোগ দেওয়া হলো না। তার ম্যাচ প্রস্তুতিতে ঘাটতি থাকবে। একই ব্যাপার তানজিদের ক্ষেত্রেও। এশিয়া কাপে এক ম্যাচ খেলে বসিয়ে দেওয়া হলো, বুঝিয়ে দেওয়া হলো সে মূল খেলোয়াড় নয়। অথচ তাকেই বিশ্বকাপে নিয়ে যাওয়া হলো। এগুলো ভালো ইঙ্গিত বহন করে না। আগেই যদি উপলব্ধি করা যেত—মোহাম্মদ নাঈমদের দিয়ে হচ্ছে না, তাহলে আগেই সুযোগ দেওয়া যেত তানজিদকে। সে আরেকটু সাহস নিয়ে যেতে পারত।
এর বাইরে সাকিব ও তামিম ইকবালকে নিয়ে যে বিতর্ক এবং সেসব ঘিরে ক্রিকেট অঙ্গনে যে আলোড়ন, তার নেতিবাচক একটা প্রভাব শুরুতে ছিল অবশ্যই। আমি জানি না বোর্ড বা টিম ম্যানেজমেন্ট সেটিকে কীভাবে সামলেছে। অবশ্য একবার খেলার মধ্যে ঢুকে গিয়ে ভালো খেললে তা থেকে হয়তো বের হয়ে আসতে পারবে। তবে এর নেতিবাচক একটা প্রভাব শুরুতে থাকবে।
ভারত, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার মতো প্রতিষ্ঠিত দলগুলো লম্বা সময় ধরে নিজেদের খেলা ধরে রাখতে পারে। বাংলাদেশের মতো দলের ক্ষেত্রে সেটিই বড় চ্যালেঞ্জ। খেলা ভালো হবে, খারাপ হবে। খারাপ একটি দিনের পর পারফরম্যান্স ফিরিয়ে আনাটাই চ্যালেঞ্জ। মোমেন্টামটা কতক্ষণ ধরে রাখতে পারে দলটি, সেটি দেখার বিষয়। ভিন্ন ভিন্ন মাঠে ভিন্ন কন্ডিশনে আলাদা প্রতিপক্ষের সঙ্গে খেলা হবে। নিয়মিত চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে। ফলে মানসিক চাপ থাকবে। এর বাইরে মিডিয়া, সাধারণ মানুষ দলকে অনেক চাপে রাখবে। সেগুলো দল কীভাবে সামলায়, সেটিও দেখার বিষয়।
আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে শুধু ভালো খেললে হবে না, জিততে হবে। তাহলে দল মানসিক দিক দিয়ে অনেকটাই এগিয়ে যাবে, যেটি দলকে অনেক দূর নিয়ে যেতে পারে। সে মোমেন্টাম দিয়েই বড় দলগুলোকে বিপদে ফেলতে পারে বাংলাদেশ।
শীর্ষ চারে যাওয়াটা এমনিতে অনেক কঠিন হবে। কারণ, টুর্নামেন্টের ফরম্যাট এমন, বড় দলগুলোর সঙ্গে কয়েকটি ম্যাচ জিততে হবে। তবে সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়েও দেওয়া যায় না, ম্যাচজয়ী খেলোয়াড়েরা আশা জাগাতে পারে। বোলিংয়ের শক্তিটাও কিন্তু নেহায়েত খারাপ নয়।
শর্ত হচ্ছে আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেদারল্যান্ডসের মতো সমশক্তির দলগুলোর বিপক্ষে হারা যাবে না। এর পাশাপাশি পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তিনটি ম্যাচের মধ্যে দুটি; ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ থেকে একটি জিতলে সেমিফাইনালে খেলা সম্ভব।
পথটা কঠিন, তবে অসম্ভব বলব না। চেষ্টা করলে অনেক দূর যাওয়ার সামর্থ্য আছে দলটার। সেটি যদি না–ও হয়, কেউ বাংলাদেশের বিপক্ষে সহজে জিতবে বলে মনে হয় না। এখন ওরা নিজেদের মেলে ধরতে পারলেই হয়।
নাজমূল আবেদীন: ক্রিকেট বিশ্লেষক ও কোচ।